এশিয়ায় গণতন্ত্রের বিচার by ইউরিকো কোইকি

বাংলাদেশ সরকার ও বিচার
এশিয়ার ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রের পরীক্ষার সময় এটা। আক্ষরিক অর্থে এ পরীক্ষা হচ্ছে আদালতে। এ অঞ্চলে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন অথবা হতে যাচ্ছেন এমন জাতীয় বড় বড় দলের নেতাদের তালিকা ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তাতে এটা ভাবা যুক্তিসঙ্গত যে, এ দেশগুলোতে আদতে গণতন্ত্রই টিকে থাকবে কিনা!  সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে হত্যার অভিযোগ। এক বছরেরও কম সময় আগে ক্ষমতা হারিয়েছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে প্রকিসিউশন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তার সরকারের অধীনে কয়লাখনি প্রকল্প বেসরকারি খাতে দেয়া নিয়ে ওই অভিযোগ। থাইল্যান্ডে গণতান্ত্রিকভাবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ইংলাক শিনাওয়াত্রা। কিন্তু একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। ধান বা চাল সংগ্রহ খাতে ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি এ অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলাৎকারের। ১৯৫৮ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে মালয়েশিয়া। তার পর প্রথমবার ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড মালয়’জ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও)-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে বিরোধীরা। ঠিক তখনই আনোয়ারের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে তাকে ৫ বছরের জন্য জেল দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ৫ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ তিনি। মালয় পার্লামেন্টে পিতার বিরুদ্ধে বিচারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করায় আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়েকে আটক করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। মালয় পার্লামেন্টে ডানপন্থি হিসেবে তিনি নির্বাচিত একজন এমপি। অবশ্যই এসব রাজনৈতিক মামলার প্রতিটির অরিজিন বা উৎস ভিন্ন। এসব মামলার প্রতিটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে এর ভিন্নতার মাপকাঠিতে। প্রশ্ন রয়েছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। প্রতিটি দেশের ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক স্বার্থে এতে কি প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। মনমোহন সিংকে ভারতের প্রসিকিউটররা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এটা হতে পারে সবথেকে বাজে এবং উদ্বেগ সৃষ্টিকারী মামলা। কারণ, ভারতে রয়েছে দৃঢ় গণতন্ত্র। এর বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ঈর্ষণীয়। মনমোহনের অধিকার নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে তার যে সমর্থক আছেন তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এমন হতে পারে তার বিরুদ্ধে মামলাটি হতে পারে বিরোধী দল কংগ্রেসকে কিছুটা অবদমিত করার রাজনৈতিক খেলার অংশ। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিকভাবে এতটাই চতুর যে, তিনি দলীয় সুবিধা অর্জনের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিরুদ্ধে তদন্তে হস্তক্ষেপও করবেন না। দুঃখজনকভাবে সত্য যে, অন্য মামলাগুলোতে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত হওয়ার কোন বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ মুসলিম গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশ। এ দেশটিতে নানা ঐতিহাসিক রেকর্ড আছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা, তাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হতে পারে। সেটা হতে পারে শুধু তখনই, যদি কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে কাজ করার জন্য উদগ্রিব হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে দু’নেত্রীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। তারা কিংবদন্তিতুল্য। দু’জনের প্রত্যেকে  প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দু’জনই আদালতকে ব্যবহার করেছেন প্রতিপক্ষকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য, এর ফলে কি ক্ষতি হতে পারে সেটা দৃশ্যতই চিন্তাভাবনা না করে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগের কারণে এরই মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। যদি প্রকৃতপক্ষে একটি বিচার কার্যক্রম শুরু হয় তাতে ভয়াবহ জন-অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এতে শেখ হাসিনার শাসনের অধীনে দেশটি যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে তা বিপদগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ এমন সরকারি প্রসিকিউটররা এ মামলাটি নিয়ে অগ্রসরমাণ। থাইল্যান্ডে শিনাওয়াত্রার বিচার অত্যাসন্ন। মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে বারবার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তাতে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকবে। থাইল্যান্ডে ইংলাক শিনাওয়াত্রা ও তার ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রা- দুজনই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন থাকসিন শিনাওয়াত্রা। তারা ১৫ বছর থাইল্যান্ডের ক্ষমতায় ছিলেন। তাদের নির্বাচনী ক্ষমতার ইতি ঘটাতে দেশটির জেনারেলরা এবার ইংলাক শিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন- এটা একেবারে পরিষ্কার। ফলে জেনারেলরা ও ব্যাংককের অভিজাত শ্রেণীর মিত্ররা দৃশ্যত এখন সময়টাকে পাল্টে দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইংলাকের বিরুদ্ধে অত্যাসন্ন যে বিচার সেটা একটা সংকেত। সংকেত দেয়া হবে যে, থাকসিনদের জনপ্রিয়তা থাইল্যান্ডের ‘ম্যানেজড’ গণতন্ত্রের কাছে হারিয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে থাকসিনপন্থি শক্তিগুলো নিষ্ক্রিয়। তবে তাতে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্রকে চিরদিনের জন্য সামরিক বাহিনী দমিয়ে রাখতে পারবে বা অধিকার বঞ্চিত রাখতে পারবে- এমনটা কারও  ভাবা উচিত নয়। দুঃখজনক হলো, মালয়েশিয়াও খুব তাড়াতাড়ি একই রকম সহিংস প্রতিবাদের মুখে পড়তে পারে। এতে তাদের অর্থনীতির অবনমন ঘটবে। এই অর্থনৈতিক পতন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাইল্যান্ডকে আঁকড়ে ধরেছে। মালয়েশিয়ার প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার বিচার হওয়া উচিত এমন ধারণাই দিচ্ছে ইউএনএমও। এটা পরিষ্কার যে, এতে বোঝানো হচ্ছে কোন প্রকৃত গণতন্ত্র নেই। যেখানে থাকবে আইনের শাসন। এমন সব প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা কোন নিরপেক্ষ আদালত গ্রহণ করতে পারে না। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘদিনের নেতা লি কুয়ান ইউ এ মাসে মারা গেছেন। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতারা ও এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো মাঝে মাঝেই তাকে অনুসরণের কথা বলেন, যদিও দেশ দুটি লির দেখানো পথে হাঁটে নি। হ্যাঁ, লি যে ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন তাতে তিনি ৩১ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ফৌজদারি আদালত নয়, তিনি ব্যবহার করেছিলেন দেওয়ানি আদালত। এই আদালতের মাধ্যমে তিনি তার বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। পৃষ্ঠপোষকতার উপরে ধী শক্তি এটা নিশ্চিত করেছিলেন লি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। সুশাসনের জন্য দ্রুত সংহতকরণের জন্য এই ফর্মুলাই হলো ভিত্তি। এর অধীনে সম্ভ্রান্তদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে কঠোর মানদণ্ডে সীমিত করে। কারও প্রতিপক্ষকে ফৌজদারি আদালতে তোলা হলে তাতে দৃশ্যত একই রকম ফল বয়ে আনবে না।
ইউরিকো কোইকি
জাপানের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী
ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
(ইউরিকো কোইকি জাপানের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি জাপানের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির জেনারেল কাউন্সিলের চেয়ারওমেন ছিলেন। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল ডায়েট-এর একজন সদস্য)
(অনলাইন প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.