দুধারি তলোয়ার by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ঝুঁকে হাঁটছিল লোকটা, বোঝা যায় বেশ খানিকটা দূর থেকে হেঁটে আসছে, শুধু আমাদের বিল্ডিংটার কাছে এসে একবার থমকে দাঁড়াল, তাকাল ওপর দিকে। আমাদের ছয়তলার বারান্দার দিকেই যে তাকাল সেটা নিশ্চিত। আমি তো জানালার ভেতর থেকে তাকিয়ে আছি, আমাকে দেখতে পায়নি। চেহারায় একটু হতাশা ফুটে উঠল কি না, সেটা এত দূর থেকে বুঝব কী করে? এমনকি এত দূর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দও তো শোনার কথা নয়। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, আবার চোখ নামিয়ে সেই একই রকম মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেল। দীর্ঘদেহী মানুষটার পিঠ থেকে মাথার দিকটা সামনে ঝুঁকে কেমন বাঁকা হয়ে আছে, দেখে হু হু করে ওঠে বুক। মাঝেমধ্যেই এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখি, কোথায় যায়, এদিকে কোথায় যাবে? হয়তো শুধু এই বিল্ডিংটার দিকে, এই বারান্দাটার দিকে একবার তাকাবে বলেই কি আসে, কে জানে?...এত ভালোবাসত আমাকে, এত ভালোবাসত...।
কী রকম?
এসব কি আর উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়, যেমন ধরো আমি বাথরুমে ঢুকছি গোসলের জন্য, বলল, এক মিনিট দাঁড়াও, তারপর সে নিজে ঢুকে আগে শাওয়ারের গরম–ঠান্ডা দুটো ট্যাপই ছেড়ে দিয়ে বারবার হাত দিয়ে পরখ করে দেখত দুই রকম পানি মিলেমিশে কুসুমগরম হলো কি না, নিশ্চিত হয়ে তারপর বলত, এবার যাও। আচ্ছা আমি কি ছোট মেয়ে, আমি কি মিশিয়ে নিতে পারি না? এ রকমই, রান্না করতে গিয়ে কখন এক ফোঁটা গরম তেলের ছিটা লাগল হাতে, ব্যস, আহা-উহু শুরু হয়ে গেল—এটা লাগাও, ওটা লাগাও...পারলে আমার ওই হাতটা সারা দিন ধরেই রাখে হাতে। লোকটা তো পাগল!
ওভাবে বলো না। হয়তো পাগলই...স্বাভাবিক একটা মানুষ এভাবে ভালোবাসতে পারে? আমাদের দোতলা বাড়িটার পেছনে একটা জংলামতো জায়গা ছিল, আমাদের সীমানা দেয়ালের বাইরে, আগাছায় ভর্তি, শুধু শরৎকালে কী করে কাশফুলে ভরে যেত পুরো জংলাটা। আমার সকালটা ভালো হয়ে যেত পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে। ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি...’ আমি তো এক-আধটু গাইতে পারতাম, শরতের নির্মেঘ আকাশ, কখনো থোকা থোকা সাদা মেঘ আকাশজুড়ে, কখনো হালকা নীল দূর দিগন্ত পর্যন্ত, মন ভালো হয়ে যেত। একদিন বলল, এত ভালো লাগে? ব্যস, পরদিন অর্ধেক কাশবন আমার ঘরে। কাকে দিয়ে গোছা গোছা কাশফুলের গাছ কাটিয়ে এনেছে। আমার ঘরে-বারান্দায়, ফুলদানিতে, মাটির মটকায়—সর্বত্র কাশ আর কাশ। কী করে বোঝাই, জংলায় কাশফুল সুন্দর, ঘরে এলে জঞ্জাল,...হালকা নীল আকাশটা তো ধরে বেঁধে ঘরে আনা যায় না...। পারলে সেটাও নিয়ে আসত হয়তো...হা হা হা। আনতই তো। সাদা পাড়ের হালকা নীল একটা মণিপুরী শাড়ি কিনে এনেছিল পরদিন, সে শাড়ি পরে কাশফুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হলো, কত ছবি...।
এসব মিস করো এখন?
মিথ্যা বলব না, করি। ভালোবাসার সঙ্গে একটু পাগলামি না মিশলে ভালোবাসা হয় বলো? জগদ্বিখ্যাত লাভ-ফিকশনগুলো দেখো, সেখানে অনেক অসংগতি, অনেক পাগলামি...সত্যি বলছি মিস করি।
তোমাদের সমস্যাটা শুরু হয়েছিল কখন, কীভাবে?
শুরু তো হয়েছিল শুরু থেকেই। দেশের বাইরে ছিল দীর্ঘদিন, নিউইয়র্কে, ভালো চাকরিও করত। দেশে এসেছিল অল্প কয়েক দিনের জন্য। আমি তখন একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করতাম, সেই ফার্মের চিফ এক্সিকিউটিভ তার পূর্বপরিচিত, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে আমাকে দেখল। দেখে তার মনে হয়েছিল, এই মেয়েটাকেই সে খুঁজছে এত দিন ধরে, যাকে এত দিন ধরে খুঁজছে, কেন সেই মেয়েটা আমিই, তার অনেক কারণ ব্যাখ্যা করেছিল, সেই বিস্তারিত বিবরণে যাব না, শুধু বলি এ রকম একটি মেয়ের সঙ্গে বাকি জীবন কাটানোর সুযোগ পেলে নিউইয়র্কের জীবন ঘোড়ার ঘাস কাটার মতোই অর্থহীন মনে হয়েছিল তার কাছে। ঘোড়ার ঘাস কাটা নেহাত অর্থহীন কাজ না, পৃথিবীতে এই প্রাণীটিকেও বাঁচিয়ে রাখার দরকার আছে, হা হা হা...। ঠাট্টা কোরো না। কয়েক দিনের মধ্যেই আমার বস ঘটকালি শুরু করলেন। আমার প্রায় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এই প্রস্তাবকে দুর্লভ মনে করেছিল, আর এমন স্মার্ট দীর্ঘদেহী সুদর্শন মানুষটাকে আমারও ভালো না লাগার কোনো কারণ তো ছিল না। বিয়ে হয়ে গেল।
শুরুর কথাটা কী যেন বলছিলে?
হ্যাঁ, শুরু থেকেই সন্দেহ করতে শুরু করল আমাকে। প্রথম তিরটা আমার বসের দিকে, অথচ তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে তিনিই আমার বিয়ের যাবতীয় দূতিয়ালি করলেন। বলল, ‘রাকিব সাহেবের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কেমন?’ বললাম, কেন, ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে তাঁর সাব-অডিনেটের যেমন থাকে, সে রকম। এবার প্রশ্ন, ‘তোমার কী মনে হয় না লোকটা তোমাকে একটু এক্সট্রা ফেবার করেন?’ কী জানি ঠিক ওইভাবে তো ভাবিনি, হতে পারে, বাড়তি একটু স্নেহ আছে বলেই হয়তো তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘রাকিব সাহেব লোকটা অসাধারণ, দেশি একটা কোম্পানি এত সুন্দর রান করাচ্ছেন, লাভজনক তো বটেই, ডিসিপ্লিন বা অন্য সবকিছু বিবেচনা করলে রীতিমতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, কিন্তু এত সাফল্য নিয়েও রাকিব বিনয়ী, মার্জিত রুচির ভদ্রলোক।’ বললাম, ঠিকই বলেছ। এই একটা অসাধারণ গুণ ছিল ওর, মানুষের ভালো ব্যাপারটা, সাফল্যের জায়গাটা শনাক্ত করতে পারে। হঠাৎ জানতে চাইল, ‘এ রকম একটা লোক রাকিব, তাঁকে তোমার ভালো লাগেনি?’ বললাম, মানে? ‘মানে এ রকম একটা লোকের প্রতি দুর্বলতা জন্মাল না, প্রেমে পড়লে না ওর?’ কী জবাব দেব, ভাবো এ রকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন বিয়ের মাত্র ১৫-১৬ দিনের মাথায় নিজের স্ত্রীকে কেউ করতে পারে?
তারপর?
বললাম, না, এ রকম ভাবনা আমার মাথায় আসেনি, তা ছাড়া এ রকমই যদি হতো আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হব কেন? কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে কী যেন ভেবেছিল একবার, তারপর বলল, ‘আচ্ছা, ব্যাপারটা তো এ রকমও হতে পারে, আমার সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়াটা রাকিবের একটা চাল, তিনি নিজে বিবাহিত মানুষ, বউ-বাচ্চা আছে, আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে করিয়ে দিলে কোনো সামাজিক সমস্যা তৈরি হলো না, নিরাপদে প্রেম চালিয়ে গেল তোমার সঙ্গে...।’ বিশ্বাস করো, আমি হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে, মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত মানুষটার সামনে বসে আছি আমি। এরপর দুই দিন অফিসে যাইনি, তৃতীয় দিন গিয়েছিলাম রেজিগনেশন লেটার হাতে নিয়ে। ব্যস, মামলা ডিসমিস। না, মামলা আর ডিসমিস হলো কই? সন্দেহের বাতিকটা গেল না। আমার এক কাজিন ছিল, ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে অনার্সে পড়তাম আমরা। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, মেট্রিক-ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করা ছাত্র, কিন্তু কী এক অজানা কারণে মাস্টার্স পরীক্ষা দিল না। চাকরি-বাকরি নেই, বেকার ঘুরছে। মাঝেমধ্যে আমার বাসায় আসত, তবে আত্মসম্মানবোধ টনটনে, টাকাপয়সা চাইত না, গল্পসল্প করে কখনো দুপুরে খেয়ে যেত। পরের দিকে আমার চেয়েও বেশি আড্ডা দিত আশিকের সঙ্গে। হঠাৎ একদিন ওর প্রসঙ্গ তুলল, ‘তোমার এই কাজিন কিন্তু এক্সট্রা অর্ডিনারি একটা ছেলে, এ রকম গুড হিউম্যান বিয়িং জীবনে কম দেখেছি আমি। আচ্ছা, ওকে কি ভালোবাসো তুমি?’ বললাম, কেন, এ কথা মনে হলো কেন তোমার?
বলল, ‘এমন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, জীবনে কত কিছু করার কথা ছিল, কিছুই হলো না...মন খারাপ হয়ে যায় না? মনে হয় না কত যদু-মধু কত কী করে ফেলল...ওর মতো একটা ছেলে...সিমপ্যাথি...মানে একধরনের করুণা থেকেও তো মানুষের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়...।’ বললাম, আমারই হয়তো দুর্ভাগ্য সে রকম কিছু জন্মায়নি। কিন্তু বিশ্বাস করানো গেল না, শেষে একদিন ফোনে কাজিনকে বললাম, তুই আর আমার বাসায় আসিস না, মিলন। ও তো শুনে আকাশ থেকে পড়ে, ‘আমি তো আজকাল আর তোর কাছে যাই না রে, আশিক ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাই, তোর হাজব্যান্ডটা এত ইন্টারেস্টিং লোক...।’ ভাবো! দুজনই পরস্পরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, মাঝখানে আমি দুলছি হাওয়া-লাগা জানালার পর্দার মতো। একটু কঠিন করেই বলে দিলাম, তবু আসিস না তুই, না আসাই ভালো। কী বুঝল কে জানে, মিলন আর আসেনি কখনো। একজন সাইকিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে পারতে। গিয়েছিলাম, কাজ হয়নি, এই রোগের বোধ হয় নিরাময় নেই। এরপর অন্তত আরও তিনজনকে নিয়ে সন্দেহ করেছে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা কী জানো, ওই তিনজনেরই ভালো দিকগুলো কী নিপুণভাবে শনাক্ত করেছে...সাধারণ একটা মানুষকে অসাধারণ করে তোলার এই ক্ষমতা সত্যি বিস্ময়কর! কোনো দিন কোনো মানুষের নিন্দা করতে দেখলাম না এই মানুষটাকে। আমিও তো এ রকম জীবনটা মেনে নিতেই শুরু করেছিলাম। কিন্তু সর্বনাশ হয়ে গেল তোমার ব্যাপারে এসে।
কী রকম?
আমার শ্বশুরের দোতলা বাড়িটা তো একটু পুরোনো আদলের, একদিন বললাম, এটা রেনোভেট করা দরকার। মুখ থেকে কথাটা পড়েছে কি পড়েনি, টাকাপয়সার তো অভাব ছিল না, নেমে পড়ল কাজে, দেশের সবচেয়ে ভালো আর্কিটেক্টকে দিয়ে কাজটা করাতে হবে। পুরোনো বাড়ি, কেন এত নামী আর্কিটেক্ট দরকার বা সে রকম কেউ রাজিই-বা হবেন কেন, এসব কথা ওকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ঠিকই তোমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে এল, তুমিই-বা কী করে রাজি হয়েছিলে জানি না।
আমি রাজি না হলে হয়তো পরের ইতিহাসটা অন্য রকম হতো।
হ্যাঁ, ইতিহাসটা সত্যি অন্য রকম হতো। মনে আছে, তুমি প্রথম যেদিন এলে খুব বৃষ্টি ছিল, গাড়ি থেকে নেমে ঘরের দরজা পর্যন্ত ছুটে আসতেই ভিজে একসা হয়েছিলে...।
হ্যাঁ, তুমি একটা তোয়ালে এনে দিয়েছিলে। প্রথম দেখায় প্রেম বলে একটা কথা চালু আছে...এসব কথায় অবশ্য বিশ্বাস করার বয়স নয় আমার। কিন্তু তোমাকে প্রথমবার দেখেই চমকে উঠেছিলাম বা মুগ্ধ হয়েছিলাম, এ কথা অস্বীকার করব না।
সেটা তোমার চোখের দিকে না তাকিয়েও টের পেয়েছিলাম, মেয়েদের সামনে-পেছনে মাছির মতো ছটা চোখ থাকে জানো তো? তা ছাড়া নতুন তো নয়, প্লিজ বড়াই করছি ভেবো না, ছেলেরা যে একটু মুগ্ধতার দৃষ্টি নিয়েই তাকায় আমার দিকে, সেটা কম বয়স থেকেই বুঝতে শিখেছি। তুমিও তেমন হেলাফেলার কেউ না, দেশজোড়া নাম তোমার...দেখতে শুনতেও..., তবে সত্যি কথা হচ্ছে, তোমার দিকে আলাদা করে তাকানোর কোনো ভাবনাই আসেনি মনে। তোমাকে আলাদা করে চেনাল আশিকই।
কেমন?
তোমার করা নকশায় আমাদের পুরোনো বাড়ির আদলটাই পাল্টে গেল। বাইরে থেকে দেখে কে বলবে এই বাড়ির বয়স চল্লিশের ওপর। সামনের পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একবার বাড়িটার দিকে ঘুরে তাকায়নি এমন লোক পাওয়া যাবে না। ইন্টেরিয়রটাও তুমিই করে দিয়েছিলে...অসাধারণ! স্বপ্নের বাড়ি বলে না, তুমি সত্যি একটা স্বপ্নের বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলে। কিন্তু সেই বাড়িটাতে শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে থাকতে দিলে না...।
আমি দিলাম না?
পুরোপুরি দায়ী করব না, তোমার দায় আংশিক। তোমার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল আশিকের। একদিন আড্ডা দিতে দিতে তুমি বলেছিলে, লিভিং রুমের দেয়ালে একটা পেইন্টিং ঝোলানো দরকার। তোমার কথা তো তখন বেদবাক্য, এককথায় রাজি হয়ে গেল সে। কোন শিল্পীর চিত্রকর্ম সংগ্রহ করা হবে, কোত্থেকে সংগ্রহ করা হবে—এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তুমিই হঠাৎ প্রস্তাব দিয়ে বসলে, ভাবির একটা পোর্ট্রেট করলে কেমন হয়। লাফিয়ে উঠেছিল লোকটা, গুড আইডিয়া, যত টাকা লাগে, ওর একটা পোর্ট্রেট আপনি করিয়ে দিন। মনে আছে, আমি কী রকম আপত্তি করেছিলাম? কিন্তু তোমরা দুজন কেউই আমলে নিলে না সেই আপত্তি। আমার একটা ফটোগ্রাফ চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলে তুমি। কদিন পর আমার প্রতিকৃতির একটা তেলচিত্র নিয়ে তুমি হাজির। তুমি তো স্থপতি, ছবিও আঁকতে পারো জানতাম না দুজনের কেউই। নিজের এমন সুন্দর তেলচিত্র দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু উচ্ছ্বাসটা আড়াল করেছিলাম সেদিন। কিন্তু আশিক তো পাগল, আনন্দে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। লিভিংরুমে ঝোলানো হয়েছিল ছবিটা, নিশ্চয় এখনো ওখানেই আছে।
কী করে জানলে যে এখনো আছে?
আমি তো লোকটাকে চিনি...।
হুম্। সর্বনাশের কথা বলছিলে...কীভাবে সর্বনাশটা হলো তোমার?
এর পর থেকে তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ লোকটা, এবং যথারীতি সেই সন্দেহ, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি কি না, এমন একটা অসাধারণ মানুষের প্রেমে না পড়া কী সম্ভব...ইত্যাদি। তারপর একদিন বলল, তুমি যে আমার প্রেমে পড়েছ, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কেন? তরুণ আর্কিটেক্ট, দেশজোড়া তার পরিচিতি, সে আমার মতো বিবাহিত নারীর প্রেমে পড়বে কেন? এসব কোনো প্রশ্ন বা যুক্তি তার মনে ধরে না, সে যেন নিশ্চিত তুমি আমার প্রেমে পড়েছ, প্রেমে না পড়লে একটা মেয়ের এমন নিখুঁত ছবি আঁকা যায় না, এ ছবি ফটোগ্রাফের চেয়ে জীবন্ত...। ধীরে ধীরে আমার প্রতিরোধ ভেঙে যাচ্ছিল। লোকটার ভালোবাসার অত্যাচারটা হয়তো আমি আর নিতে পারছিলাম না। একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল হয়তো। তোমার দিক থেকে আগ্রহটাও টের পাচ্ছিলাম, আর যতবার লিভিংরুমে ওই ছবিটা দেখি, ততবারই নিজেকে ছাপিয়ে তোমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার।
হা হা হা, এইভাবেই তাহলে সর্বনাশটা ঘটে গেল। কিন্তু আশিককে কি ভুলতে পেরেছ তুমি?
জানি শুনতে ভালো লাগবে না তোমার, তবু স্বীকার করি, না, এ রকম একটা পাগলকে ভোলা যায় না। একবার আমার গলব্লাডারে একটা পাথর ধরা পড়ল, ছোট্ট অপারেশন করাতে হবে। আমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় ডাক্তারের হাত ধরে ছোট্ট শিশুর মতো এমন হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল...ডাক্তার-নার্স সবাই অবাক!
সত্যিই অদ্ভুত লোক।
অদ্ভুত। আমরা তো আসলে একধরনের সো-কল্ড স্বাভাবিক জীবনের মধ্যেই বাস করি, তাই মানুষের স্বাভবিক আচরণগুলো ভুলে যাওয়া যায়, পাগলামি ভোলা যায় না। একবার আমার জন্মদিনে পতেঙ্গার নেভাল বিচে সারা রাত কাটালাম আমরা, প্রচণ্ড ঠান্ডার রাত...শীতে জবুথবু, আমার কোলে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে ছিল, নদী-সমুদ্রের মোহনায় কী রকম যেন অপার্থিব হয়ে উঠেছিল সেই রাত। আরেকবার দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখব বলে শেষরাত থেকে অপেক্ষা করে থাকা; হঠাৎ দেখি হিমালয়ের সাদা বরফচূড়ায় ভোরের সূর্য এসে লাল রং ঢেলে দিল। শৈশবে বরফকুঁচির ওপর লাল স্যাকারিন দেওয়া একধরনের আইসক্রিম পাওয়া যেত মনে আছে? অনেকটা সে রকম। সাদা বরফে যেই সূর্যোদয়ের প্রথম স্পর্শ পড়ল, ঠিক তখনই গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়ে একটা চুম্বন করল ঠোঁটে...।
লোকটাকে তো কখনো ভুলতে পারবে না তুমি! আমার ধারণা, এখনো আমার চেয়ে ওকে বেশি ভালোবাসো তুমি।
সন্দেহ করছ?
না, ঈর্ষা হচ্ছে।
ঈর্ষা ভালো, সন্দেহ কোরো না।
এখন তোমার কোনো যোগাযোগ নেই ওর সঙ্গে?
তুমি কিন্তু সন্দেহ করছ।
এই যে লোকটা প্রায়ই আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তুমি বলছ আড়াল থেকে তাকে দেখো, তুমি কখনো দাঁড়াওনি বারান্দায় গিয়ে? ইশারায়ও কথা হয়নি কখনো?
তুমি কিন্তু সত্যি সন্দেহ করছ।
কোনো দিন যদি দেখা না হয়, তাহলে লোকটা দিনের পর দিন কী আশায় হেঁটে যায় এই রাস্তা দিয়ে? এমন কি হতে পারে না, তোমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেই একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই পথ দিয়ে হেঁটে যায় আশিক, যখন আমি বাড়িতে থাকি না।
তুমি সত্যি সন্দেহ করছ আমাকে?
একই শহরে থেকে তোমাদের কোনো যোগাযোগই নেই, এ কথা বিশ্বাস হচ্ছে না...।
সন্দেহ কোরো না, সন্দেহ দুধারি তলোয়ার যেতেও কাটে, আসতেও কাটে।

No comments

Powered by Blogger.