নেপালি স্বর্গে ঝঞ্ঝাট by শশী থারুর

বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে ইদানীং নেপালের স্থান হচ্ছে না। কিন্তু সেখানে যে সাংবিধানিক সংকট চলছে, তাতে পর্যটনের তীর্থকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত দেশটি আবারও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে। দেশটির অবস্থান চীন ও ভারতের মধ্যে, ফলে তা স্পর্শকাতর। ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশটি মাওবাদী ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা রাজতন্ত্রের মধ্যকার দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হয়েছে। রাজার শক্তিশালী সেনাবাহিনী দেশটির গণতান্ত্রিক দলগুলোর সমর্থন পেয়েছে। ২০০৫ সালে মাওবাদী ও গণতান্ত্রিক দেশগুলো সংবিধান সভা গঠনে একমত হলে সেখানে শান্তি আসে (ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তা নিশ্চিত হয়)। সেখানে প্রথম নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। ‘জনগণের আন্দোলনে’ রাজা জ্ঞানেন্দ্র রাজত্ব ছাড়ার দুই বছর পর।
সেই নির্বাচনে মাওবাদীরা বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। সংসদের ৬০১টি আসনের মধ্যে তারা ২৪০টি আসনে জয়লাভ করে। এরপর পুরোনো শক্তিগুলোও একে একে আসতে থাকে। যেমন, ভারতীয় কংগ্রেসের অনুকরণে গঠিত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল নেপালি কংগ্রেস ও নরমপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল—এরা কমিউনিস্ট নামধারী হলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল। আর নেপালের দক্ষিণাঞ্চলে নতুনভাবে সংগঠিত দলগুলোও বৃহত্তর ফেডারেল ব্যবস্থার পাটাতনে ৮০টি আসন জেতে। ফলে এককভাবে কোনো দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এরা মাধেসি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
কিন্তু এই ভারসাম্য শেষমেশ পক্ষাঘাত সৃষ্টি করে। কারণ, দলগুলো নিজেদের বিভেদ কাটিয়ে উঠে সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হয়। এই অচলাবস্থা দেশটির রাজনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ে। পর পর চারটি জোট সরকারের পতন হয় সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যে। প্রতিবারই যে দলগুলো বাদ পড়েছে, তারা অভিযোগের তির ছুড়েছে।
২০১২ সালে সর্বোচ্চ আদালত সেখানে হস্তক্ষেপ করেন। তাঁরা ডিক্রি জারি করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার মেয়াদের চেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। এরপর তারা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন ঐকমত্যের সরকার গঠন করে। ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ আদালত নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আদেশ দেন। সে নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা কমিউনিস্টদের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করে। মাওবাদীরা মাত্র ৮০টি আসন পায়, আর মাধেসি শক্তিগুলোর আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ৫০-এ।
নতুন সরকার ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারির মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেয়। কিন্তু কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা ও তাঁর কমিউনিস্ট ডেপুটি কে পি ওলি দেশটিকে স্থিতিশীল রাখলেও নতুন সংবিধানের বিষয়ে তাঁরা ঐকমত্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।
দেশটি কিছু মৌলিক বিষয়ে মারাত্মকভাবে বিভাজিত হয়ে আছে। নতুন ফেডারেল নেপাল কি উত্তর-দক্ষিণ অক্ষরেখা বরাবর বিভাজিত হবে, ক্ষমতাসীন দল যেভাবে চায়? যদিও এতে উত্তরের প্রভাবশালী পাহাড়িরা সব জায়গাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, নাকি নতুন রাষ্ট্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত হবে? যার মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশের একটি অংশের মালিকানার বোধ তৈরি হবে?
নেপাল কি সংসদীয় পদ্ধতি গ্রহণ করবে, নাকি প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নাকি দুটোর মিশ্র কোনো ব্যবস্থা? তারা কি উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ফাস্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ভোট-ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নাকি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে?
এই ব্যাপারগুলো কীভাবে সমাধান হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। বিরোধী মাওবাদী-মাধেসি জোট চায়, সিদ্ধান্ত মতৈক্যের ভিত্তিতে নেওয়া হোক। আর ধৈর্যচ্যুত সরকার প্রস্তাব করেছে, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা করা হোক। সংবিধান সভার চেয়ারম্যান সুভাষ চন্দ্র নেমবাঙ তাঁর মতো করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। বিতর্কিত সাংবিধানিক বিষয়ে তিনি প্রশ্নমালা তৈরি করেছেন। সেটা ব্যবহার করা হলে কার্যকরভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণের প্রক্রিয়া জারি হবে। বিরোধীরা তখন থেকেই সংবিধান সভায় যোগদান বন্ধ রেখেছে।
বিরোধীরা তাদের অবস্থানের কারণে ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দল যে সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করছে, তার বিরোধিতা করছে নেপালের বৃহত্তম সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, সংখ্যালঘু কর্মী ও নারী সংঘগুলো। ভারতও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া সমর্থন করছে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ভারত জানে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বোধ কতটা জরুরি। আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বৃহত্তর মানুষের সমর্থনসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবিধান প্রণয়নের কথা বলেছে।
তার পরও নেপালের ক্ষমতাসীন জোটের এ প্রত্যয় রয়েছে যে তাদের আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় আসন তাদের রয়েছে। ফলে গুরুতর বিভেদ তৈরি হয়েছে, যার সঙ্গে মারাত্মক ঝুঁকি যুক্ত রয়েছে।
এই দ্বন্দ্ব ইতিমধ্যে রাস্তায় গড়িয়েছে। বিরোধীদের ডাকা অবরোধে নেপালের জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে। এই সাংবিধানিক সংকটের শিগগির সমাধান না হলে এই অবরোধ হবে দুর্ভোগের শুরু। মাওবাদীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে মোহভঙ্গ হয়ে পড়েছে। রাজতন্ত্রবাদীরা স্বৈরশাসনে ফেরার আশা করছে। মধ্যপন্থীরা মনে করছে, ভাঙনের আশঙ্কা রহিত করার উপায় হচ্ছে ফেডারেল-ব্যবস্থা। আর বিভিন্ন পর্যায়ের জাতিগত বিচ্ছিন্নতাপন্থীরা স্বায়ত্তশাসন চাইছে। প্রয়োজন হলে সবাই ব্যবস্থা নেবে—পরিস্থিতি অনেকটা এ রকম। এ অবস্থায় সাংবিধানিক মীমাংসা না হলে নেপাল আবারও গৃহযুদ্ধে নিপতিত হতে পারে।
প্রতিরোধ শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। মাওবাদীরা ২০১১-১২ সালে তাদের ১৯ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়েছে, এর মধ্যে ১ হাজার ৫০০ নিয়মিত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর বাকিদের পেনশনে পাঠিয়েছে। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, পোড় খাওয়া যোদ্ধাদের অনায়াসেই পুনর্জীবিত করা যাবে। আর অস্ত্রের গোপন ভান্ডার তো আছেই।
নেপালে প্রকাশ্য যুদ্ধ হলে তা চীন ও ভারত কারও জন্যই ভালো হবে না। ধারণা করা হয়, চীন মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সেটা হলে নেপালের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, যে মাত্রায়ই হোক না কেন।
কিন্তু এতে ভারতের দুশ্চিন্তাই সবচেয়ে বেশি। নতুন করে সংঘাত শুরু হলে ভারতের পাহাড়ি জেলাগুলো অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে, আর তার হিমালয় সীমান্ত চীনের আক্রমণের সম্মুখীন হবে। নেপালের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত উন্মুক্ত। গৃহযুদ্ধের সময় অনেক নেপালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের উচিত, এই দ্বন্দ্ব বন্ধে ভারতের শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থান নেওয়া, এমনকি তাতে নেপালিরা খেপে গেলেও। নেপালিরা সাধারণত বিদেশি হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না।
শিগগির কাঠমান্ডুর ওপরে পাহাড়ের বরফ গলতে শুরু করবে। কিন্তু তার রাজনৈতিক পরিসরে বরফ গলার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। স্বর্গ এর আগে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়নি। ক্ষমতা কাঠামোর জন্য এটি এক পরীক্ষা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.