প্রধানমন্ত্রী খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন by রুদ্র মিজান

শুকুর আলী। লেখাপড়া জানেন না। প্রয়োজনে টিপসই দেন। এমন কি মোবাইল ফোনের বাটন টিপতে জানেন না। সেই শুকুর আলী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছে পুত্র সিজানও। জেএসসি পরীক্ষার্থী সিজান আদৌ পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তার অপরাধ মোবাইলফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে জড়িয়ে অশালীন কটূক্তিমূলক কার্টুন-ভিডিও দেখা ও শোনা। পরিবারের উপার্জনক্ষম পিতা-পুত্র গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে হতদরিদ্র এই পরিবারটি। ওই এলাকার লোকজন মনে করেন, দলীয় ও সরকারি ফায়দা হাসিলের জন্য হতদরিদ্র এই পরিবারকে হয়রানির মুখে ঠেলে দিয়েছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। ঘটনাস্থল বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলার শীতলাই গ্রাম। এ ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে। পিতা-পুত্রের গ্রেপ্তারে দরিদ্র পরিবারটি পথে বসলেও এলাকার মানুষই খাদ্য ও অর্থ দিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাদের পাশে। এলাকাবাসী বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা ও চাল তুলে এই পরিবারের খাদ্য সংস্থান করছে।

সরজমিন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঘটনার সময় গত ১৭ই অক্টোবর কাহালু থানায় ছিলেন আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি ও পৌর মেয়র হেলাল উদ্দিন কবিরাজ, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ও মুরইল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম গফ্‌ফার। তাদের পরামর্শেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সমিত কুমার কুণ্ডু মামলা রেকর্ড করেন। অবশ্য তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে থানায় অবস্থানের কথা স্বীকার করেছেন স্থানীয় এই দু’নেতাই। ওই মামলার দুই সাক্ষীর একজন আবদুল করিম গফ্‌ফার। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় শুকুর আলী ও তার পুত্র সিজান মোবাইলফোনে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনের ভিডিও অন্যদের দেখাচ্ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ শুকুর আলীর বাড়িতে গেলে দর্শকরা পালিয়ে যায়।’ তাৎক্ষণিকভাবে শুকুর আলী ও মোবাইলফোনসহ সিজানকে আটক করা হয়। ওই সময়ে দুই সাক্ষীসহ আশপাশের লোকজন উপস্থিত ছিলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হলেও প্রথম সাক্ষী আবদুল করিম গফ্‌ফার জানান, তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি তখন থানায় ছিলেন। থানায় কেন ছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম।
শুকুর আলীর স্ত্রী কল্পনা আক্তার ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, লোকজনকে কার্টুন-ভিডিও দেখানো বা শোনানোর অভিযোগ সত্য নয়। প্রতিবেশী মিন্নিকা বেগম জানান, তাদের ঘরে শুকুর ও সিজান ছাড়া কেউ ছিল না। ওই দিন ঘরে বসে জলপাইয়ের আচার তৈরি করছিলেন শুকুর। গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটতে হাওরে ছিলেন তার স্ত্রী কল্পনা। মেয়ে দু’টি বাইরে খেলাধুলা করছিল। জুমার নামাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সিজান। এর মধ্যেই কাহালু থানার ওসি সমিত কুমার কুণ্ডু ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলহাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ এসে তাদের আটক করে। প্রতিবেশীরা অবাক হন। নিরীহ ও ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত পিতা-পুত্রকে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা তা বুঝতে পারেননি। তখন পর্যন্ত প্রতিবেশীরা জানতেন না কি অপরাধ তাদের। এমনকি ওই দিন বিকাল পর্যন্ত গ্রামবাসী তা জানতে পারেনি। গ্রেপ্তারের পর থানায় যান কাহালু ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ও শীতলাই গ্রামের তরুণ ফাহিম আহমদ সুমন। কিন্তু গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন ওসি সমিত কুমার কুণ্ডু। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুকুর ও সিজানকে গ্রেপ্তারের পর কোন ধারায় মামলা রেকর্ড করবেন এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন ওসি। দীর্ঘ সময় তিনি এ বিষয়ে পরামর্শ করেন আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি ও পৌর মেয়র হেলাল উদ্দিন কবিরাজ ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানের সঙ্গে। সর্বশেষ ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলাটি রেকর্ড করেন। তবে পরামর্শের বিষয় অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও ওসি। পৌর মেয়র হেলাল উদ্দিন কবিরাজ বলেন, আমি ওই দিন থানায় যাইনি। ওসি আমার সঙ্গে কোন পরামর্শ করেনি। বিষয়টা শুনেছি। এটা একটা গুরুতর অপরাধ। আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ওই দিন বিকালে থানায় ছিলেন স্বীকার করে বলেন, একটা কিশোর গ্রেপ্তার হয়েছে জেনে আমি থানায় যাই। পরে ওসি মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় শুকুরকে গত ২৭শে অক্টোবর একদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। বর্তমানে তিনি বগুড়া কারাগারে আছেন। তার পুত্র সিজানকে রাখা হয়েছে কিশোর সংশোধনাগার যশোরে। এ ঘটনায় দলীয় কোন তদবির ছিল না জানিয়ে ওসি সমিত কুমার কুণ্ডু বলেন, দুই-তিন দিন ধরে ওই কার্টুন-ভিডিওটি বিভিন্ন জনকে দেখাচ্ছিল সিজান। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে আটক করে।
কি ছিল সেই কার্টুন-ভিডিওতে: পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কার্টুন ছিল একটি বিড়ালের। এতে ছিল মানুষের বিকৃত কণ্ঠ। যা যান্ত্রিকভাবে করা হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে জড়িয়ে আপত্তিকর কথা ছিল। এই কার্টুন-ভিডিও যে সিজানের কাছে ছিল তা তাদের প্রতিবেশীরাও জানতেন না। প্রতিবেশী মকসেদ আলী জানান, গ্রেপ্তারের পরে তারা জেনেছেন সিজানের মোবাইলফোনে একটা ভিডিও পাওয়া গেছে- যা প্রধানমন্ত্রীর জন্য মানহানিকর। এই জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। শুকুর আলীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। মকসেদ আলী বলেন, শুকুর তো মোবাইলফোন টিপতে জানে না। তাকে গ্রেপ্তার করা হলো কেন? প্রতিবেশীরা জানান, তারা কেউ কার্টুন-ভিডিওটি দেখেননি বা শোনেননি।
হতদরিদ্র শুকুর আলীর পরিবার: শুকুর আলীর পিতার বাড়ি গাইবান্ধা জেলা সদরের বাদিরাখালী গ্রামে। তার পিতা মৃত শমসের আলী। প্রায় ২০ বছর আগে থেকে কাহালু উপজেলায় ফেরি করে বাদাম, আমড়া, জলপাইসহ বিভিন্ন প্রকার আচার বিক্রি করতেন তিনি। এক পর্যায়ে শীতলাই গ্রামের কাশেম আলীর কন্যা কল্পনা আক্তারকে বিয়ে করে এখানেই থেকে যান। গত শনিবার গ্রামের রেললাইনের উত্তর পাশে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সরকারি জমিতে ঝুপড়ি একটি ঘরই তার সম্বল। ঘরে টিনের একটি ভাঙা দরজা। ভেতরে একটি নড়বড়ে চৌকি। এখানে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে থাকতেন শুকুর। পাশের কক্ষে একটি বাঁশের মাচা। সেখানে থাকতো তার পুত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সিজান। একটা বাক্সের মধ্যে রাখা আছে তার বই। আছে একটি গবাদি বাছুর। ঘরের বারান্দায় থাকে বাছুরটি। ঘরের চারদিকে অন্যের ধানি জমি। ভূমি-সম্পদহীন শুকুর আলীর সিজানসহ তিন সন্তান। মেজো সন্তান শিলা দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। ছোট্ট কন্যা সুমাইয়ার বয়স চার বছর। পরিবারের উপার্জনক্ষম শুকুর আলী ও তার পুত্র সিজান গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই পরিবার। কন্যা সন্তানকে নিয়ে অসহায় স্ত্রী কল্পনা। গ্রামের কয়েক তরুণ গত ২৪শে অক্টোবর ঘরে ঘরে গিয়ে এই পরিবারের জন্য প্রায় ৩৫ কেজি চাল সংগ্রহ করেছেন। মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার সাধ্য নেই শুকুর আলীর স্ত্রীর। সেখানেও এগিয়ে গিয়েছেন গ্রামবাসী। ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলে শুকুরের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। সরকারি জমিতে মাটির ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন শুকুর আলীসহ ১৪ পরিবার। হতদরিদ্র প্রতিটি পরিবারের কেউ রিকশা, কেউ ভ্যানচালক। এর মধ্যে মোবাইলফোন আছে মাত্র চারটি পরিবারে। প্রতিবেশী হামেদ আলী জানান, গত ঈদের আগে শুকুরের কাছ থেকে ৫ শ’ টাকা দিয়ে একটি মোবাইলফোন কেনে সিজান। কিন্তু শুকুর মোবাইলফোনের বাটন টিপতে জানেন না। হামেদ আলী, মকসেদ আলী, আফসার আলীসহ গ্রামের লোকজন মনে করেন, সরকারকে খুশি করার জন্য পুলিশ এটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। এ কারণে স্বয়ং ওসি গিয়ে তাদের আটক করেছে। দলের ঊর্ধ্বতন নেতাদের খুশি করতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা অতিউৎসাহী হয়ে এই হতদরিদ্র পরিবারকে হয়রানির মুখে ঠেলে দিয়েছেন বলে গ্রামবাসী মনে করেন। শুকুর আলীর স্ত্রী কল্পনা আক্তার জানান, তার স্বামী অ্যাজমা রোগী। উচ্চ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। কয়েক দিন পর সিজানের জেএসসি পরীক্ষা। বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ঘর তৈরি করেছিলেন। তার স্বামী জেলে যাওয়ার পর ঋণের কিস্তি দেয়া দূরে থাক গ্রামবাসীর দয়ায় খেতে পারছেন। সব কিছু মিলিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার। মুরইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন আজাদ বলেন, শুকুর কোন দলের রাজনীতি করেন না। মিছিলে যান না। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষ। রোজ আনেন রোজ খান। কিভাবে যে কি হলো তা বুঝতে পারছি না। অসহায় এই পরিবারটির পাশে গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি।
সিজানের পরীক্ষা: শীতলাই সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সিজান হোসেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সিজান সম্পর্কে ওই মাদরাসার শিক্ষক আজিজার রহমান জানান, মাদরাসা থেকে যে কয়েক ছাত্র এ প্লাস অর্জনে সম্ভাবনাময় সিজান তাদের একজন। সে অত্যন্ত মেধাবী। আগামী ৭ই নভেম্বর তার জেএসসি পরীক্ষা। এর মধ্যে যদি সে জামিনে বের হতে না পারে তাহলে পরীক্ষা দিতে পারবে না। তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সম্পর্কে ওই শিক্ষক জানান, তাদের জানামতে সিজান এরকম ছেলে না। এটা কোন ষড়যন্ত্র হতে পারে।
বিষয়টি এখন ছড়িয়ে পড়েছে এলাকা ছাড়িয়ে, জাতীয় মিডিয়ায়। এমন একটি বিষয় আসলেই হতভম্ব করেছে অনেককেই, প্রধানমন্ত্রীকেও করবে নিঃসন্দেহে। অনেকের আবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে, তিনি যেন খুঁজে দেখেন এই মানবিক বিষয়টি।

No comments

Powered by Blogger.