নাদিয়ার সাহসকে সম্মান দিল যুক্তরাষ্ট্র by মানসুরা হোসাইন

আইডব্লিউওসি) পুরস্কার হাতে নাদিয়া শারমিন
হাত পেতে ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু নিতে হয়নি বাংলাদেশের সাহসী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনকে, বরং তারাই নাদিয়াকে খুঁজে বের করে সম্মান জানিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সাহসী এই সাংবাদিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। বিশ্বকে সগর্বে জানিয়েছেন এ দেশের নারীদের সাহসের কথা। জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। তাঁরা কারও চেয়ে কম নন। সেই সাহসকে সম্মান না দিয়ে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্তর্জাতিক নারী সাহসিকতার (ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড-আইডব্লিউওসি) পুরস্কার অর্জন করেন নাদিয়া শারমিন। যে নারীরা তাঁদের সাহসিকতা দিয়ে সমাজ বদলাতে অবদান রাখেন, তাঁদেরই এই সম্মান জানায় আইডব্লিউওসি। ২০০৭ সাল থেকে এ পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে। এ বছর বিভিন্ন দেশের ১০ জন নারী এই পুরস্কার পেয়েছেন। গ্লোবাল উইমেন ইস্যুজের অ্যাম্বাসেডর ক্যাথরিন এম রাসেল তাঁদের মধ্যে নাদিয়াকেই ‘প্রাণশক্তি’ হিসেবে মিশেল ওবামার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত ১০ নারীর পক্ষে কথা বলেন নাদিয়া। এমন এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গর্বিত হয়েছেন ক্ষমতাধর নারী মার্কিন ফাস্টলেডি মিশেল ওবামা। এ কথা অকপটেই নাদিয়াকে বলেছেন তিনি। আর নাদিয়ার ভালো লাগা তখন আকাশ ছুঁয়েছে।
কথা ছিল ৬ মার্চ মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা পুরস্কার দেবেন। প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে অনুষ্ঠান এক দিন পিছিয়ে দিতে হয়। তারপর হোয়াইট হাউসেই পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে মিশেল ওবামা দেখা করেন। সবার কথা শোনেন। টুইট বার্তায় তিনি এই নারীদের কথা লেখেন। লেখেন নাদিয়ার কথাও।
নাদিয়ার কাছে এটি কেবল পুরস্কার নয়, এটি তাঁর দেশের সম্মান। নিজের দেশকেই সগর্বে তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। গত রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে নাদিয়া বলেন, ‘বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ নাম মানেই বন্যা-দুর্যোগের সঙ্গে তুলনা। এটা কি ভারত? পাকিস্তানের অংশ? এ ধরনের প্রশ্নও শুনতে হয়েছে। কিন্তু এবার যাঁরা এই প্রশ্নগুলো করেছেন, তাঁদের সামনে উত্তর দেওয়া সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের একজন নারী প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে জানেন। আমার পরে যে নারীরা সংগ্রাম করবেন, তাঁরাও জানবেন যে সংগ্রাম চালিয়ে গেলে তার প্রতিদান হিসেবে ভালো কিছু পাওয়া যায়। তাই লড়াই থামালে চলবে না। প্রথমে একা লড়াই শুরু করলেও পরে পাশে পাওয়া যায় অনেককে।
নাদিয়া বলেন, ‘একা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন আমি যোদ্ধা নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছি। পুরস্কারটা পাওয়ার পর দায়িত্ববোধ বেড়ে গেছে। স্বপ্নের বিস্তৃতিটা বেড়ে গেছে। এখন আর একা পথ চললে হবে না। সম্মিলিতভাবে সামনে এগোতে হবে।’
২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল দেশে আলোড়ন তুলেছিলেন নাদিয়া। সেদিন নাদিয়া অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে। অফিস থেকে কিছু ফুটেজ নিতে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া সার্বিক দিক খেয়াল রাখতে হবে। কাজ করার একপর্যায়ে হেফাজতে ইসলামের একজন প্রশ্ন তোলেন, নারী হয়ে তিনি সমাবেশে কী করছেন। তারপর আস্তে আস্তে জড়ো হন অনেকে। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, তিনি নারী হিসেবে সমাবেশে যাননি, গেছেন সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কিছু বোঝার আগেই ৫০-৬০ জনের দলটি একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক নাদিয়া শারমিনের ওপর হামলা করে। মাটিতে ফেলে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে তাঁকে। কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু, গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যদের সহায়তায় নাদিয়া প্রাণে বেঁচে যান।
পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহসী নারীরা । মাঝে লাল-সবুজের সাজে বাংলাদেশের নাদিয়া
ওই ঘটনার জের টানতে হয়েছে অনেক দিন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় থাকতে হয়েছে নাদিয়াকে। দুটো অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। আর্থিক সংগতি না থাকায় দেশের বাইরে গিয়ে আরেকটি অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। এই দুঃসময়ে একুশে টেলিভিশন থেকে তাঁর চাকরিটাও চলে যায়। কিন্তু নাদিয়া থেমে যাননি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যোগ দেন একাত্তর টেলিভিশনে অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে।
দুঃসময়ের কথা মনে করে নাদিয়া বলেন, যাঁরা একসময় কাজে বাধা দিয়েছেন, ভেবেছেন আমি কাজ করতে পারি না তাঁরাই এখন আমাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তাঁরা দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য হয়েছেন।
নাদিয়া বলেন, ‘হেফাজতের ঘটনার পর অনেকবার মনে হয়েছে আমার ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড সাপোর্ট আমাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টার ফলাফল হচ্ছে, আমি আবার মিডিয়ায় ফিরে এসেছি। হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জিং অ্যাসাইনমেন্ট করছি।’
আসলে সাংবাদিকতা ছিল নাদিয়ার নেশা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হবেন। স্বপ্নের বীজ ছিল পরিবারেই। নাদিয়ার নানি সৈয়দা সুফিয়া খাতুন চল্লিশের দশকে সাহিত্যরত্ন পুরস্কার পান। নানির ছোট বোন হাসিনা আশরাফ দৈনিক বাংলার সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর মুখ থেকে সাংবাদিকতার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন নাদিয়া। নাদিয়ার নানা মারা যান অনেক আগে। নানি সংগ্রাম করে পাঁচ ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন। নাদিয়ার মা সৈয়দা তৈয়বা বেগম ছিলেন বড় মেয়ে। বাস্তবতার চাপে অনেক স্বপ্নই পূরণ হয়নি তাঁর। মায়ের সেসব স্বপ্নকেই সফল করে তুলছেন নাদিয়া ও তাঁর বোন।
নাদিয়ার এই অর্জন বাবা আবু তৈয়ব আজিজুর রহমান দেখে যেতে পারেননি। গত বছর মারা গেছেন। ছোট নানিও দেখে যেতে পারেননি।
নাদিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তবে রাজধানীতেই কেটেছে পুরো সময়।
পুরস্কার পাওয়ার পর কাজের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে নাদিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ১০ নারী সে দেশের নারী ও মানবাধিকারকর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মী ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং করতে পারবেন। নাদিয়া বলেন, এ সুযোগটি কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.