বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে গেছে by সেলিম জাহিদ

নেতা-কর্মীদের আত্মগোপন ও নিষ্ক্রিয়তায় তছনছ হয়ে পড়েছে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো। এ অবস্থায় দলটির আন্দোলন, নির্বাচন—সব ধরনের কর্মসূচিই অনেকটা ‘ঘোষণানির্ভর’ হয়ে পড়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী এবং আন্দোলন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তাঁরা বলছেন, নিকট অতীতে এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকেনি বিএনপি। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে কারাবরণ, নেতা-কর্মীদের গুম-খুন ও নির্যাতনের ভীতি দলের সকল পর্যায়ে। এ কারণে শীর্ষ পর্যায় থেকে নানা চেষ্টা, আহ্বান, তাগিদ সত্ত্বেও দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানো যাচ্ছে না।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, সর্বশেষ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সংকট প্রকাশ পেয়েছে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভোটে ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটাতে সংবাদ সম্মেলন করে নেতা-কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাতে বলেছিলেন। এমনকি গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করারও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। নির্বাচনের দিন ৯০ ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টই যাননি। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ভয়ে নেতা-কর্মীরা যার যার জায়গায় চুপচাপ ছিলেন।
বিএনপির নেতারা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই ৬ জানুয়ারি থেকে টানা তিন মাসের আন্দোলনে সফল হতে পারেনি বিএনপি। সিটি নির্বাচনে সেই দুর্বলতা আরও খোলাসা হয়েছে। দেখা গেছে, আন্দোলনের মতো সিটি নির্বাচনেও দলের নীতিনির্ধারণী ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নেতা সক্রিয় হননি বা আত্মগোপন অবস্থান থেকে বের হননি। আন্দোলনের পর নির্বাচনেও দলীয় নেতৃত্বের দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা আরও চরমে উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন ও আন্দোলনে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার একটি দিক যে প্রকাশ পেয়েছে, তা অস্বীকার করব না। তবে এ জন্য বেশি দায়ী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’
দলের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে গত চার মাসে প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে ৬ জানুয়ারি অবরোধ কর্মসূচি শুরুর আগেই গ্রেপ্তার করা হয় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে। এরপর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের আন্দোলন, এরপর এপ্রিলে তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে খালেদা জিয়াসহ মাত্র তিন-চারজন নেতাকে সক্রিয় হতে দেখা যায়।
বিএনপির সূত্র জানায়, অনেক দিন পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ ও আ স ম হান্নান শাহ সিটি নির্বাচনে সক্রিয় হন। আন্দোলনের সময় এ দুই নেতাসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গণি, জমির উদ্দিন সরকার, এম কে আনোয়ার, সারোয়ারি রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া নীরব ছিলেন। তরিকুল ইসলাম ও মির্জা আব্বাস আত্মগোপনে আর নজরুল ইসলাম খান চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে ছিলেন। আন্দোলনে এই তিনজনের সম্পৃক্ততা ছিল। আবদুল মঈন খান কখনো সক্রিয়, কখনো নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এমনও অভিযোগ আছে, ওই সময় একজন বিদেশি কূটনীতিক বিশেষ প্রয়োজনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যকে নিজ দূতাবাসে আমন্ত্রণ জানালেও তিনি যাননি। ভয়ে তিনি বাসা থেকে বের হতে রাজি হননি।
এর বাইরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুনীতির মামলায়, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ফৌজদারি মামলায় কারাগারে আছেন। তারেক রহমান লন্ডনে, এম শামসুল ইসলাম অসুস্থ। আর খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা গেছেন।
বিএনপির ও বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র জানায়, আন্দোলন চলাকালে নেতারা এতটাই ভীতিতে ছিলেন যে মাহবুবুর রহমান ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সব সদস্য গণমাধ্যমকেও এড়িয়ে চলেছেন। সিটি নির্বাচনের পর সেই আগের অবস্থা ফিরে এসেছে। গত কয়েক দিন তৎপর ছিলেন, এমন তিনজন স্থায়ী কমিটির সদস্যকে গতকাল ফোন করলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাতজন যুগ্ম মহাসচিব আছেন। মহাসচিবের পাশাপাশি তাঁরাও সাংগঠনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মির্জা ফখরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করার পর যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ দায়িত্ব পান। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর দায়িত্ব দেওয়া হয় সালাহ উদ্দিন আহমেদ। ৫৩ দিন ধরে তাঁর খোঁজ নেই। এরপর দায়িত্ব পান আত্মগোপনে থাকা বরকত উল্লাহ। এখন দলের মুখপাত্রের দায়িত্বে আছেন আসাদুজ্জামান রিপন। যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান আগেই গ্রেপ্তার হন। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আরেক যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু আত্মগোপনে। আর আমান উল্লাহ আমান শুরু থেকেই নিষ্ক্রিয়। মাহবুব উদ্দিন খোকন ব্যস্ত আইন পেশায়।
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা পররাষ্ট্রবিষয়ক বিভাগটিও ভেঙে পড়েছে। গত জানুয়ারিতে আন্দোলনের শুরুর দিকেই দলের পররাষ্ট্র বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানকে গুলি করে আহত করা হয়। তার আগে গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মুবিন চৌধুরীকে। ওই সময় গুলশানের কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে পররাষ্ট্র বিভাগের সদস্য সাবিহ উদ্দিন আহমেদের গাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর তিনি দীর্ঘদিন আর বাসা থেকে বের হননি।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন গত ১১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে গেলে ওই দিন সাবিহ উদ্দিন আহমেদও যান।
দলীয় সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলন ও নির্বাচনে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের ৩২ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র সাত-আটজন সক্রিয় বা তৎপর ছিলেন। এর মধ্যে এম ওসমান ফারুক, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আহমদ আযম খান, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম, শওকত মাহমুদ ও এ জেড এম জাহিদ হোসেন আন্দোলন ও সিটি নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তার আছেন উপদেষ্টা পরিষদের দুই সদস্য এম এ মান্নান (গাজীপুর সিটি মেয়র), শামসুজ্জামান দুদু। তিনজন উপদেষ্টা মারা গেছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে আন্দোলন ও নির্বাচনে ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের কিছু তৎপরতা দেখা গেছে। যুবদল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, ওলামা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল ও জাসাসের উল্লেখ করার মতো তৎপরতা ছিল না। ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো দেওয়া হয়নি। সংগঠনের মহানগর কমিটিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি নেই। স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের কমিটি গঠন নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে সিদ্ধান্তহীনতা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৯ সালের পর দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয় না। আন্দোলন-কর্মসূচি সবকিছু একাই ঠিক করছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এতে দুই-চারজন ছাড়া দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকে কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে হলে পদ কেনা-বেচা বন্ধ করতে হবে। যোগ্যদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। কারও পছন্দের লোক দিয়ে দল চালানো যাবে না।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, সিটি নির্বাচনের পর এখন দল ও ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা আবার গ্রেপ্তার-আতঙ্কে আছেন। পাশাপাশি তাঁদের মধ্যে আগের মতো গুম-খুন এবং অপহরণের ভীতিও রয়েছে। ১০ মার্চ রাতে দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ উত্তরার একটি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর বিএনপির সব মহলে ছড়িয়ে পড়া এই ভীতি এখনো কাটেনি। সালাহ উদ্দিন ছাড়াও বর্তমানে ছাত্রদলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা আনিসুর রহমান তালুকদার ও মেহেদী নিখোঁজ আছেন। এ অবস্থায় নির্বাচন উপলক্ষে যে কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই আবারও আত্মগোপনে চলে গেছেন। বিশেষ করে মির্জা আব্বাসের জামিনের মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তারের ভীতি বেড়ে গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান গ্রেপ্তার, গুম ও অপহরণের ভীতির কথা স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের সাংঘাতিক কঠোর মনোভাব এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মমভাবে ক্ষমতা ব্যবহার নেতা-কর্মীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। বিশেষ করে সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.