টাকা থাকলে দেখিয়ে দিতেন পুতিন by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া

পর্যাপ্ত অর্থকড়ি থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মজাটা টের পাইয়ে দিতেন পুতিন। বিশ্বে এখন তেজ দেখানোর মতো হাতেগোনা যে কজন নেতা আছেন, তার মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একজন। যুক্তরাষ্ট্র যত প্রভাবশালী দেশই হোক না কেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। চলতে হয় পশ্চিমা মিত্রদের সহযোগিতা নিয়ে। এদিক দিয়ে বলতে গেলে পুতিন একাই এক শ। তিনি শুধু একলা সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন না। একা লড়ে দেখান। তবে লড়ার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সেখানে পুতিন এখন বেশ বেকায়দায় আছেন।  দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পুতিন বাইরের দিকে নজর দেন। বেশ দাপটের সঙ্গে ক্রিমিয়া দখল করে নেন। সেখানে এখন রাশিয়ার শ খানেক সেনা ইউনিট রয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর ভাষ্যমতে, কৃষ্ণসাগরের ওই ভূখণ্ডে রাশিয়ার এখন এমন সেনাশক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, যার বলে তারা কেবল ওই দ্বীপেরই দখল বজায় রাখবে না, প্রয়োজনে সাগরে গিয়েও শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবে।
২০১৪ সালের মার্চে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। এটি দখল করার পর গত এক বছরে কৃষ্ণ সাগর এলাকায় নিজের অবস্থান বেশ মজবুত করেছে দেশটি। এ বছর ক্রিমিয়া দখলের প্রথম বর্ষপূর্তিতে পুতিন বলেছেন, ওই ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে প্রস্তুত তিনি। পুতিন বলেন, ‘সেখানে রাশিয়ার লোকজন বাস করে। তাদের অবহেলায় ফেলে রাখতে পারি না।’
বর্তমানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা প্রতিপক্ষের সঙ্গে রাশিয়ার রশি টানাটানি চলছে, তার মধ্যে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইউক্রেন সমস্যা। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে-এমন ধুয়া তুলে ইসরায়েল সেখানে হামলা চালানোর জন্য এক পায়ে খাড়া। কিন্তু সমঝোতার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র এতে সায় দিচ্ছে না। এখানেও নেপথ্যে পুতিন। কারণ ইরানে হামলা চালানোর উদ্যোগ নিলে দেশটির আদি ও অকৃত্রিম মিত্র রাশিয়া ছেড়ে দেবে না। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সম্প্রতি সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনা কোনো তফাত নেই। সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলে রাশিয়ার নৌঘাঁটি পরিচালনার বিষয়টি সেটাই প্রমাণ করে।
ইউক্রেন সংকট সমাধানে গত ফেব্রুয়ারিতে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পেরোশেঙ্কোর মধ্যে যদিও যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, তবে বারুদ আবার জ্বলে উঠতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। ইউক্রেন পশ্চিমাদের জন্য একটি কৌশলগত অবস্থান। দেশটিতে রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার জাঁতাকলে আটকে গেছে রাশিয়ার বেশ কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার বেশ কিছু কূটনীতিক ও নেতা ইইউর আওতাভুক্ত কোনো দেশে যেতে পারছেন না। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো ইউরোপ থেকে দীর্ঘ মেয়াদি কোনো ঋণ নিতে পারছে না। ইউরোপের অনেক দেশে রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে।
ঘটনা এখানেই থেমে নেই। পশ্চিমা দেশগুলো এখন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইউক্রেনে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়েছে। সম্প্রতি হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ধনকুবের জর্জ সরোস বলেছেন, পশ্চিমা শক্তি সমর্থন জোগালে ইউক্রেনে তিনি ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে রাজি। এমন আরও অনেক ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ইউক্রেনে বিনিয়োগে আগ্রহী। তবে ইউক্রেনের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় রাশিয়ার ভারী অস্ত্র মজুতের গতি থেমে নেই। এতে লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়ার মতো দেশগুলোতে আগ্রাসন-আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইইউর দেশগুলো তাদের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে বাণিজ্যের নামে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পুতিনের ভূমিকা কী হতে পারে?
বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো কোনো পরিস্থিতিতে মাথা নত করেননি। এ ক্ষেত্রে করবেন না বলেই সবার বিশ্বাস। তবে তাঁর পথচলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে অর্থ-সংকটসহ অভ্যন্তরীণ কিছু জটিল সমস্যা। এর মধ্যে বেকারত্ব ও জঙ্গিবাদ রয়েছে। পুতিন ইতিমধ্যে তিন হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমমূল্যের সংকট-মোচন ব্যয়ের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান কোত্থেকে হবে, এটা তিনি নিজেও জানেন না। রাশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যতম বড় শক্তি তেল ও গ্যাস রপ্তানি। পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞার কারণে এর মধ্যে এতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাশিয়ার সামরিক শক্তি যতই থাকুক, এর পেছনে ব্যয়ও রয়েছে বিপুল। অর্থনৈতিক মন্দা সামরিক ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রাশিয়ার ইদানীং দুর্নীতিও খুব বেড়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৪ সালের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ১৭৪টি দেশের মধ্যে রাশিয়া অবস্থান ১৩৬ তম। এটিও রাশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
রাশিয়ায় বেকারত্ব বাড়ছে। একই সঙ্গে কমছে মানবসম্পদ। পুতিনের সামাজিক দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে এক লাখ ৮৬ হাজারের বেশি রুশ নাগরিক দেশ ছেড়েছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। জন্মহার কমে যাওয়াও মানবসম্পদ কমে যাওয়ার একটি কারণ। রাশিয়ায় ইসলামপন্থী জঙ্গিদের তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। রাশিয়ার কূটনীতিকদের তথ্যমতে, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের সঙ্গে প্রায় ৮০০ রুশ নাগরিক যোগ দিয়েছে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক নিরাপত্তা সংস্থা সাউফান গ্রুপের তথ্যমতে, হাজার দুয়েক রুশ আইএসে যোগ দিয়েছে। চেচেন আইএস এর মধ্যে ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে রাশিয়ার সরকারকে হুমকি দিয়েছে। দেশের ভেতর ও বাইরে এসব নানা সমস্যা এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে পুতিনকে। লোকবল ও প্রয়োজনীয় শক্তির কমতি নেই পুতিনের। নেই কেবল অর্থবল। বিশ্লেষকদের মতে, সে রকম অর্থ থাকলে কৃষ্ণসাগরে কেবল জাঁকাল সামরিক মহড়া দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না তিনি, হয়তো শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে নিজ ক্ষমতা দেখিয়েও দিতেন।

No comments

Powered by Blogger.