কর্মর্নাশা অবরোধের দেড় মাস

অবরোধের ৪৫ দিন গেছে গতকাল বৃহস্পতিবার। বলা যায়, কর্মনাশা দেড় মাস সময় আমরা কাটিয়েছি। এ সময়ের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ রয়েছে প্রায় সব সংবাদপত্রে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে_ নিহত ৯৬, গাড়ি ভাংচুর ও আগুন এক হাজার ১৪৯টি, রেলে নাশকতা ১৩টি। এ চিত্র কে দেখতে চায়? একই দিনে শিল্প ও বণিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের হরতাল-অবরোধে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, প্রতিদিন এখন তাদের ক্ষতি হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বলা যায়, মাত্র ১০ দিনের ক্ষতির টাকায় বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আর্থ-সামাজিক প্রকল্প পদ্মা সেতুর ব্যয় মেটানো সম্ভব। গত দেড় মাসে আমরা নিজেদের যে ক্ষতি করেছি তা দিয়ে প্রায় পাঁচটি পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। কী অপরিণামদর্শী আমরা! বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায়। এখনও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে দেশের মানুষ। কৃষক ও ক্ষেতমজুররা মাঠে শ্রমে-ঘামে ফসল ফলাচ্ছেন। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন কল-কারখানায়। প্রবাসে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি তাদের উপার্জিত অর্থ নিয়মিত দেশের স্বজনের কাছে প্রেরণ করছেন। সবার অভিন্ন স্বপ্ন ও লক্ষ্য_ দেশকে উন্নত করে তুলবই। কিন্তু হরতাল-অবরোধের মতো আত্মঘাতী কর্মসূচি চলতে থাকলে এ লক্ষ্য অর্জন যে কঠিন হয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। বৃহস্পতিবার সমকাল আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম : 'বন্দরে আটকা সাত হাজার গাড়ি'। এতে বলা হয়, ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় বন্দর থেকে গাড়ি খালাসের সংখ্যা কমে গেছে। নাশকতার আশঙ্কায় বন্দর থেকে গাড়ি বের করছেন না আমদানিকারকরা। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরের শোরুমে গাড়ির সংখ্যা কম। হরতাল-অবরোধ কিংবা রাজপথে যে কোনো ধরনের সহিংসতার অন্যতম প্রধান টার্গেট থাকে যানবাহন। গত দেড় মাসের হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন গড়ে ২৫টির বেশি বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কার ভাংচুর বা আগুনে পোড়ানো হয়েছে। বাস-ট্রাকে আগুন দেওয়ার সময় চালক ও যাত্রীদের নেমে আসার সময় পর্যন্ত দেওয়া হয় না। এ অবস্থায় বন্দর থেকে নতুন গাড়ি খালাস করার ঝুঁকি অনেকেই নিতে চাইবেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কাও করছেন। এখন বন্দরে যেসব গাড়ি খালাসের অপেক্ষায় সেগুলো বাজারে কবে আসবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এক সময় মন্ত্রীদের কেউ কেউ বেশ উচ্চস্বরে বলছিলেন_ সাত দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনগণ কিন্তু তাদের কথায় ভরসা রাখতে চেয়েছিল। ব্যবসায়ীরাও মনে করছিলেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। বিদেশি কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। 'আন্দোলনকারীদের' কাছে আকুতি প্রকাশ করছেন। নাগরিক সমাজের নামে একদল আহ্বান জানিয়ে চলেছেন 'সংলাপের'। তার জবাব সরকারের তরফে আসছে একভাবে, হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীরা বলছে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। সরকার বলছে, আগে সহিংসতা বন্ধ হোক, তারপর অন্য সব বিষয়। 'আন্দোলনকারীরা' বলছে, 'গণতন্ত্রের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার' করতে হবে। ১৫ লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর জন্য হরতাল শিথিল করার আকুল আবেদনের জবাব এসেছে ঔদ্ধত্যে_ 'কীসের পরীক্ষা?' প্রকৃতই ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের জনগণ আজ এমন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা থেকে বের হয়ে আসা চক্রবূ্যহ ভেদ করার মতোই কঠিন মনে হচ্ছে। কিন্তু পথের সন্ধান তো পেতেই হবে। হরতাল-অবরোধ জনগণ পছন্দ করছে না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নানাভাবে চেষ্টা করেও দেশের কোথাও জনগণকে রাজপথে শামিল করাতে পারছে না। এমনকি তাদের একনিষ্ঠ কর্মী-সমর্থকরাও পথে নেই। সহিংসতার মাধ্যমেই তারা লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট রয়েছে। সব মহল থেকেই আবেদন এসেছে হিংসাত্মক পথ ছেড়ে আসার। একটি গণতান্ত্রিক দেশে তারা যে ধরনের পথ অনুসরণ করছে সেটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যে কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নেই তাকে আন্দোলনে বলা চলে না। আমরা আশা করব, শুভবুদ্ধির জয় হবে। দেশ ও দশের স্বার্থ সবার ওপরে বিবেচিত হবে। সরকারও আরও ধৈর্য, সহনশীল ও উদার মনোভাব নিয়ে দেশ পরিচালনায় মনোযোগী থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.