নগর সম্প্রসারণ ও স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জ by ধীরাজ কুমার নাথ

নগর স্বাস্থ্যসেবায় প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে- সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শহর এলাকায় ২০১৬ সালের মধ্যে মহিলাপ্রতি গড় সন্তান সংখ্যা ২-এ হ্রাস করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের মধ্যে অর্জিত হয়েছে বলে জরিপে দেখা গেছে। বাংলাদেশে নগরমুখী অভিবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা নিয়ে এ জরিপ পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশ নগর স্বাস্থ্য সার্ভে ২০১৩ নামক জরিপটি পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (নিপোর্ট)। আর্থিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস এইড। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালেও নিপোর্টের উদ্যোগে নগর স্বাস্থ্য সার্ভে করা হয়েছিল। লক্ষণীয়, বিগত ৭ বছরে নগরকেন্দ্রিক অভিবাসন, আবাসনের পরিধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও বহুমুখী বিস্তার, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান এবং জনগণের সচেতনতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ পরিস্থিতি একদিকে যেমন স্বস্তিদায়ক, অপরদিকে শহরমুখী অভিবাসন বাড়ায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে।
এ সমীক্ষায় উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে, ২০২৮ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাত কোটি ৯৫ লাখ লোক শহরে বসবাস করবে, যা বর্তমানে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ। অর্থাৎ শহরের জনসংখ্যা বাড়বে ব্যাপক হারে। গ্রামেগঞ্জে জনবসতি হ্রাস পাবে এবং শহরমুখী অভিবাসন ঘটবে দ্রুতগতিতে। বেশি সুযোগ-সুবিধা মানুষকে শহরের প্রতি আকৃষ্ট করবে। পরিবেশের বিপর্যয়ও জনগণকে শহরের দিকে ধাবমান করবে। ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং জনগণের কর্মপরিধিতে নতুন ক্ষেত্র ও মাত্রা সংযোজন হবে।
সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে, ৭৫ শতাংশ বস্তিবাসী মাত্র একটি ঘরে বসবাস করে। এছাড়া বিপুলসংখ্যক বস্তিবাসী শৌচাগার ব্যবহার করে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এবং তাদের জল নিষ্কাশন ও ময়লা আবর্জনা দূরীকরণের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। দুর্গন্ধ তাদের জীবনযাত্রার নিত্য সহচর।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় সব বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে এবং ৯০ শতাংশ গৃহে কমপক্ষে একটি মোবাইল ফোন আছে। বস্তিগুলোতে মোবাইল ফোনের হার ২০০৬ সালে ছিল ২০ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বস্তির ৮০ শতাংশ মহিলা টেলিভিশন দেখে এবং তাদের ৪৯ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণীর ঊর্ধ্বে। উল্লেখ্য, বস্তিতে বসবাসকারী দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গ্রাম থেকে অভিবাসনের মাধ্যমে শহরে এসেছে। ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারীদের প্রতি পাঁচজনের একজন এসেছে বরিশাল বিভাগ থেকে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে আসা বস্তিবাসীর সংখ্যা নগণ্য।
উৎসাহজনক বিষয় হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নগরবাসী ভালো অবস্থায় আছে। প্রায় ৫৮ শতাংশ বস্তিবাসী এবং ৫৩ শতাংশ শহরের অ-বস্তিবাসী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেবা পেয়ে থাকে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই তাদের প্রায় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ রয়েছে, যা পল্লী এলাকায় কল্পনামাত্র।
স্বাস্থ্যসেবার সহজ প্রাপ্তি সরকারি ও বেসরকারি নগরায়নের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে প্রতিভাত হয় যে, প্রজনন প্রক্রিয়া, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যনীতির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই নগরবাসীর অগ্রগতি ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নগরে মোট প্রজনন হার ২০১০-১৩ সালে
মহিলা প্রতি দুইয়ে নেমে এসেছে এবং বস্তি এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার হার ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আশা করা যায়, ২০১৬ সালের মধ্যে এ হার ৭২ শতাংশে উন্নীত হবে, যা হবে তৃতীয় বিশ্বে উদাহরণ। তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহীতাদের মাঝে তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। যদিও গর্ভ-পূর্ব ও গর্ভ-পরবর্তী সেবা গ্রহীতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে এবং কোনো কোনো বস্তিতে প্রতি ১০ জনের ৯ জনই এমন সেবা গ্রহণ করছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় শহরবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে।
কিন্তু কিশোরীদের মধ্যে সন্তান ধারণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বস্তি ও অন্যান্য শহর এলাকায় ২০ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচজনের একজন কিশোরী মা হয়েছেন এবং বস্তি ও অবস্তি এলাকায় বিগত বছরগুলোতে
কিশোরী মাতৃত্ব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটি ভাবনার বিষয়। তবে সন্তান ধারণের আকাক্সক্ষায়
ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সিটি কর্পোরেশনের অ-বস্তি এলাকায় মহিলাপ্রতি গড় সন্তান বা টিএফআর সবচেয়ে কম, মাত্র ১.৭ এবং বস্তি এলাকায় বেশি, মাত্র ২ এবং অন্যান্য শহর এলাকায় মহিলাপ্রতি গড় সন্তান ১.৯ মাত্র। এ অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক।
শহরের লোকসংখ্যা বাড়ছে। জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বৃহত্তর ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা বর্তমানে এক কোটি ৭০ লাখ এবং এ সংখ্যা ২০৩০ সালে হবে দুই কোটি ৭০ লাখ। ঢাকা হবে বিশ্বের ষষ্ঠ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। জনগণের অভিবাসন বা শহরমুখী জনসংখ্যা বৃদ্ধি স্বাস্থ্যসেবার মান ধরে রাখতে পারবে কিনা তা ভাবনার বিষয়।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৬.৫ শতাংশ বর্তমানে (২০১৪) গ্রামে বসবাস করে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে শহরে বসবাসকারী ছিল মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, যা বর্তমানে হয়েছে ২৮ শতাংশ এবং গবেষণা বলছে, ২০৩৯ সালের আগেই ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ শহরে বসবাস করবে। এর অর্থ হচ্ছে, বদলে যাবে জনগণের জীবনধারা, মানুষের
পরিচয় ও স্থায়ী ঠিকানা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময় গ্রাম বিরান
হওয়ায় শহরে আশ্রয় নিয়েছে
মানুষ, আজ তেমনি এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত বাংলাদেশ।
জনসংখ্যার শহরমুখী অভিবাসন বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও সরকার নিজেই দিনের পর দিন শহরবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। হাট-বাজারগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছে। পৌরসভাকে মহানগরে উন্নীত করছে এবং এজন্য কিছু গ্রাম বা কৃষিজমিকে শহর হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেমনটি করা হয়েছে গাজীপুর ও রংপুর মহানগরী ঘোষণার প্রাক্কালে। ১৯৭৪ সালে সারা বাংলাদেশে পৌরসভার সংখ্যা ছিল মাত্র ৮০, যা এখন হয়েছে ৩২১। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ মানুষকে শহরবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সরকার।
জনগণ শহরে আসেনি, শহর তাদের দুয়ারে গিয়ে ধরনা দিয়েছে। অথচ সরকার সেভাবে শহরের পয়ঃনিষ্কাশন, আবর্জনা দূরীকরণ, নগর পিতাদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে মোটেই ভাবেনি। সরকার ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন জারি করেছে (২০০৯ সালের ৬০নং আইন)। জনস্বাস্থ্যসহ ২৮টি কাজ কর্পোরেশনের দায়িত্ব বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তাদের ক্ষমতা প্রায় সবই স্থানীয় সরকারের হাতে রেখেছে। এমনকি সুপারসিড করার ক্ষমতাও রেখেছে সরকার নিজের হাতে।
সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার
ক্ষমতা একেবারেই সীমিত, আয়ের উৎস আরও কম। নগর পিতারা
স্থানীয় সরকারের মন্ত্রী ও সচিবের
কাছে তদবির করেছে অহরহ টিকে থাকার স্বার্থে।
খারাপ স্বাস্থ্য দরিদ্রতার লক্ষণ। তাই দারিদ্র্য নিরসনের মূলনীতির বাস্তবায়ন করতে হলে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের অবশ্যই উন্নতি ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ নগর স্বাস্থ্য সার্ভে থেকে প্রাপ্ত উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ
করে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। এ কাজে সরকারের একলা চলার নীতি গ্রহণ করা ঠিক হবে না।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
dknath888@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.