ফেব্রুয়ারি :সেইসব বিদ্রোহী চরিত্র by হিলাল ফয়েজী

'ফেব্রুয়ারি' শব্দটি মানবসভ্যতায় কখন কেমন করে এসেছে জানি না। ফেব্রুয়ারি কিংবা একুশ শব্দ দুটি যে এক জীবনে এমন আবেগ, ব্যঞ্জনা, মহিমার উৎস হবে, বাঙালি জাতিসত্তার একজন না হলে তা উপলব্ধি করা সম্ভব হতো কি! যেহেতু সন্তানের সঙ্গে জননীর যোগ নিবিড়, গভীর এবং একান্ত, অতএব আমরা পিতৃভাষা শব্দের বদলে মাতৃভাষা শব্দটিই ব্যবহার করি। শিশু মায়ের কাছ থেকেই শেখে যে ভাষা। পৃথিবীতে যত জাতির যত ভাষা আছে, সবই সে অর্থে মায়ের ভাষা। সবার কাছেই মায়ের ভাষা প্রিয়তম। আমরা তো পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার বিপক্ষে নই। প্রতিটি ভাষা উন্নততর হোক এটা তো আমরা চাই। প্রধানত, উত্তর ভারতের ভাষা উর্র্দুতেও আছে কত মহত্তম ভাবনার আধার, কত সৃজনী সুষমা। আমরা বাঙালিরা তো কখনও অন্য কোনো ভাষার ওপর আমাদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইনি। নবগঠিত পাকিস্তানের শাসকরা কেন এমন বলদর্পী, গোঁয়ার এবং হিংস্র হয়ে উঠল, উর্দু ভাষাটিকে আমাদের পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইল। কেউ কেউ চাইল, বাংলার অক্ষরলিপিই থাকবে না। রোমান কিংবা আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে। বাংলাভাষী সব ধর্ম-জাতপাত-গোষ্ঠীর তো অন্য ভাষায় বাংলা হরফ চাপিয়ে দেওয়ার বিকৃত এবং জঘন্য মনোবৃত্তি কখনোই হয়নি।
এই ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫তম দিবসে ১৯৪৮ সালে একজন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান, পাকিস্তানের সে সময়কার রাজধানী করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পেশকৃত রাষ্ট্রভাষা বিলে ইংরেজি আর উর্দুর পাশে বাংলাকেও যুক্ত করার কোমল অথচ লৌহদৃঢ় প্রস্তাব জানালেন। অমনি ইতিহাস-মূর্খ একদল উগ্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সেই গণপরিষদে ধীর মস্তিষ্ক ধীরেন্দ্রনাথের ওপর। এভাবে শাসকগোষ্ঠীর বেপরোয়া হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মায়ের ভাষার সপক্ষে একজন সন্তানের এমন সাহসী উচ্চারণ ফেব্রুয়ারি মাসটিকেই ধন্য করেছে।
এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দেশভাগের সময় ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সে দেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঠাঁই করে নিতে পারতেন। না, যাননি তিনি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বের বৈষম্যকে তিনি তেমন গ্রাহ্যেই আনেননি। ১৯৭১ সালে তাকে কুমিল্লার বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সেই থেকে আজও তার সন্ধান মেলেনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রভাষা নকশাটি তিনি অঙ্কুরেই গণপরিষদ অধিবেশনে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। ভাষা সংগ্রামের বীরনায়ক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানাই।
ফেব্রুয়ারিজুড়ে এমনি অনেক কাজ, ঘটনা, সুখ, দুঃখ গৌরবের কাহিনী দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে-জড়িয়ে আছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার 'আসামি' সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন প্রতিবাদে টর্নেডো উঠেছিল বিশেষত ঢাকা মহানগরীতে। কাহিনীটি ১৯৬৯-এর।
ইতিহাসের মহান গণঅভ্যুত্থানের সেই ঊনসত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি মতিহার নামক স্থানে গড়ে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর হামলা করতে উদ্যত হলো পাকিস্তানি বাহিনী। দৌড়ে ছুটে গেলেন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। পিতৃসব শিক্ষক সন্তানসম ছাত্রদের বাঁচাতে গেলেন। ওই হিংস্র বাহিনীর বুলেট শিক্ষকের মতো শিক্ষকের বুক বিদীর্ণ করে। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বুদ্ধিজীবী শহীদ শামসুজ্জোহার নৃশংস মৃত্যু দেশজুড়ে সৃষ্টি করে বিদ্রোহী তরঙ্গ। পাকিস্তানি শাসকরা সেনা দুর্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ওই ফেব্রুয়ারিতেই এবং ফেব্রুয়ারির এক শেষ বিকেলে তিনি 'বঙ্গবন্ধু' সম্বোধনে বাংলা মায়ের প্রবল স্নেহে প্লাবিত হন।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিনটি কি জানত পরদিন ২১ তারিখটিই অমন বিশাল এক স্থানজুড়ে নেবে বঙ্গ জাতিসত্তার হৃদয় জমিনে! না, কেউ জানত না। ২০ তারিখে কত যে কাজ, শলাপরামর্শ, ভাবনা। শাসকরা বিক্ষোভের সব সুযোগ, সব সড়ক, সব পথ বন্ধ করে দেবে। আমরা তাই মেনে নেব? না, বাংলার তরুণরা ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিষেধ না মানার চিরন্তন শির উঁচু করল মায়ের ভাষার প্রতি প্রবল দরদে। ২০ ফেব্রুয়ারির আয়োজনে ২১ ফেব্রুয়ারি অতঃপর শাসকের বুলেটে, শহীদের রক্তধারায় 'অমর একুশে' হয়ে গেল বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে। অবশেষে একদিন জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠান ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা জানাল।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে আমরা একদল কিশোর-তরুণ একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে শামিল হওয়ার সুর সন্ধান পেয়েছিলাম। সেই সুরের সাধক একজন মুন্সীগঞ্জের কাজী আকরাম হুসেন, ডাকনাম হারুন। অবশ্য আকরাম নামেই তার সর্বাধিক পরিচিতি। সেই ষাটের দশকে আকরাম প্রবাহিত হলো ছাত্র ইউনিয়নের সি্নগ্ধ কর্মধারায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সৃজনের পাগলপারা আনন্দধারায়। বিপন্ন মানুষের পাশে এবং অতঃপর বাঙালি জাতিসত্তার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতর কর্মপ্রবাহ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। নবজাত বাংলাদেশে কাজী আকরাম হয়ে উঠলেন ছাত্র ইউনিয়নের দিশারী নেতায়। বাঙালি জাতিসত্তার সেরা প্রতিনিধিকে ১৯৭৫ সালে বধ করার পর জেনারেল শাসন যখন কালো মেঘের মতো ছেয়ে দিল স্বদেশকে, তখন বিদ্যুৎ আলো হয়ে দেখা দিল আকরাম নেতৃত্ব। জেনারেল এলেন সংগ্রামতীর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করতে। জেনারেলের যাত্রাপথে শুয়ে পড়লেন আকরাম এবং তার সাথীরা। জেনারেল বললেন, আমি রাজনীতি ডিফিকাল্ট করে দেব চিরতরে। আকরাম তার তীক্ষষ্ট বিদ্রোহী কণ্ঠে জানালেন, জেনারেল, আমরা তোমার শাসনামল ডিফিকাল্ট-জটিল করে দেব। আকরামের অসংখ্য সৃজনী স্লোগানের একটি ছিল, 'বাংলাদেশী আজব চিজ/জিয়ার কাঁধে শাহ আজিজ।' আসলে জেনারেল জিয়ার ওপর অর্পিত টাস্ক ছিল, ইতিহাসের গভীর থেকে সাম্প্রদায়িক বিষাক্ততা এনে বাংলাদেশকে চিরদূষিত করে দাও। সে দূষণের পেট্রোল বোমায় বাংলাদেশ এখন জ্বলছে, পুড়ছে।
২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলন এবং ক্ষেতমজুর আন্দোলনের দীঘকালীন সেনানী কাজী আকরাম হঠাৎ বাংলা জমিন থেকে দূর আকাশে চলে গেলেন। এই তেজিয়ান-দৃপ্ত-মানবিক-বন্ধুবৎসল সত্তাটির হঠাৎ চলে যাওয়া তার নিকট ভুবনকে আলোড়িত করে গেছে। আকরামকে নিয়ে একটি স্মরণ রচনা কিছুকাল আগে প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর নজরে এসেছিল। তিনি আমাকে ডেকেছিলেন। আকরামের বিদ্রোহী সত্তাটি নিয়ে প্রবল আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তার রচনায় আকরাম এবং আকরামের মতো নানা চারিত্র্য নিয়ে লিখবেন বললেন। আসলে মানবেতিহাস তো অজস্র আকরাম এবং আকরামসম সাথীদের নিয়েই নির্মিত। ফেব্রুয়ারির মতো এমন মহান মাসের ২০তম দিবসে আকরাম-প্রয়াণও সুন্দর পৃথিবী রচনার সোপানসম বোধ জাগ্রত করে। স্মরণের অঞ্জলি প্রিয়বন্ধুকে।
মুক্তিযোদ্ধা, প্রকৌশলী

No comments

Powered by Blogger.