একুশের অঙ্গীকার by মাতিয়া বানু শুকু

আমার প্রথম পরিচয় আমি বাঙালি। বাংলা ভাষাভাষী মা-বাবার সন্তান। জন্মসূত্রে আমার একটি ধর্ম আছে, একটি দেশ আছে, একটি ভাষা আছে। সামাজিক সূত্রে ধর্মীয় দিন, আনুষ্ঠানিকতা পালন করি। মুক্তি সংগ্রামের বিজয় সূত্রে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করি। উজ্জ্বল এক ইতিহাসের সূত্রে ভাষারও একটি বিশেষ দিন ও আনুষ্ঠানিকতা আমার আছে_ একুশে ফেব্রুয়ারি, সেটা পালন করি। ভাষার জন্য লড়াই করা শহীদদের স্মরণে স্মৃৃতিসৌধে ফুল দিই, মাথা নুইয়ে সেসব বীরকে শ্রদ্ধা জানাই। তারপর মাথা উঁচু করে গর্বের সঙ্গে একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে বলি_ মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।
আমার দ্বিতীয় পরিচয়, ভাষার জন্য লড়াই করা সেই সাহসী বীরদের একজন ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিন আমার বাবা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অসহযোগ আন্দোলনের সেই বিশেষ দিনে তিনি প্রাণ হারাননি। পরবর্তী তেষট্টি বছর তার সহযোদ্ধা ভাইদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারে তার প্রাণবন্ত পদচারণা ছিল। ছিল স্মৃৃতিচারণা। আর ছিল, তাকে ঘিরে অসংখ্য অনুরাগী আর মিডিয়া কর্মীদের উন্মাদনা। এই প্রথমবারের মতো ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিন শহীদ মিনারে আর বইমেলায় পা রাখবেন না। এই প্রথমবারের মতো আমাদের বাড়িতে নেই অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। এই প্রথম ফেব্রুয়ারি মাস, যার ২০টা দিন পার হয়ে গেলেও কেউ আমার মাকে জ্বালাতন (স্মরণ বলছি না) করতে আসেননি। কারও প্রয়োজন পড়েনি। কারণ ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিন আর নেই। নাকি এই অল্প ক'দিনেই ভুলে গেছেন সবাই। যেতেই পারেন। বাঙালি সহজে বিস্মৃৃতিপ্রবণ এক জাতি।
এটা আমার দীর্ঘশ্বাস নয়; ভয়। ভয় হয়, এই বিস্মৃৃতিপ্রবণ জাতি খুব সহজে নিজেকে ভুলে যাবে না তো! প্রয়োজন নেই বলে নিজের ভাষা, মাতৃভাষাটাকে হারিয়ে ফেলবে না তো!
আমার তৃতীয় পরিচয়, সাধু-শান্তি-অগি্ন তিনটি ফুটফুটে শিশুর মা আমি। আমার ভয়ের শুরুটা এখানে। আমার ৩ বছরের অগি্ন ভালোমতো কথা বলতে শেখেনি, কিন্তু 'ফাইভ লিটল মাঙ্কি, জাম্পিং অন দ্য বেড' বলতে শিখেছে। আমার ৫ বছরের শান্তি বলে, 'মা, তুম আচ্ছা হো।' আমার ১০ বছরের ছেলে সাধু ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যায় বলে, তার পাকিস্তানি আর শ্রীলংকান বন্ধু আছে। সে আর তার বন্ধুরা ইংরেজিতে উইক। তাই কমন ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দিতে কথা বলে। এই তিনজন টেকনো-ডিজিটাল শিশু ইংরেজি, হিন্দি, উর্দুর্র পাশাপাশি রাশিয়ান, স্প্যানিশ আর জাপানি ভাষাও অনেক ভালো বোঝে, কম্যুনিকেট করতে পারে। অবশ্যই সেটা ইউটিউব আর ইন্টারনেটের কল্যাণে। এমন একাধিক ভাষায় দক্ষ সন্তানদের মা হয়ে আমার গর্বিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি সেটা হতে পারি না। যখন দেখি সাধু তার বাংলা বই খুলে 'অর্ধচন্দ্র' উচ্চারণ করতে না পেরে জানতে চায়_ 'মা, এর প্রনানসিয়েশন কী!' তখন বুকের ভেতরে ধক করে ওঠে। কী সর্বনাশ! আমার পরের প্রজন্ম শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে দেবে না তো?
আমি নড়েচড়ে বসি, সচেতন হই। আমার শৈশবে ফিরে তাকাই। ৪ বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ভোরবেলা শিশিরভেজা ঘাসে নগ্ন পা রেখে, ফুল হাতে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে শুনলেও ভালোমতো বুঝতে পারিনি_ একুশে ফেব্রুয়ারি কী, ধীরে ধীরে জেনেছি। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনের বিশেষ আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে করতে ইতিহাস আর নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসাটা প্রগাঢ় হয়েছে। আমার বাবা সেই গর্বিত ইতিহাসের অংশ বলে জেনেছি, শুনেছি অন্যদের চেয়ে বেশি। একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই ছিল বাবার হাত ধরে বইমেলা যাওয়া, ঢাকা মেডিকেলের সেই ঐতিহাসিক আমতলা ঘুরে আসা। ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক চাচার বাসায় যাওয়া। ভাষাসংগ্রামী ড. আহমদ রফিক চাচাসহ আরও অনেকে আসতেন আমাদের বাড়িতে। হতো আলোচনা-সমালোচনা, উৎসবের আমেজে। নিজে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্রী, ২০ ফেব্রুয়ারি রাত মানেই শহীদ মিনারে আল্পনা এঁকে রাত ১২টা ১ মিনিটের জন্য অপেক্ষা করা। তার পর সাদা-কালো শাড়ি পরে পুরো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটা জুড়ে বইমেলা, ভাষা উৎসব আর কবিতা উৎসবে ঘুরে বেড়ানো।
আজ ২০১৫-এর ২১ ফেব্রুয়ারির আগের রাতে বাবাকে মনে পড়ছে খুব। অন্য একুশে ফেব্রুয়ারির দিনগুলো বাবাকে যত না কাছে পেয়েছি; আজকে মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশি কাছে আছেন তিনি। কত আফসোস মনের মধ্যে_ কেন বাবার সঙ্গে ভালো একটা ছবি তুলে রাখিনি! কেন বাবাকে দিয়ে অনেক কিছু লিখিয়ে রাখিনি! কেন তাকে নিয়ে একটা ভালো ডকুমেন্টারি বানিয়ে রাখিনি (যখন আমি নিজেই মিডিয়া কর্মী)! খুব কাছে ছিলাম বলে কোনোদিন বাড়তি খেয়াল করিনি, কী দুঃসাহস ছিল লোকটার! অর্থ-সম্পত্তি বা ক্ষমতার লোভে নয়; শুধু মায়ের মুখের ভাষার দাবিতে ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুর সামনে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি বিশ্বাস রেখে ভাষার লড়াইয়ে এক হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন ছাত্র-বন্ধুদের। মৃত্যু অবধারিত জেনেও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সবাইকে নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন।
ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিন সফল হয়েছিলেন ভাষার অধিকার আদায় করতে। কিন্তু শুধু ভাষাকে মুক্ত করার এই সাফল্যের অহমিকায় গা না ভাসিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাষ্ট্রের মুক্তির আন্দোলনে। আস্থা রাখলেন সমাজতন্ত্রের আদর্শে। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত দলভুক্ত থেকেই দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে নামলেন। আজীবন যোদ্ধা এই লোকটাকে নিজ দলের ভেতরে থেকে ভুল নীতিমালার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হয়েছে, একই সময়ে। সেখানে সফল হতে লেগেছে অনেক সময়। এর মধ্যবর্তী সময়ে ছিল অর্থের প্রলোভন, ক্ষমতার হাতছানি। কোনো কিছুই তাকে তার আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি। উল্টো দলের হয়ে ভুল নীতিমালার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, ঠিক যেমন করে বীর যোদ্ধা যুদ্ধ শেষে তার ভুল স্বীকার করে জাতির সামনে মাথা নোয়ায়, প্রতিজ্ঞা করে_ অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষায় আজীবন জাগ্রত থাকবে। ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিন তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দেশ ও জাতির কল্যাণেই নিবেদিত ছিলেন_ আমি তার কন্যা জোর গলায় বলতে পারি পরিবারকে অবহেলা করে।
আজকে, ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিনের মৃত্যুর মাত্র চার মাসের মাথায় যখন আমরা সেলিব্রিটি পরিবার থেকে সাধারণ জনগণের কাতারে নেমে এসেছি, আমি পরিষ্কারভাবে অনুভব করছি, তার সেই অবহেলা আমার মনে কোনো আক্ষেপ তৈরি করে না; আমি হারাইনি কিছুই। আজ থেকে ৬৩ বছর আগে তার নির্ভীক প্রতিবাদ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার, জাতির যে কোনো প্রয়োজনে সম্মিলিত হওয়ার।
বাবাকে ছুঁয়ে কোনোদিন কোনো অঙ্গীকার করিনি বলে, আজ রাতে আমার আফসোস হচ্ছে। আমি সেটাকে আর বাড়াতে চাই না। ভাষাসংগ্রামী আবদুুল মতিন ও তার সহযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার কাছে আমি অঙ্গীকার করছি, প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে আমরা বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করব, পৃৃথিবীর যে কোনো অধ্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে বাংলা ভাষা থাকবে শক্তিশালী ভূমিকায়। যেন কেউ আমাদের ভাষাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিতে না পারে।
প্রার্থনা করি, আমার সন্তানেরা যেন শুধু ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে না যায়। প্রত্যেকে যেন মনেপ্রাণে নিজেকে এক একজন ভাষার সৈনিক বলে মনে করে। ধর্মের প্রয়োজনে যদি জিহাদ হয়, ভাষা আর দেশের প্রয়োজনেও তারা জিহাদে নামবে। বুক ফুলিয়ে বলবে_ মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।
ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিনের মেয়ে
নাট্যকার ও নির্মাতা

No comments

Powered by Blogger.