বিরোধী প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশের হানা by কাফি কামাল ও কাজী সুমন

পুলিশি হয়রানির কারণে নির্বাচনী এলাকায় ভিড়তে পারছেন না ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটির বিরোধী জোটের সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থীরা। মেয়র প্রার্থীদের মতো সাবেক কাউন্সিলররাও সবাই আত্মগোপনে। মনোনয়নপত্র জমা দিলেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে তারা প্রকাশ্যে আসছেন না। একই অবস্থা বিএনপিসহ ২০ দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নতুন প্রার্থীদেরও। মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর থেকে তাদের বাসা-বাড়িতে দফায় দফায় হানা দিচ্ছে পুলিশ। কখনও তাদের অবস্থান, কখনও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য তথ্য জানাতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের ওপর। প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার জন্য দেয়া হচ্ছে গ্রেপ্তারের হুমকি। খোঁজ নেয়া হচ্ছে এলাকায় ওইসব প্রার্থীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের ব্যাপারেও। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩০শে মার্চ রাতেই রাজধানীর অন্তত ২০ জন বিএনপি সমর্থক কমিশনার প্রার্থীর বাসায় হানা দিয়েছে পুলিশ। এদিকে মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, মঙ্গলবার রাতেই সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মামলার তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ওদিকে নির্বাচন কমিশনার গাজী শাহনেওয়াজ বলেছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে কাউকে গ্রেপ্তার করতে কমিশনের অনুমতি লাগবে না। ফলে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে পারছেন না তারা। এছাড়া পুলিশি হয়রানির কারণে মনোনয়নপত্র কিনেও জমা দিতে পারেননি অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী। জমা দেয়ার দিনেও কেড়ে নেয়া হয় অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন ফরম। তফসিল ঘোষণার ১৩ দিন পরও রাজধানীর কোন এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা যায়নি বিরোধী জোটের সমর্থন প্রত্যাশীদের। এদিকে সরকারদলীয় প্রার্থীদের রঙিন পোস্টার-ব্যানারে সয়লাব রাজধানীর প্রতিটি এলাকা। কিন্তু রাজধানীর কোথাও চোখে পড়েনি বিরোধী সমর্থকদের একটি ব্যানার-পোস্টার। এমনকি গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরোয়া বৈঠকও করতে পারছেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ২০ দলের সমর্থন প্রত্যাশীরা। বিশেষ করে মামলার আসামিদের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ঘোষণার পর আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা। বিরোধী জোটের সমর্থন প্রত্যাশী একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী জানান, কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের প্রায় সব নেতার নামেই রয়েছে একাধিক মামলা। গ্রেপ্তারের ভয়ে এক এলাকার নেতা থাকছেন অন্য এলাকায়। বিকল্প পদ্ধতিতে করছেন যোগাযোগ। পাড়ায়-মহল্লায়, দোকানপাটে ভোটের আলোচনায়ও নীরবে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি সমর্থকরা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এই পরিবেশ বজায় থাকলে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর দুই সিটির ৯৩টি ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বিএনপি সমর্থিত প্রায় তিন শতাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে সংরক্ষিত আসনের মহিলা প্রার্থীরাও রয়েছেন। পুলিশি হয়রানি থেকে তারাও বাদ যাচ্ছেন না।
বাসায় ও মহল্লায় অভিযান
ঢাকা দক্ষিণের ৬নং (সাবেক ২৯) ওয়ার্ড বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী ও ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য এবং ওই ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার শামসুল হুদা বলেন, সোমবার রাতে মুগদা-মান্ডা এলাকায় পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে যৌথবাহিনী অভিযান চালায়। অভিযানের খবর শুনেই দলের নেতাকর্মী সবাই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। কারণ বিএনপির প্রত্যেক নেতাকর্মীর নামেই মামলা রয়েছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি কার্যক্রমের জন্য কোন কর্মীই পাচ্ছি না। আর কর্মী ছাড়া তো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ওদিকে ঢাকা দক্ষিণ ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ মোহন। তিনি বলেন, নগর বিএনপির রাজনীতি ও সাবেক কমিশনার হিসেবে সব সময় পুলিশি হয়রানির মধ্যেই আছি। দীর্ঘদিন ধরে বাসায় যেতে পারি না। চলমান আন্দোলন ও সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই বাসায় ও আশপাশে নজরদারি করছে পুলিশ। বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের ভয়-ভীতির দেখানো হচ্ছে। কর্মী-সমর্থকরা তো আতঙ্কের কারণে এলাকাছাড়া হয়ে আছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ ১৮ (নতুন) ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোয়নপত্র জমা দিয়েছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কে এম জোবায়ের এজাজ। তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র সংগ্রহের দিনই পুলিশ আমার সেন্ট্রাল রোডের বাসায় একদফা অভিযান চালায়। এরপর দুইদিন বাসায় এসে আমার খোঁজখবর নিয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যরা আমার বাসায় নজরদারি করছে। তিনি বলেন, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে আমার বিরুদ্ধে ৪টি মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রাথমিক কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে আত্মগোপনে থেকে। এমনকি আমাদের দলের লোকজন গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরোয়া বৈঠক পর্যন্ত করতে পারছে না। তিনি আশা করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি বিজয়ী হবেন। ঢাকা দক্ষিণ ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-শিল্প বিষয়ক সম্পাদক তারেক জামাল। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা না থাকলেও সক্রিয় রাজনীতির কারণে সবসময় একটি আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়ার পর পুলিশ ২৯ ও ৩০শে মার্চ দুইদিন পুলিশ আমার বাসায় গিয়ে নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। জামাল বলেন, পুলিশ খোঁজখবর নেয়ার পর পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, মামলা না থাকলেও নিরাপদ অবস্থানে থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। এখন নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ও বিএনপির সর্বশেষ নির্বাচনী অবস্থানের জন্য অপেক্ষা করছি। ওদিকে ঢাকা মহানগর ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মামুনুর রশিদ আখন্দ ঢাকা দক্ষিণ ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মামুন জানান, চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৫ই জানুয়ারির আগেই তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেসব মামলায় তিনি জামিনে আছেন। কিন্তু ৫ই জানুয়ারির পর অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি নতুন মামলা হয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সেসব মামলায় জামিন নিতে পারেননি। তিনি জানান, খিলগাঁও থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি থাকার কারণে আগে থেকেই তার বাসায় প্রায় পুলিশ হানা দেয়। কিছুদিন ধরে সেটা বন্ধ ছিল। তবে সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়ার পর ২৯শে মার্চ বাসায় ফের খোঁজখবর নিয়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এমন ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন, কৌশলী প্রচারণাও চালানো যাচ্ছে না। ঢাকা দক্ষিণ ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন সাবেক কমিশনার হারুণ-অর রশিদ হারুণ। তিনি বলেন,  দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় যেতে পারছি না। পল্টনে আমার বাসায় প্রায়ই পুলিশ গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। তবে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে- এলাকায় আমার যেসব কর্মী-সমর্থক রয়েছে তাদের দেখলেই সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা পুলিশকে খবর দিচ্ছে। পুলিশ তাদের বাসাবাড়িতেও হানা দিচ্ছে। ওদিকে মনোনয়ন কেনার পর পুলিশ তল্লাশি চালায় ১৩ নং ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুর রবের বাসায়। তার নিকট আত্মীয় আবদুল কাদির জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আবদুর রব মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে। এরপর শনিবার সন্ধ্যায় তার পুরানা পল্টনের বাসায় যায় পুলিশ। প্রথমে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয় তারা। এরপর বাসার ভেতরে ঢুকে হুমকি ধমকি দিয়ে বলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থানায় হাজির না হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে। নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতেই পুলিশ এই ধরনের হুমকি দিয়েছে বলে জানান তিনি। গত রোববার রাতে ঢাকা দক্ষিণের ৪নং ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মোরসালিনের বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। তিনি জানান, রোববার কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর রাতে আমার বাসাবোর বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। তবে ওই সময় আমি বাসায় ছিলাম না। ওদিকে ঢাকা উত্তর ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির পল্লী উন্নয়ন সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ ইউসুফ।  হাজী ইউসুফ জানান, চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ তিন মাস ধরে বাসায় যেতে পারছি না। আত্মগোপনে থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছি। এ সময় আমার বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমাকে না পেয়ে আড়াই মাস আগে আমার ভাতিজা যুবদল নেতা শাহ মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুইদিন নিখোঁজ থাকার পর পুলিশ একাধিক মামলায় জড়িয়ে তাকে আদালতে পাঠায়। এখন পর্যন্ত সে কারাগারে। তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর ২৯ ও ৩০শে মার্চ দুইদিন রায়েরবাজার গদিঘর শেরেবাংলা রোডে আমার বাসায় খোঁজ নিয়েছে পুলিশ। আমার অবস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের কাছে নানা তথ্য জানতে চেয়েছে। আমার মোবাইলে ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছে। এছাড়া কয়েকদিন ধরে আমার বাসার সামনে মাইক্রোবাসে করে কিছু লোক অবস্থান করছে। ফলে কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও এলাকায় যেতে পারছি না। একই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সমবায় সম্পাদক আনোয়ার হোসেন লাল্টু। তিনি জানান, আন্দোলন শুরুর পর থেকে বাসা-বাড়িতে থাকতে পারছি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হয়রানির মধ্যে রেখেছে। সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর সেটা আরও বেড়েছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী প্রার্থী ও ধানমন্ডি থানা বিএনপির সভাপতি আবুল খায়ের বাবলু বলেন, মনোনয়নপত্র কেনার পরপরই ধানমন্ডি এলাকার এমপি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আমাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ নেন এমপি। এরপর থেকে আমি গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। এমন কি দলের কর্মীদের নামের অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণের ২০নং ওয়ার্ডের বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী ও শাহবাগ থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আমীর হোসেন সোহেল বলেন, বিএনপি নেতাকর্মী কেউ এলাকায় অবাধ চলাফেরা করতে পারছি না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে সবাই এলাকাছাড়া। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন থানায় রাজনৈতিক পেন্ডিং মামলা রয়েছে। আটকের পর ওইসব মামলায় ফের গ্রেপ্তার করা হতে পারে- এমন আতঙ্কে রয়েছেন সবাই। এই ভয়ে এলাকায় ফিরতে পারছি না। বাসা সেগুনবাগিচা হলেও থাকতে হচ্ছে অন্য এলাকায়। তবে কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, দলের মহিলা কর্মীদের এলাকার বাসায় বাসায় পাঠাচ্ছি। তারা এমনভাবে যাচ্ছেন যাতে কেউ বুঝতে না পারে। ঢাকা উত্তরের ৮নং ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ফেরদৌসী আহমেদ মিষ্টি জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এলাকা ছাড়া। তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ইতিমধ্যে এলাকায় বিভিন্ন কায়দায় গণসংযোগ, সভা-সেমিনার শুরু করে দিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া প্রার্থনা করছেন। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কর্মীরাও মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, সোমবার রাতে রাজধানীর মানিকনগরের ৭নং ওয়ার্ড এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে রাতেই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঢাকা উত্তরের ৩০নং ওয়ার্ড বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান,  এই ওয়ার্ডে তিন জন মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন। পুলিশি হয়রানির কারণে তারা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। ওই ওয়ার্ডে বিরোধী জোটের সমর্থন প্রত্যাশী দুই কাউন্সিলর প্রার্থী আদাবর থানা বিএনপির সভাপতি হাজী আবুল হাশেম ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হাজী নাসিরউদ্দিন দুইজনই আত্মগোপনে। কিন্তু প্রতিদিনই তাদের বাসাবাড়িতে পুলিশ যাচ্ছে।
মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি অনেকেই
এদিকে পুলিশের হয়রানির শিকার হয়ে মনোনয়নপত্র কিনেও জমা দিতে পারেননি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনভীর আদেল খান বাবু। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি ১৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র কিনেছিলাম। কিন্তু পুলিশের হয়রানির কারণে তা জমা দিতে পারিনি। গত শনিবার নির্বাচন কমিশনের লোক পরিচয়ে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে বেশ ক’জন আমার বাসায় গিয়েছিল। তারা আমার বাসার নিরাপত্তারক্ষীর কাছে একটা ফরম দিয়ে গেছে। সেটা পূরণ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়ার কথা বলে গেছে। এরপর হয়রানির ভয়ে আমি মনোনয়নপত্র জমা দেইনি। তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে প্রায় ৪০টির মতো রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেও কয়েক দফা কারাবরণ করতে হয়েছে। এখনও প্রায়ই বাসায় পুলিশ আসে। এই পরিস্থিতি বজায় থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নির্বাচনের প্রাথমিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে বিএনপি। একক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী সমর্থন চূড়ান্ত করতে কাজ করছে বিএনপির একটি টিম। দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির কয়েকজন নেতাকে এ ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা বিরোধী জোটের সমর্থন প্রত্যাশী সম্ভাব্য সকল প্রার্থীর ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করছেন। এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, তৃণমূল নেতাদের মতামত সংগ্রহ ও বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার পর বিএনপি সমর্থনের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। যথাসময়ে তৃণমূলের তরফে সেসব প্রার্থীর সমর্থনও ঘোষণা করা হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩০নং নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নীরব হোসেন অভিযোগ করেন, গত রোববার উত্তর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে বেছে বেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র নেয়া হয়েছে। অনেক কাকুতি-মিনতি করার পরও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র নেয়া হয়নি। মোবাইলে ওই ঘটনার ভিডিওচিত্র ধারণ করা আছে। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিনে  ৫৭ নং ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী হাজী মনির হোসেনের মনোনয়নপত্র ও পে-অর্ডার ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। মনির হোসেন অভিযোগ করেন, রোববার বিকালে মনোনয়নপত্র জমা দিতে মহানগর নাট্যমঞ্চে যান আমার কয়েকজন প্রতিনিধি। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল ৫৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সাঈদুল মাতবর ও তার সঙ্গীরা। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে আমার পক্ষ থেকে থানা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি খন্দকার আবুল কালাম আজাদ মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে সাইদুল মাতবর নিজে তার লোকজন নিয়ে মনোনয়নপত্রের ফাইলটি নিয়ে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে  দেয় এবং ৩০ হাজার টাকার পে-অর্ডারটা নিয়ে যায়। এই কারণে আমার মনোনয়নপত্র আর জমা দেয়া হয়নি। ওদিকে ঢাকা দক্ষিণের ৩৮নং ওয়ার্ডের বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী ও জাসাস ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনে গণসংযোগ করার সুযোগ পাবো কিনা এখনও বুঝতে পারছি না। ক্ষমতাসীনরা তো বাধা দেবেই। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই মাঠে নামতে হবে আমাদের। আপাতত একটু সাবধানে থাকতে হচ্ছে।  ৩৫নং ওয়ার্ডের (সাবেক ৫৪) বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থী শর্মিলা ইমাম বলেন, আমি চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। রাজধানীসহ দেশব্যাপী ২০ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এখন সরকারের উচিত নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা। এ ব্যাপারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রেখেছে পুলিশ। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালা মেরে রেখেছে তারা। এর মধ্যে আমরা কিভাবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য কাজ করবো। দলের পক্ষ থেকে কোন মনিটরিং সেল তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। দাপ্তরিক কাজও করা যাচ্ছে না। যার কারণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত কতজন কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েছেন আর জমা দিয়েছেন- এই তথ্য আমাদের কাছেও নেই। নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে সমর্থকরাও এখন আতঙ্কে এলাকা ছাড়া। সেখানে কাউন্সিলর প্রার্থীরা কি অবস্থায় রয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

No comments

Powered by Blogger.