গৌরবের ড্র খুলনায় by নাইর ইকবাল

সাকিব আল হাসান ও ওয়াহাব রিয়াজের বচসার এই মুহূর্তটি
যেন খুলনা টেস্টের প্রতী​কী চিত্র হয়েই রইল। ছবি- শামসুল হক
সফরে আরও একটি ম্যাচে জয়শূন্য পাকিস্তান। সেই প্রস্তুতি ম্যাচ থেকে শুরু। এরপর পেরিয়ে গেছে তিনটি ওয়ানডে, একটি টি-টোয়েন্টি। ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই হওয়ার পর পাকিস্তানিদের কণ্ঠে ঝরেছিল টি-টোয়েন্টিতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। ব্যর্থ তারা সেখানেও। বড় জয়েই রঙিন পোশাকের শ্রেষ্ঠত্বে এতটুকু আঁচড় ফেলতে দেয়নি বাংলাদেশ দল। সাদা পোশাকের লড়াইয়ে পাকিস্তানের ভাবভঙ্গিই ছিল অন্যরকম। মিসবাহ-উল-হক ও ইউনিস খানের অন্তর্ভুক্তিতে ছোট ফরম্যাটের ঝাল তোলারই যেন প্রস্তুতি ছিল তাদের। খুলনা টেস্টের প্রথম তিন দিন ছিল তারই ইঙ্গিত। কিন্তু চতুর্থ আর পঞ্চম দিনে এসে বাংলাদেশ প্রমাণ করে ছাড়ল, সেই দিন আর নেই। এই বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি পরিণত। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখেও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি, সামর্থ্য সবই আছে বাংলাদেশের।
নতুন দিনের নতুন বাংলাদেশ গত কিছু দিন ধরে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাদের রেকর্ড নতুন করে লিখছে। প্রথম ওয়ানডে জয়, প্রথম সিরিজ জয়, প্রথম ধবল ধোলাই, প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়...। সেই তালিকায় যুক্ত হলো পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে প্রথম ড্র। প্রথম জয়টাও হয়তো খুব বেশি দূরে নেই!
পরিণত বাংলাদেশের বিরাট বিজ্ঞাপন হয়ে রইলের তামিম ইকবাল আর ইমরুল কায়েস। ২৯৬ রানের ঘাটতি নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ক্রিকেট দুনিয়াকে দেখিয়ে দিলেন নিজেদের বীরত্বগাথা। ৩১২ রানের অনন্য এক জুটি গড়ে নিজেদের নিয়ে গেলেন রেকর্ড বইয়ের অনেকগুলো পৃষ্ঠায়। উদ্বোধনী জুটিতেই পাকিস্তানিদের টেস্ট জয়ের আশা শেষ। তামিম ইকবাল টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরির পাশাপাশি তুলে নিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি (২০৬)। ইমরুল কায়েস ডাবল সেঞ্চুরি পাননি। ১৫০ রানের তাঁর অনবদ্য ইনিংস খেলে তিনিও এই ম্যাচ বাঁচানোর লড়াইয়ে শামিল আরেক বীর সেনানী হিসেবেই।
দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৬ উইকেটে ৫৫৫। এটাও নতুন দিনের পরিণত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। এর আগে আর কখনোই দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ শতাধিক রানের রেকর্ড ছিল না বাংলাদেশের। শুধু রান কিংবা নিরেট পরিসংখ্যানে মজে থাকার কিছু নেই। পরিণত হওয়ার প্রমাণ সেশন-বাই সেশন ব্যাটিংয়েও। দুদিন ধরে প্রায় পাঁচ সেশন ধরে ব্যাটিং করে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুরোপুরিই প্রস্তুত আজকের এই বাংলাদেশ। সেটিও পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে প্রায় ১৬৯ ওভার বোলিং-ফিল্ডিং করার ক্লান্তি আর ধকল সামলেই।
চতুর্থ দিন শেষে স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের বিনা উইকেটে ২৭৩ রান দেখে নাকি খুব অবাক হয়েছিলেন পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। গতকাল দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে এসে আসাদ শফিক সেটা স্বীকারও করেছেন। নিজেদের বোলিংয়ের ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা না করে সোজা সাপটাই কৃতিত্বটা তিনি দিয়েছিলেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু টীকা হিসেবে প্রত্যয় জানিয়ে এসেছিলেন আজ পঞ্চম দিনে নতুন করে শুরু করার। বলেছিলেন পঞ্চম দিনে একটি-দুটি উইকেটই খেলার লাগাম নিয়ে আসবে পাকিস্তানের হাতে।
পাকিস্তানের সেই আশার গুড়ে বালি মিশিয়েই আজ বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল গতকালকেরই বর্ধিত রূপ মাত্র। ২৭৩ রানের জুটিটা তরতর করে পৌঁছে গেল ৩১২ রানে। রেকর্ড বইয়েও আলোড়ন এলো। তামিম-ইমরুলের এই যুগল-সংগ্রহ টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেই দ্বিতীয় ইনিংসে উদ্বোধনী জুটির সর্বোচ্চ। সকালের দিকে ইমরুল বেশিক্ষণ টেকেননি। ১৫০ রানে জুলফিকার বাবরের বলে অতিরিক্ত ফিল্ডার বাবর আজমের হাতে ধরা পড়েন তিনি। টেকেননি মুমিনুল হকও। ২১ রান করে জুনায়েদ খানের বলে বোল্ড হন প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের মালিক। কিন্তু অপর প্রান্তে নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন তামিম। টুক-টুক ব্যাটিং নয়। আত্মপ্রত্যয়ী ঢংয়ে নিজের খেলাটাই খেলে গেছেন। নিজের ডাবল সেঞ্চুরিটা তামিম পূরণ করেছেন মারকুটে মেজাজেই। ১৮২ থেকে ইয়াসির শাহকে পরপর দুটি ছক্কা মেরে তিনি পৌঁছান ১৯৪-তে। এরপর ডাবল সেঞ্চুরিটা তামিম পূরণ করেন জুনায়েদ খানকে বিশাল এক ছক্কা মেরেই। এক সময় হয়ে মুশফিকুর রহিমকে টপকে হয়ে যান টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংসের মালিক। বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডের সর্বোচ্চ ইনিংসটাও তাঁর।
তামিম ডাবল সেঞ্চুরি পূরণ করে থাকতে পারেননি বেশিক্ষণ। ২০৬ রানেই শেষ হয় তাঁর বীরত্বগাথা। অসম্ভব সংযম আর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ইনিংসটি সাজিয়ে একটু বেশিই মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর খেসারতটা তিনি দিয়েছেন মোহাম্মদ হাফিজের বলে সরফরাজ আহমেদের হাতে স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়ে। তামিম আউট হয়ে যাওয়ার পর দিনের দ্বিতীয় সেশনটা পার করে দেন মাহমুদউল্লাহ আর সাকিব আল হাসান। নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন ৬৪ রানের জুটি। মাহমুদউল্লাহ ফেরেন ব্যক্তিগত ৪০ রানে। চোট নিয়ে ব্যাট করতে নামা মুশফিক ফেরেন রানের খাতা না খুলেই।
এর পরের সময়টা সাকিবের সঙ্গী হন সৌম্য সরকার। সৌম্য সরকার নিজেকে টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত করার ভালো সুযোগই আজ পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত খাতায় ৩৩ রান তুলেই অবশ্য থেমে যান তিনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম ইনিংসেও ৩৩ রানে ফিরেছিলেন বাংলাদেশের এই তরুণ-তুর্কি।
সাকিব শেষ অবধি অপরাজিত ছিলেন ৭৬ রানে। এই সিরিজে কিছুটা নিষ্প্রভ সাকিব শেষ বেলায় নিজের জাতটি কিন্তু ঠিকই চিনিয়েছেন। এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে দলের গৌরবময় ড্র নিশ্চিত হয় তাঁর ব্যাটেই। তামিম চেয়েছিলেন সাকিব সেঞ্চুরিটা করেই ফিরুন। ড্রেসিংরুম থেকে সে রকম ইশারাও করেছিলেন। কিন্তু সাকিব ততক্ষণে গ্লাভস খুলে মিসবাহর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। এই ম্যাচে পাকিস্তানকে যথেষ্ট যন্ত্রণাবিদ্ধ করা গেছে। মিরপুরে সিরিজের শেষ টেস্টও তো পড়েই রইল।
ম্যাচের স্কোরকার্ডে লেখা থাকবে ড্র। ম্যাচটা ‘ড্র’-ই। কিন্তু টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের চার নম্বর দলের সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়াই করে ড্র-টা জয়েরই সমান। অন্তত মানসিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই ম্যাচে বিজয়ী বাংলাদেশ। ওয়াহাব রিয়াজকে যেন সেটাই বোঝাচ্ছিলেন সাকিব!

No comments

Powered by Blogger.