শাড়ি-চুড়ির জয় হোক by উম্মে মুসলিমা

পুলিশের জন্য শাড়ি–চুড়ি নিয়ে থানা ঘেরাও
নববর্ষের প্রথম দিনে টিএসসি চত্বরে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা পুলিশের উদ্দেশে শাড়ি-চুড়ি নিয়ে শাহবাগ থানা ঘেরাও করেন। সংবাদটি প্রচারমাধ্যমে গুরুত্ব পায়। ফেসবুকে ঘটনাটি নিয়ে অনেকে রসিকতা করেন। একজন বলছেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, ইলা মিত্ররা শাড়ি পরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি? ভাষা আন্দোলন-মুক্তিসংগ্রামে তো শাড়ি পরা নারীদেরই আমরা দেখেছি। তাহলে শাড়ি-চুড়িকে দুর্বলের প্রতীক ভাবার কী আছে? অন্যজন আবার বলছেন, নারীর শাড়ি-চুড়িতে যদি দুর্বলতা প্রকাশিত নাই হবে, তবে এসব শাড়ি-চুড়ির প্রতীকও দুর্বলতা প্রতিপাদন করতে পারত না।
চুড়ি বা টিপের উৎপত্তি নিয়ে অনেক কাহিনি আছে। পুরাণমতে, যুদ্ধে জয়ী পুরুষেরা পরাজিত পক্ষের নারীদের হাতকড়া পরিয়ে নিজেদের ক্ষতস্থানের রক্ত সিঁথি-কপালে এঁকে দিয়ে বিয়ে করতেন। সেই থেকেই চুড়ি ও টিপের আগমন। তবে চুড়ি শুধু ভারত উপমহাদেশের নারীরাই পরেন না, বিশ্বের অনেক দেশেই তা অলংকার হিসেবে জনপ্রিয়। পুরুষেরাও পরে থাকেন। শিখ পুরুষেরা তো হাতে বালা পরাকে ধর্মীয় জ্ঞান করেন। নারীবাদীরা অনেকেই চুড়ি পরার বিপক্ষে। চুড়িকে তাঁরা শৃঙ্খলের প্রতীক ভাবেন। কিন্তু বেশির ভাগ নারীবাদী নারীকেই কপালে টিপ দিতে দেখা যায়, শাড়িকে বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ মান্য করে অঙ্গে ধারণ করেন। কিন্তু ঘরে-বাইরে কাজ করার সুবিধার্থে এখন নারীরা কোনো উৎসব-পার্বণ ছাড়া শাড়ি পরতে চান না। কিন্তু বাঙালি নারীর শাড়ির প্রতি ভালোবাসা একটুও ম্লান হয় না। শাড়ি বিনে সৌন্দর্যও তেমন খেলে না। শাড়ির সঙ্গে দুই গাছি চুড়ি হলে সোনায় সোহাগা। এ মুগ্ধতা আসলে এ দেশের মানুষের আবহমানকালের লালিত সৌন্দর্যচেতনাকে পরম্পরা দান করে আসছে। অন্য কোনো দেশের লোকের চোখে তা সুন্দর প্রতিভাত না-ও হতে পারে। যাঁরা সেদিন পুলিশকে শাড়ি-চুড়ি উপহার দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাঁরাও কেউ শাড়ি পরিহিত হিসেবে দৃশ্যমান হননি। তাতে কী? তাঁরা যদি শাড়িকে কর্মানুপযোগী পোশাক বিবেচনা করেন, তাহলে যাঁদের শাড়ি উপহার দেওয়া হচ্ছিল, তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া যে তাঁরা বিয়ের কনে হয়েই বসে থাকুন। তাই এ উপহারে দোষের কিছু নেই।
শাড়ি-চুড়ি নারীর প্রতীক হয়ে থাকলে তা-ও গৌরবেরই স্বাক্ষর বহন করে। শাড়ি-চুড়ি উপহার দেওয়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এসব পরে নারীর মতো মমতাময়ী, কোমলপ্রাণা, মর্যাদাবান ও নারীবাদী হও। নারীর মতো সমানাধিকারে সমৃদ্ধ হও। দেশ পরিচালনাকারী শাড়ি-চুড়ি পরা প্রধান নেতৃত্বের মতো সাহসী হও।
কবি বলেন, ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার’। কজন বাঙালি নারীর সোনার হাত? কজনের হাতে সোনার কাঁকন? কত দিন সেই সোনার হাত কবিতার উপমায় বহাল তবিয়তে থাকে? তামার হাত, লোহার হাত বলে কি তারা কাঁকনচুড়ি পরবেন না? কিষানি, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, নির্মাণশ্রমিক, গৃহকর্মে সুনিপুণ নারী কার হাতে চুড়ি নেই? গ্রামগঞ্জে এখনো এয়োতিদের হাতে চুড়ি না থাকলে স্বামীর অমঙ্গলের আশঙ্কা করা হয়।
২০১১ সালের পরিসংখ্যানে বিবিএস উল্লেখ করেছে, দেশের বিবাহিত নারীর ৮৭ শতাংশই স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনো সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১২ সালে যৌতুকের কারণে ২৭০ জন নারী নিহত হন। আর যৌতুকের জন্য স্ত্রী পরিত্যাগের ঘটনা তো এ দেশে বেশুমার। তাহলে যে পরনির্ভরশীল নারীকে সন্তানসহ স্বামী পরিত্যাগ করেন, যাঁরা নিরুপায় হয়ে মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়-অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ, তাঁদের কর্মঠ, শ্রীহীন রুগ্ণ হাতেও কেন সস্তা চুড়ি দেখি? কারণ, চুড়ি তখনো নারীরই প্রতীক। কারণ, সে নারী নিজেকে নারী বলতে লজ্জাবোধ করেন না। ঠক-জোচ্চোর পুরুষের নিরলংকার আগ্রাসী হাত থেকে নিজেকে আলাদা করার প্রতিবাদ চুড়ি। চুড়ি যদি সেই সংগ্রামী নারীর প্রতীক হয়, তাহলে নির্মম চুড়িহীনদের তা উপহার দেওয়া মানে উচিত শিক্ষা দেওয়া।
নারীর সম–অধিকারের আকাঙ্ক্ষা মানে নারীর পুরুষ হতে চাওয়া নয় বা পুরুষতান্ত্রিকতাকেও প্রকারান্তরে সমর্থন করা নয়। পুরুষের সর্বনামে নারীর স্বীকৃতি দাবিও নিরর্থক। এতে পুরুষ জন্মই প্রার্থিত বলে প্রতিপন্ন হয়। এ যেন সন্তানেরা মাকে ‘মা’ না ডেকে ‘বাবা’ ডাকার নামান্তর। বরং পুরুষ যেসব সুযোগ-সুবিধা-অধিকার ভোগ করেন, সেগুলোই সমানভাবে চাওয়া নারীর আন্দোলনের মূলকথা। উপরন্তু নারীর শারীরিক গঠন ও পরিবর্তনে সহায়ক নীতি ও বাস্তব সুবিধাদি পুরুষের প্রাপ্ত সুবিধার তুলনায় একটু আলাদা ও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
শাড়ি-চুড়ি-টিপ কবে কীভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তা গবেষণায় এনে ভালোমন্দ বিচার-বিশে­ষণ করে আমূল উপড়ে ফেলার আন্দোলনের চেয়ে আরও জরুরি কাজ আমাদের রয়েছে। শাড়ির শিল্পগুণ ও সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। মসলিন-জামদানির দেশ হিসেবে আমরা পৃথিবী বিখ্যাত। বিলুপ্ত নগরসভ্যতাসমূহের উদ্ধারকৃত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে কাঠ-মাটি-ধাতুর তৈরি মালা, কর্ণাভরণ, বালা বা অন্যান্য অলংকারের দেখা মেলে। এসব থেকে সে সময়ের মানুষের শিক্ষা, শিল্পবোধ, কৃষ্টি ও সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের তাঁত ও অলংকারশিল্প আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখুক, একই সঙ্গে আমাদের নারী বলে চিনতে সহায়তা করুক। কারণ, নারী মানে আজ আর মুখ বুজে মার খাওয়া নয়, নারী মানে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। তাই কেবল পুলিশ নয়, যারাই মানবতার বিপক্ষে তাদের সবাইকে শাড়ি-চুড়িতে সাদর আমন্ত্রণ।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.