‘বিগেনিং অব দ্যা এন্ড’ by কাউসার মুমিন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় সংলাপের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও  ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আরেক বিশ্বশক্তি  চীন ইতিমধ্যেই সংকট সমাধানে রাজনৈতিক সমঝোতার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। গণতান্ত্রিক দুনিয়ার আকাঙ্খাকে মূল্য দিয়ে ভারতের বিজেপি সরকারও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়ার কুটনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসে সংকট সমাধানে ‘দেশটির জনগণের নিজস্ব ক্ষমতার’-উপর আস্থা রয়েছে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্রীক জাতীয় রাজনীতিতে এখন ‘বিগেনিং অব দ্যা এন্ড’ এর পালা চলছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ঝানু রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আয়োজিত বৈশ্বিক সন্ত্রাস মোকাবিলার এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সাইড লাইনে বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদ আলী। বৈঠক শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন সিনিয়র মুখপাত্র এই প্রতিনিধির কাছে পাঠানো লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ছাড়িয়ে দুই পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বৈঠকে মূলত বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্র্ণ হয়ে উঠে। মুখপাত্র বলেন, বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরী এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘বাংলাদেশের মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষার (প্রটেক্ট ফান্ডামেন্টাল ফ্রিডম অব বাংলাদেশ) প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। বিবৃতিতে মুখপাত্র আরও বলেন, সেক্রেটারী কেরী বাংলাদেশের চলমান সহিংসতার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানান। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ উপায়ে মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষায় সরকারের দায়িত্ব, এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় সংবাদ মাধ্যমের গঠনমূলক ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশে মিডিয়ার কাজের অবাধ ও মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার আহবান জানান। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতির ‘বাংলাদেশের মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষার’ বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করে বলছেন এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মূলত এ অঞ্চলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে নির্মিত নিজস্ব রাষ্ট্রীয় স্বকীয়তার প্রতি ইঙ্গিত করেছে। বিবৃতিতে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র আরও বলেন, সেক্রেটারী কেরী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক সাধারণ মানুষের জানমাল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ঘটনার নিন্দা জানান। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ধরনের আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধের আহবান জানান।
এদিকে একই সম্মেলনের সাইডলাইনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গেও দেখা করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে মহাসচিব এ বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় জানমালের ক্ষয়-ক্ষতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বৈঠক শেষে মহাসচিবের পক্ষে জাতিসংঘ প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের স্বার্থে বর্তমান সহিংস পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে মহাসচিব বাংলাদেশ সরকারকে সুনির্দিষ্ট বাস্তবপন্থা অবলম্বনের আহবান জানিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মূলত চলতি সপ্তাহে মহাসচিবের মুখপাত্র বাংলাদেশ বিষয়ে বেশ কয়েকবার যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তারই পুনরুক্তি ঘটলো।
গতকাল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠকের পর মহাসচিবের পক্ষে প্রদত্ত বিবৃতিতে কিছু শব্দ প্রয়োগের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন মহাসচিবের বিবৃতিতে উল্লেখিত ‘লং টার্ম স্টেবিলিটি’, ‘কংক্রিট স্টেপস’, এবং এনগেইজ কনস্ট্রাকটিভলী শব্দ যুগল গুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতিসংঘের সিরিয়াস অবস্থানের পরিচয় বহন করে। এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘অচলাবস্থা’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। কেউ কেউ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে ‘সঙ্কট’ হিসেবেও দেখছেন। কিন্তু, বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতি, এশীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের চলমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতি প্রকৃতি, এর ধরণ, উৎস ও ব্যাপ্তির পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো বিশ্লেষ করে একে স্রেফ রাজনৈতিক সংকট না বলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য ‘বিপদ’ বলে মনে করেন দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক লিসা কার্টিস।
আগের সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের চলমান সংকটে সরকারের ভুমিকাকে আগুনে ঘি ঢালার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইলেক্টোরাল ইন্টিগ্রিটি প্রজেক্ট-ইআইপি (ই আই পি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে  ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে ‘ব্যর্থ নির্বাচন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্পটি পরিচালিত হয়। সংলাপের আহবানকে উপেক্ষা করায় ইতিমিধ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য বলে মন্তব্য করেছেন। এতকিছুর পরও সরকারে একটি সিরিয়াস আলোচনার পরিবেশ তৈরীর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার প্রবণতাকে বাংলাদেশের শুধু রাজনৈতিক সঙ্কট না বলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সমূহ বিপদ বলে মনে করছেন লিসা কার্টিজ। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিসা কার্টিজ এই প্রতিনিধিকে বলেন, সাধারনভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গত এক বছরেরও বেশী সময় ধরে একই আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও প্রাগম্যাটিক ভুমিকা রাখা উচিত। এই প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় লিসা কার্টিজ আরও বলেন, এ ধরনের সমস্যা কবলিত দেশগুলোতে (বর্তমান বাংলাদেশ যেমন) আপাত:দৃষ্টিতে রাজনৈতিক সংকট সমাধানযোগ্য বলে মনে হলেও একসময় তা কঠিন হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনে এবং শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের আকাঙ্কা হোচট খায়।

No comments

Powered by Blogger.