নন্দলালের জীবনযাপন! by মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

ছোটবেলায় ‘নন্দলাল’ নামে একটি কবিতা পড়েছিলাম। সেখানে নন্দলাল সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন এই ভেবে যে, তিনি মারা গেলে দেশের কী হবে? তিনি রাস্তায় বের হতেন না, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়তেন না, কারণ দুর্ঘটনায় তার যদি মৃত্যু হয়! এমনকি তার ভাই কলেরায় মারা গেলেও কলেরা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তার কাছে ভেড়েন না। তার সংকল্প, দেশের তরে তাকে জীবন রাখতেই হবে! প্রায় ৫ যুগ পর, সেই কবিতার কথাটিই মনে পড়ে গেল। আজ এক মাস ধরে ঘর থেকে বের হই না বললেই চলে। কন্যাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় তাকেও বের হতে নিষেধ করি। তবুও অতিপ্রয়োজনে সে বের হয়। প্রায় দুই বছরের ছেলেটিকে সে আমাদের কাছে রেখে যায়। আমরা তার সঙ্গে খেলা করে সময় কাটাই। মনে হয় ঘরে বসে বসে আমিও তার মতো শিশু হয়ে যাচ্ছি! কোনো কাজে এমনকি লেখাপড়াতেও মন বসে না। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখতে রাখতে আরও বেশি করে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কারণ প্রায় সব খবরই নেতিবাচক। আগুনে পোড়া দগদগে ঘা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় নারী-পুরুষ, শিশুর আর্তনাদ। এসব দেখেশুনে নিজেকে মানুষ ভাবতে কষ্ট লাগে। চোখে পানি এসে যায়। মনে হয় আমার ভেতর এমন কোনো শক্তি থাকলে এখনই এসব থামিয়ে দিতাম। মারামারি-ধরাধরির মচ্ছব আর কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। চোখে দেখা এসব ঘটনা মাথায় ঢুকছে আর মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। কিন্তু আসলে আমার কিছুই করার নেই। কারণ আমার হাতে সরকারি ক্ষমতা বা সরকারবিরোধী ক্ষমতা কোনোটিই নেই। এসব ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা কিছুতেই মানবতাবিরোধী অপকর্মগুলো বন্ধ করছেন না। এ ক্ষেত্রে তাই আমার বা আমাদের মতো চুনোপুঁটির পক্ষে কিছু করাও সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই আমরা মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আর্থিক ক্ষতি ভবিষ্যতে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হলেও মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমার একমাত্র পুত্রটি অস্ট্রেলিয়া থাকে। সে বলেছিল, সেখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে। কিন্তু তখন তার কথায় কান দেইনি। কারণ এই মাটি, এই দেশের কাছে আমি ঋণী। এ দেশ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। বছরখানেক আগে ছেলেটি এসে ঘুরে গিয়েছে। তখনও সে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন দেখে এ দেশে না থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। আমরা বৃদ্ধ হয়েছি বিধায় তাকে দেশে ফিরে আসতে বলায় তার সঙ্গে এ নিয়ে বাদানুবাদ হয়েছে। সে দেশে ফেরার আদেশ প্রত্যাখ্যান করায় আমরা মনে কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। সে তার পরিবার নিয়ে এ দেশে আসতে চায় না। অথচ একমাত্র ছেলেকে এই ভেবে ডাক্তারি পড়িয়েছিলাম যে, নিদেনকালে আমরা তার সেবা পাব। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। তার ফুটফুটে সুন্দর শিশুকন্যাটিকে আমরা কোলে নিতে পারি না। কারণ আমরা সেখানে যেতে পারি না। আবার ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে ভিসা করে সেখানে গেলেও বেশিদিন থাকতে পারি না। মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে।
দেশের বর্তমান অবস্থায় নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। দিনের বেলাতেও অনেক সময় ঘুমিয়ে কাটাই। আগে নিয়মিত বের হতাম। এখন বের হই না বললেই চলে। এ অবস্থায় মনের ওপর চাপ বাড়ছে। বাংলা একাডেমির এবারের বইমেলায় আমার লেখা একটা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেসব নিয়েও মাতামাতি করতে ইচ্ছা হয় না। গত সোমবার চ্যানেল আই-এ একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে চলে এসেছি। সেখানে আর যাওয়া হয় না। শরীরে অলসতা জেঁকে বসেছে। অথচ এমনটি আগে কখনও হয়নি। সব সময় সব কাজে আগে থেকেছি। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেকে সব সময় সামনের কাতারে রেখেছি। সামনে অন্যায় কিছু দেখলে কোনো সময় পিছু হটিনি। কিন্তু আজকাল নিজেকে অত্যন্ত দুর্বল মনে হচ্ছে। দিনের পর দিন মানসিক সক্ষমতা কমতে শুরু করেছে। অথচ জীবনের এখনও অনেকটা পথ বাকি। বাকি জীবন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে চাই। কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই, ‘যতদিন দেহে আছে প্রাণ, দু’হাতে সরাব জঞ্জাল। এ পৃথিবীকে আমি বসবাসযোগ্য করে রেখে যাব, নবপ্রজন্মের কাছে এই আমার অঙ্গীকার।’ কিন্তু কে দেখাবে পথ, কে নিয়ে যাবে আমাকে সেথায়? সবকিছু দেখেশুনে এখন তাই মনে হচ্ছে, এসব করার জন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ দরকার। সুযোগ পেলে দেহের বাকি শক্তিটুকু দিয়ে আরও একবার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যেতাম। কারণ এভাবে নন্দলাল হয়ে ঘরে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আর নন্দলালের জীবনযাপন আমার পছন্দেরও নয়।
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : রাজনীতিক, কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.