বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যা ও এর প্রকৃত সমাধান by শিশির ভট্টাচার্য্য

বাংলাদেশের লেখ্য, দৃশ্য ও শ্রাব্য গণমাধ্যমে কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে, বাংলা ভাষা বাংলাদেশের নদীগুলোর মতোই দূষিত হয়ে উঠেছে। এই দূষণ নাকি হচ্ছে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে—১. ইংরেজি বা আঞ্চলিক ঢঙে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে, ২. কথা বলার সময় বাংলা শব্দের পরিবর্তে ইংরেজি-হিন্দি-আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারে এবং ৩. বানান বিকৃতিতে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে এফএম রেডিওসহ বিভিন্ন বেসরকারি গণমাধ্যমের দিকে। বাস্তবতা হচ্ছে, গণমাধ্যমে তথাকথিত শুদ্ধ উচ্চারণে প্রমিত বাংলা বলা হলেও ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলা বা বাংলায় ইংরেজি শব্দমিশ্রণ বন্ধ হবে না। এফএম রেডিও শুনে মানুষ ভাষা শেখে না, খদ্দের-শ্রোতা যে ভাষায় কথা বলে, এফএম রেডিও সেই ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় মুনাফার স্বার্থে।
ভবিষ্যতের প্রজন্ম আরও বেশি করে ইংরেজি ও হিন্দিভাষী হয়ে উঠবে এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা আরও বেশি ইংরেজি-হিন্দি শব্দ মেশাবে তাদের বাংলায়। একাধিক ভাষার সংযোগ হলে এ ঘটনা ঘটবেই, কারও পছন্দ হোক বা না হোক। প্রমিত বাংলায় ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ পছন্দ করেন না এমন শেষ লোকটিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন, ধরা যাক, ২০৫০ সালের আগেই। ইতিমধ্যে ইংরেজি শব্দগুলোকে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব এমনভাবে বদলে নেবে (হাওয়া, চেয়ার, নাট-বল্টুর মতো) যে সাধারণ মানুষ কথা বলার সময় খেয়ালই করবে না কোনো এককালে এই শব্দগুলো ইংরেজি থেকে এসেছিল।
ব্যক্তিমালিকানার টিভি যদি শুধু সিলেটি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে, তবে তাতে রাষ্ট্রের কী বলার থাকতে পারে? নোয়াখালীর কোনো একজন নাট্যকার যদি বরিশালে বোধগম্য হতে না চান, তাতেই বা রাষ্ট্র বাদ সাধবে কেন। একইভাবে কোনো বেসরকারি বেতারকেন্দ্র যদি বিশেষ একটি উপভাষা বাংরেজিতে অনুষ্ঠান প্রচার করে, তবে তাতে বাধা দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে? উচ্চ আদালত বা কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে বাংলা ব্যবহারই করছে না, সেখানে এফএম রেডিও অন্তত বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করছে, সেই বাংলা কারও কারও কাছে যতই শ্রবণকটু হোক না কেন। ভাষার সুশ্রাব্যতা বা শুদ্ধতার ধারণাও আপেক্ষিক। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রমিত বাংলার ‘শুদ্ধ উচ্চারণ’ একরকম ‘শ্রবণসুখকর’ নয়।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পাঞ্জাবি-বুরখা-কুর্তা-নান-পাগড়ি-বিরিয়ানি-তন্দুরি-গান-ভগবান...সব উত্তর ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে বা উত্তর ভারতের মাধ্যমে এসেছে। টিভি-ইন্টারনেটের কারণে দিনে দিনে আরও সর্বব্যাপী হবে উত্তর ভারতের প্রভাব। এই প্রভাব পুরোপুরি কাটানো যাবে না, তবে স্থানীয় সংস্কৃতির অধিকতর চর্চা করে একে সহনশীল পর্যায়ে রাখা যেতে পারে। স্থায়ীভাবে হিন্দি চ্যানেল বন্ধ করা বাঙালি জাতির জন্য বিরিয়ানি খাওয়া নিষিদ্ধ করার মতোই অসম্ভব। চ্যানেল বন্ধ করে দিলে হিন্দি অনুষ্ঠান দেখার অন্য অনেক উপায় মানুষ খুঁজে নেবে।
নিছক টেলিভিশন দেখে নতুন একটি ভাষা হিন্দি শিখলে সমস্যা কী? একটি ভাষা শিখলে আরেকটি ভাষার ক্ষতি হবে, এমন আশঙ্কা অমূলক। শৈশব আর বাল্যকাল হচ্ছে ভাষা শেখার আসল বয়স। হিন্দি আর উর্দু একই ভাষা এবং ফিল্মি হিন্দি ধীরে ধীরে উর্দুতে পরিণত হচ্ছে। জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধির কারণে বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দি-উর্দু জানলে উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশে কাজ পেতে, সেখানে গিয়ে সেখানকার জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে সুবিধা হবে। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষে যে দুটি ভাষা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ানোর আশঙ্কা আছে, সেই দুটি হচ্ছে হিন্দি ও বাংলা। এই প্রতিযোগিতায় হিন্দি যে বিষয়টিতে বাংলার তুলনায় পিছিয়ে থাকবে সেটি হচ্ছে, হিন্দি সব হিন্দিভাষীর মাতৃভাষা নয়। সুতরাং হিন্দি শিখে নিলে আখেরে বাঙালির লাভ ছাড়া ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
বলিউডের কল্যাণে বাঙালিসহ উপমহাদেশের প্রায় সব জাতির বিনোদনের ভাষায় পরিণত হয়েছে হিন্দি। যাঁরা হিন্দি বুঝবেন না, তাঁরা বিনোদনের একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। কর্তৃপক্ষ হিন্দিতে ডাব করা জাপানি ‘ডোরেমন’ বাদ দিতে পারে, কিন্তু বিনিময়ে কোন বিনোদন দেবে শিশুদের? চ্যানেলে বন্ধ হলেই কি ‘ডোরেমন’ দেখা বন্ধ হবে? মানসম্পন্ন বাংলা অনুষ্ঠান তৈরি করা হলে মানুষ হয়তো আপনিই হিন্দি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। হিন্দি ছবিকে গত শতকের ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের হলে চলতে না দেওয়ায় বাংলা ছবির উন্নতি হয়নি, বরং বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোই একে একে বন্ধ হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভারতের অনেক প্রাদেশিক সিনেমাশিল্প টিকে আছে শুধু নয়, বরং সেগুলোর অনুকরণীয় উত্তরণ ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক সিনেমার মানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সিনেমার মানের তুলনা করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ব্যবহার করলেই প্রমিত ভাষা কেন বিকৃত হয়ে যাবে? ৭ মার্চের ভাষণে ‘দিবার পারবা না’, ‘আমার রক্তের উপর পাড়া দিয়ে’ ইত্যাদি আঞ্চলিক শব্দবন্ধ ব্যবহারে কি তাহলে প্রমিত বাংলা বিকৃত হয়েছে? প্রমিত ভাষা যেহেতু একটি সর্বজনীন উপভাষা, সেহেতু এই উপভাষায় অন্য উপভাষা থেকে শব্দ ঢোকাটাই তো স্বাভাবিক। একজন চট্টগ্রাম-ভাষী যদি কথা বলার সময় কোনো বিশেষ বাংলা শব্দ খুঁজে না পায়, তবে কি সে চট্টগ্রামি শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে? কথা বলাটা জরুরি, নাকি শব্দ ব্যবহারের শুদ্ধতাটা জরুরি?
বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যা, সর্বস্তরে ভাষাটির প্রয়োগ নেই এবং ভাষাটির অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা নেই। এ দুই সমস্যা সমাধানে নিচের চার দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে:
১. যেকোনো পণ্য বা সেবার বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে;
২. সরকারি-বেসরকারিনির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যম হবে শুধুই প্রমিত বাংলা। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ইংরেজি (এবং সম্ভব হলে আরবি, চীনা, জার্মান, ফরাসি ইত্যাদি ভাষা) শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে (এর ফলে বিদেশমুখী জনগণের ভাষা প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে);
৩. ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইন কার্যকর করতে হবে। যাবতীয় অফিস ও আদালতের কাজের ভাষা হবে বাধ্যতামূলকভাবে প্রমিত বাংলা। কোনো অফিস বা আদালতে বাংলা ভাষায় সেবা পাওয়ার অধিকার যে কেউ দাবি করতে পারবে;
৪. সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবির সপক্ষে জনমত গঠন করতে হবে।
এক শব্দের একটি মাত্র বানান থাকতেই হবে, ভাষার জন্য এটা আবশ্যকীয় শর্ত নয়। যেকোনো লিখিত ভাষায় অল্প কিছু বানানে বিকল্প থাকে এবং সেই বিকল্প অনুমোদন করা উচিত তিনটি কারণে: ১. যারা পুরোনো বানানে অভ্যস্ত, তাদের ওপর নতুন বানান চাপিয়ে দিলে সেই বানানে অভ্যস্ত হতে তাদের সময় লাগে; ২. নতুন বানান না লেখার কারণে তাদের গুরুতর আর্থিক ক্ষতি হতে পারে (ধরা যাক, তারা কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে পারে); ৩. ব্যাকরণ ও ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই বিকল্প অনুমোদন করে, সুতরাং কিছু বানানে বিকল্প থাকলে ক্ষতি নেই; ৪. একাধিক বিকল্প বানানের মধ্যে একটি বানানই কালের প্রবাহে টিকে থাকে।
ভাষার যাবতীয় দূষণ রোধে ভাষাসেল গঠন করা এবং ভাষাপুলিশের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে পত্রপত্রিকা ও আন্তর্জালে কোনো কোনো লেখায়। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেখানে বানানের ব্যাপারে একমত হতে পারছে না, সরকার নিজেই যেখানে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করছে ইংরেজিতে (বিজিবি, টেলিটক...), সেখানে বানান-বিকৃতি বা ভাষাদূষণ রোধে সেল গঠন করে কী হবে? ভাষাপুলিশ যে সাইনবোর্ডে ভুল বানান দেখেও না দেখার ভান করবে না, তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে?
শিশির ভট্টাচার্য্য: সহযোগী অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.