শিশুর জন্মগত হৃদরোগ by ডা. মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ

হৃদরোগ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন- জন্মগত হৃদরোগ, বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপজনিত হৃদরোগ, হৃদপেশীর দুর্বলতাজনিত হৃদরোগ। হৃদরোগ সাধারণত মারাত্মক হয় এবং এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। প্রায় সব রকমের হৃদরোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে। সময়মতো এ ব্যবস্থা নিলে রোগের হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এমনকি কিছু ব্যবস্থা আছে যা গ্রহণ করলে জন্মগত হার্টের অসুখ থেকে অনাগত শিশুও মুক্ত থাকে।
জন্মগত হৃদরোগের লক্ষণ
*কোনো কারণ ছাড়াই বুকে অবিরাম কফ থাকে।
*ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস, দেখা যায় শিশু প্রতি মিনিটে ৫০-৬০ বার শ্বাস নেয়।
*একটু পরিশ্রম করলেই শিশুর শরীর নীলাভ হয়ে যায়।
*বুক ধড়ফড় করে।
*বুকের বাঁ দিকের খাঁচা বড় হয়।
*কখনও যকৃৎ বড় হয় এবং শক্ত থাকে।
*শিশু অতিরিক্ত ঘামে।
*দৈহিক বৃদ্ধি হয় না।
জন্মগত হৃদরোগের কারণ
নবজাতকের হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র হওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। কারও কারও মতে, সন্তান ধারণের সময় মায়ের বয়স ৩৫ বছরের বেশি হলে এ সমস্যা হতে পারে। মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে বা পাহাড়ে বসবাস করলে বা ঋতুচক্রের শেষদিকে গর্ভধারণ হলে এ ধরনের ত্র“টি নিয়ে শিশুর জন্ম হওয়ার আশংকা থাকে।
এছাড়া গর্ভাবস্থায় কিছু ভাইরাসজনিত রোগ যেমন- হাম, রুবেলা, মাম্পস, জলবসন্ত প্রভৃতি রোগে যদি মায়েরা ভোগেন, তাহলে হৃৎপিণ্ড ছিদ্র নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়েরা যদি স্টেরয়েড ওষুধ, খিঁচুনির ওষুধ বা থ্যালিডোমাইড জাতীয় ওষুধ খান, তাহলে শিশু হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে জন্ম নিতে পারে। কখনও দেখা যায়, কোনো মা হৃৎপিণ্ডে ত্র“টি নিয়ে প্রথমবার শিশুর জন্ম দিলে দ্বিতীয়বার সে রকম ত্র“টি হওয়ার ঝুঁকি মাত্র চার-পাঁচ ভাগ থাকে। দ্বিতীয়বার শিশুর এ সমস্যা থাকলে তৃতীয়বার তা হওয়ার আশংকা ২২ থেকে ২৫ ভাগ হয়।
রোগের প্রকারভেদ
ব্লু বেবিজ হৃদরোগ (নীলাভ)
এ ধরনের হৃদরোগের ক্ষেত্রে শিশু খুব কাঁদে এবং হাঁটা অথবা দৌড়ানোর সময় শরীর নীল হয়ে যায়। এই নির্দিষ্ট লক্ষণ যাদের দেখা যায় তাদের ব্লু বেবিজ বলে। এ শিশু অজ্ঞান হয়ে যায়। এমনকি মারাও যেতে পারে। এই ডিজিজ কম হলেও এ সম্পর্কে জেনে রাখা জরুরি।
ছিদ্রজনিত হৃদরোগ (অনীলাভ)
জন্মগত হৃদরোগের বাইরে আরেক ধরনের হৃদরোগ বিলম্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেটা হল রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ। এ রোগের লক্ষণ হল- শিশুর ওজন না বাড়া, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয়া, দুধ টানতে কষ্ট, ঘন ঘন নিউমোনিয়া হওয়া।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
চিকিৎসক বুকে স্টেথিসকোপ লাগিয়ে বুঝতে পারেন, শিশুর হৃৎপিণ্ডে কী ধরনের জন্মগত ছিদ্র রয়েছে। এরপরও বুকের এক্স-রে, ইসিজি, ইকো, রক্ত পরীক্ষা করে সহজেই রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। শিশু হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে চলাফেরা করতে পারে। এ রোগের তিন ধরনের চিকিৎসা আছে।
*ওষুধের মাধ্যমে।
*ইন্টারভেনশন বা বিনা অপারেশনে পাইপের মাধ্যমে।
*ওপেন হার্ট সার্জারি।
সাধারণত এএসডি, পিডিএ, ভিএসডি- এ ধরনের শিশুরা চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। কিছু রোগীকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ দেয়া হয়, যাতে সে অপারেশন করা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
এছাড়া রোগীকে জীবন রক্ষাকারী ইন্টারভেনশন যেমন- অলিন্দে ছিদ্র করা, নবজাতকের অতি চিকন বাল্ব ও রক্তনালীতে বেলুন করাসহ নানা চিকিৎসা দেয়া হয়। এছাড়া রোগী নীলাভ রোগে ভুগলে তাকে অবশ্যই অপারেশন করাতে হবে।
যদি শিশুর সমস্যা তেমন না দেখা দেয় বা শরীর নীল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা না হয় বা শ্বাসকষ্ট না থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শেই তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। শিশু একটু বড় হলে বা এমনিতেই ছিদ্র বন্ধ না হলে তখন চিকিৎসা করাতে হবে।
চিকিৎকের পরামর্শ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে সর্দি-কাশিরও চিকিৎসা করাতে হবে। ছিদ্র যদি বড় থাকে কিংবা বন্ধ না হয় বা নানা ধরনের বড় সমস্যা দেখা দেয় বা শিশুর বৃদ্ধি ক্রমশ ব্যাহত হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে ছিদ্রে বেলুন বাল্ব প্লাস্টি বা অন্যান্য অস্ত্রোপচার পদ্ধতিতে তা বন্ধ করতে হবে।
সাধারণত ৩০-৪০ ভাগ শিশুর ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ডের এ ছিদ্র আপনা আপনি সেরে যায়। কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। তবুও সতর্ক থাকা ভালো।
শিশুর দৈনন্দিন জীবনে সতর্কতা
শিশুদের অ্যাকোয়ার্ড বা পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত হৃদরোগের আশংকা কমাতে এবং শরীর সুস্থ রাখতে জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। বড়দের হার্টের অসুখ নিয়ে এখন সবাই যতই সচেতন হয়ে উঠুক না কেন, ছোট থেকে সতর্ক হলেই বেশি বয়সে অনেক সমস্যা এড়ানো যায়।
*শিশুরা যাতে কোনোভাবেই অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্থ না হয়ে পড়ে সেদিকে নজর দিন। পড়াশোনা, কম্পিউটারের পাশাপাশি ওদের খেলাধুলা আর ব্যায়ামের ওপর জোর দিন। এক্ষেত্রে খুব ভালো ব্যায়াম হল সাঁতার কাটা।
*পরিবারে কারও উচ্চরক্তচাপ থাকলে শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া দরকার। তাদের খাবারে যেন অতিরিক্ত বা আলগা লবণ না থাকে। চিপস, কিছু বিস্কুট, নুডলসের মতো খাবারে বেশি আলগা লবণ থাকে। কাজেই তা বেশি খাওয়া ঠিক নয়।
*যে কোনো ধরনের ফাস্টফুড না খাওয়াই ভালো।
*শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেক, পেস্ট্রি, চকোলেটের মমো উচ্চ ক্যালরি ও চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।
*শিশু খাবারে ফল, শাকসবজির পরিমাণ বাড়ান।

No comments

Powered by Blogger.