আক্কেল গুড়ুম by মাহবুব তালুকদার

বাংলাদেশের দুজন মহান রাজনীতিবিদের বক্তব্য আমাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। তারা দুজনই বিশিষ্ট সংসদ সদস্য। তাদেরকে মহান বলে আখ্যায়িত করার কারণ এদের উভয়েই আপন মহিমায় ভাস্বর। প্রথমজন হলেন ঢাকা-৭ আসনের নির্বাচিত এমপি হাজী সেলিম। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ‘আমার এলাকায় অনেক লোক আমাকে জানিয়েছেন, আমি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে না দাঁড়ালে তারা আত্মহত্যা করবেন।’ খবরটি পড়ার পর থেকে আমি শয়নে-স্বপনে অসংখ্য আত্মহত্যা-উদ্যত মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, হাজী সেলিম যাদের নাম বা সংখ্যা উল্লেখ করেননি। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হাজী সেলিমকে মনোনয়ন দিয়ে ওই সব আত্মহত্যায় অঙ্গীকারবদ্ধ অজ্ঞাত ব্যক্তিবর্গকে আত্মহনন থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
হাজী সেলিমকে আমি এক অসাধারণ রাজনীতিবিদ মনে করি প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন। তবে তিনি আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করে দূরে সরে যাননি বরং মহানগর আওয়ামী লীগে তার উপস্থিতি অতীব জোরদার। এবার তিনি মেয়র পদপ্রার্থী হতে সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করে নির্বাচনের ময়দানে লড়াই করতে আবির্ভূত হয়েছেন। আত্মবিশ্বাস না থাকলে এমন ঝুঁকি ক’জন নিতে পারে? কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, হাজী সেলিম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজিত হলে আত্মহত্যায় নিবেদিত আত্মদানকারী ওই সব হাজী সেলিম-ভক্ত ব্যক্তিদের কি অবস্থা হবে? নির্বাচন কমিশনের কি উচিত নয়, সম্ভাব্য গণমৃত্যুর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা?
অপর মহান রাজনীতিবিদের নাম আবুল কালাম আজাদ। তিনি বিএনএফ নামক একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি ও ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচিত এমপি। বিএনএফ বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের নাম বিএনপির কাছাকাছি হলেও তার অবস্থান বিএনপির বিপরীত প্রান্তে এবং অনেকটা আওয়ামী লীগের পদপ্রান্তে। আমি তাকে বিশাল মাপের রাজনীতিবিদ মনে করি এজন্য যে, তিনি গুলশান এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই এলাকায় সংসদ সদস্য ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, এরশাদ নির্বাচনে জিততে পারবেন না জেনে সংগোপনে আবুল কালাম আজাদকে ওয়াক ওভার দিয়ে দেন। যাই হোক, সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে জনাব আজাদ তার দল থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য দুজন করে চারজনের প্রার্থিতা  ঘোষণা করেন। দুজন করে প্রার্থীর নাম ঘোষণা কেন, এরকম প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে বর্তমানে অপহরণ-গুম ও খুনের প্রচলন শুরু হয়েছে। তাই আমরা সিটি নির্বাচনে দুজন করে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছি। একজন গুম হয়ে গেলে অন্যজন নির্বাচনে অংশ নেবেন।’
মাননীয় এমপির এই উক্তি অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচায়ক। সালাহউদ্দিন আহমেদের গুমের পর সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে এ ধরনের আশঙ্কা অমূলক নয়। আমার মনে হয়, অন্যান্য দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও গুমের বিষয়টি মাথায় রেখে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া উচিত। কিন্তু বিএনএফ প্রধানের ওই উক্তির পর আরেকটি দুশ্চিন্তা আমার মাথায় ভর করে আছে। যদি নির্বাচনকালে বিএনএফ-এর মেয়রপদের দুজন করে চারজন প্রার্থীই গুম হয়ে যান, তাহলে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? আমার মনে হয়, প্রতিটি মেয়র পদের জন্য যদি পাঁচজন করে প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে জনাব আজাদের আশঙ্কার কিঞ্চিৎ উপশম হতে পারে। নির্বাচন কমিশন অনুগ্রহপূর্বক দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই বাস্তব চিত্রটি অনুধাবন করবেন।
এক ঢাকার কেন দুজন পিতা হবেন, এ ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক অসাধারণ বাগ্মী নূরে আলম সিদ্দিকী। তিনি ফাউন্ডেশনের এক আলোচনা সভায় সম্প্রতি বলেছেন, ‘সিটি মেয়রকে নগরপিতা বলা হয়। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, দিল্লির মতো বড় শহরে যেখানে একজন করে মেয়র, সেখানে ঢাকায় দুজন নগরপিতা হবেন কেন?’ বিষয়টি আমাকেও রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। আমার এক প্রবাসী বন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকীর বক্তব্য শুনে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘নির্বাচনের পর আপনি আমাকে দয়া করে জানাবেন, আমি কোন পিতার সন্তান?’
আমার আক্কেল গুড়ুম!

No comments

Powered by Blogger.