মা-সন্তানের স্বর্গরাজ্য ‘শিশু-আলয়’ by মানসুরা হোসাইন

১৩ মাস বয়সী ছেলে সাদমান রাফিদকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন রাইসা আক্তার। দুধ খেতে খেতে সাদমান ঘুমিয়ে পড়ল। বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো তাকে। কোলবালিশ জড়িয়ে আরাম করে ঘুমাতে লাগল সে। এবার নিশ্চিন্ত মনে অফিসের কাজে বেরিয়ে গেলেন রাইসা।
না, এটি রাইসা আক্তারের নিজের বাড়ির শোবার ঘরের দৃশ্য বর্ণনা নয়। এটি রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি)-এর দিবাযত্ন কেন্দ্র ‘শিশু-আলয়’-এর নৈমিত্তিক চিত্র। আইসিডিডিআর’বির কর্মীদের শিশু সন্তানদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই ‘স্বর্গরাজ্য’।
আইসিডিডিআর’বির জেন্ডার অ্যান্ড ডাইভারসিটি স্পেশালিস্ট এবং শিশু-আলয়ের তত্ত্বাবধায়ক ফারজানা শাহনাজ মজিদসহ সবাই খেলাধুলায় ব্যস্ত। ছবি: মানসুরা হোসাইন
রাইসা আইসিডিডিআর’বিতে কাজ করছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে। সাদমান তাঁর প্রথম সন্তান। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকেই তিনি সাদমানকে নিয়ে সকালে আসেন। তাকে ‘শিশু-আলয়’‍-য়ে রেখে অফিস করেন। মাঝখানে কাজের ফাঁকে দুইবার এসে বুকের দুধ খাইয়ে যান। অফিস শেষ করে বিকেলে সাদমানকে নিয়ে বাসায় ফেরেন। মা ও ছেলেকে একদিনের জন্যও আলাদা থাকতে হয়নি। ফলে মা ও ছেলে সারা দিনের জন্য নিশ্চিন্ত।
কথা হয় রাইসার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাচ্ছি। দেখতেই পাচ্ছি আরামে ঘুমাচ্ছে। বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য যে খাবার তা ঠিকমতো খাচ্ছে। এখানে দক্ষ ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে থাকছে। কোনো কারণে শরীর খারাপ হলেও দ্রুত খবর পাচ্ছি। ফলে ছেলেকে বাসায় কাজের লোকের কাছে রেখে আসলে যে চিন্তায় থাকতে হতো এখন আর তা হচ্ছে না। আমিও মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছি।’
ত্বাহার ছবি তোলা হচ্ছে বুঝতে পেরে নিজে থেকেই পোজ দিল। ছবি: মানসুরা হোসাইন
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, শিশু-আলয়ের চেয়ার টেবিল, বিছানা, এমনকি বাথরুমের বেসিন, কমোড পর্যন্ত শিশুদের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। চারপাশের সব কিছু রঙিন। খেলনা, পুতুলের মধ্যে শিশুরা হেসে খেলে দিন পার করে। মায়েরা সারা দিন থাকেন নিশ্চিন্তে। শিশু-আলয়ে সন্তান রাখছেন এমন কয়েকজন মা জানালেন, শিশু-আলয় শিশুদের পাশাপাশি তাঁদের মায়েদের কাছেও স্বর্গরাজ্য। কারণ এখানে বাচ্চাদের রেখে তাঁদের দুশ্চিন্তায় ভুগতে হচ্ছে না। অবশ্য শুধু নারী কর্মীই নন, পুরুষ কর্মীরা তাঁদের সন্তানদের এখানে রাখতে পারছেন। তবে এখন পর্যন্ত বাবাদের সংখ্যাটা কম।
বৃহস্পতিবার সকালে শিশু-আলয়ে ঢুকতেই দেখা গেল বিভিন্ন বয়সী লাবণ্য, জুহাদ, ত্বাহা, মেহেরান, রিহানসহ আট থেকে ১০ জন বসে খেলছে। প্লাস্টিকের ব্লক দিয়ে কেউ গাড়ি বানাচ্ছে। অন্যরা বাড়ি বা অন্য কিছু বানাচ্ছে। সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীর কোলে একজন একটু মন খারাপ করে বসে আছে। জানা গেল, সে এখন বড় হয়ে গেছে। তাই তাকে বেবি রুম থেকে এই রুমে আনা হয়েছে। সে তার পুরোনো বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করছে। তাকে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য বেবি রুম থেকে এনে অভ্যস্ত করানো হচ্ছে।
রাইসা আক্তার কাজের ফাঁকে এসে সাদমানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পর আদর করছেন।ছবি: মানুসরা হোসাইন
কেন্দ্রের প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী রোকেয়া বেগম কাজ করছেন ২০০০ সাল থেকে। বাচ্চাদের সঙ্গে দিন কাটাতে তাঁর ভালো লাগে। তবে এর চেয়েও তিনি যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন তা হলো মায়েদের মুখের হাসি। রোকেয়া বলেন, ‘মায়েদের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। কিছুক্ষণ থাকার পর মায়েরা যখন কাজে ফেরেন তখন মুখে কোনো উদ্বেগের চিহ্ন থাকে না। প্রতিদিন মায়েদের হাসি মুখগুলো দেখতে খুব ভালো লাগে।’
রোকেয়া বেগমসহ মোট পাঁচজন প্রশিক্ষিত নারী বাচ্চাদের দেখভাল করছেন। ছুটির দিন ছাড়া সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থাকে শিশুরা। ছুটির দিনেও বাচ্চারা বায়না ধরে ‘আন্টির কাছে যাব’।
লায়লা ফারজানা কমিউনিকেশন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর এক ছেলের বয়স এখন সাড়ে পাঁচ বছর। চার বছর পর্যন্ত সে এখানেই বেড়ে উঠেছে। আর এখন দুই বছরের বেশি বয়সী মানহাও থাকছে।
বালি ধরতে নেই মানা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
লায়লা ফারজানা বলেন, ‘শিশু-আলয় মায়েদের, বিশেষ করে যেসব মা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাঁদের জন্য স্বর্গরাজ্য। আর কাজের ফাঁকে সন্তানকে দেখে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো বিভাগই বিরোধিতা করে না। বিভাগের প্রধানদের মনমানসিকতা সেভাবেই গড়ে উঠেছে।’
লায়লা ফারজানার বড় ছেলেকে স্কুলে দিয়েছেন। সে অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, এখানে বড় হওয়া বাচ্চারা খুব সামাজিক হয়। সব ধরনের বাচ্চাদের সঙ্গে বড় হয়। ফলে স্কুলে ভর্তি করতেও কোনো সমস্যা হয় না।
এখানকার শিশুদের জন্য ফ্রি প্লে, স্টোরি টাইম, আর্ট অ্যান্ড কার্টস, সার্কেল টাইম, মিউজিক অ্যান্ড কুকিং, আউটডোর প্লে, বার্থডে বা স্পেশাল ডে পার্টি, ড্রেসআপ কর্ণারসহ আছে অনেক আয়োজন। বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য আছে আলাদা কক্ষ।
টগবগ টগবগ ঘোড়ায় চড়ে...। ছবি: মানসুরা হোসাইন
শিশুদের বাইরে গিয়ে খেলার সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একেকজন ছোট ছোট জুতা পায়ে গলিয়ে যার যার পছন্দের খেলায় মেতে ওঠে। বালু, পানি সবই তখন হাতের কাছে। আছে খেলনা সাইকেলও। তখন আর তাদের পায় কে।
আইসিডিডিআর’বির প্রাঙ্গণেই অবস্থিত এ দিবাযত্ন কেন্দ্র। জেন্ডার নীতিমালার আওতায় ২০০৬ সাল থেকে যাত্রা শুরু কেন্দ্রের। এর আগে ১৯৯৪ সাল থেকেই ছোট আকারে মায়েরা সন্তান রাখার সুযোগ পেতেন। এখানে নিম্ন আয়ের মা ও বাবাদের জন্যও আছে বিশেষ ছাড়। শিশুদের প্রাক-স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে খেলার মাধ্যমে শেখানো হয়। কোনো শিশুর মানসিক সেবার প্রয়োজন হলে কেন্দ্র থেকেই তা দেওয়া হচ্ছে। তিন মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত শিশুদের রাখা হয়। ৩৫ জন শিশুর থাকার ব্যবস্থা আছে এখানে।
মায়েদের জন্য স্বর্গরাজ্য এই শিশু-আলয়। ছবি: মানসুরা হোসাইন
আইসিডিডিআরবি’র জেন্ডার অ্যান্ড ডাইভারসিটি স্পেশালিস্ট ফারজানা শাহনাজ মজিদ এই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে আছেন। তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। শহরে একক পরিবারের প্রাধান্য বাড়ছে। মা, শাশুড়িরাও বাইরে কাজ করছেন। চাইলেই বিশ্বাসযোগ্য কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বলে নারী সন্তানকে দেখার জন্য হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবেন তা হবে না। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীর হাতে পয়সা থাকতে হবে। তাই নারী যে প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেন না কেনো তাঁর সন্তানকে রাখার ব্যবস্থা করবে সেই প্রতিষ্ঠান। আর এ ধরনের কেন্দ্রে বাবা ও মা দু-জনই যাতে সন্তানকে রাখার সুযোগ পান তা নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.