কোরবানি : পাশবিকতারও জবাই হতে হবে by অধ্যাপক নইম কাদের

কোরবান ও কোরবানি শব্দ দু’টি আমাদের অতি পরিচিত। আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী উৎপত্তিগত দিক দিয়ে শাব্দিক বিশ্লেষণে শব্দ দু’টির শাব্দিক অর্থ এবং পরিভাষায় কিছুটা পার্থক্য আছে। কোরবানি হচ্ছে- আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগ বা উৎসর্গ এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন। কোরবানি সুন্নাতে ইবরাহিমে হিসেবেই পরিচিত। আবুল আম্বিয়া হজরত ইবরাহিম আ: এই মহান সুন্নাত প্রবর্তন করেন। পরবর্তী সময়ে ত্যাগের এই মহান সুন্নাত উম্মতে মুহাম্মদি সা:-এর সামর্থ্যবানদের ওপর বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব) করা হয়।

কোরবান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায় পরম নৈকট্য। অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানুহু তায়ালার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া, নিকটতম স্থান লাভ করা। পশু জবাই এবং আনুষঙ্গিক ত্যাগের মাধ্যমে এই চরম নৈকট্য অর্জিত হয় বলেই এর নাম কোরবানি। এখানে কোরবানি দ্বারা এর প্রচলিত সাধারণ অর্থ গ্রহণ করলে ভুল হবে। সাধারণত এটাই ধারণা করা হয় যে, সুন্দর একটি পশু ক্রয় করে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে জবাই করলেই কোরবানি আদায় হয়ে গেল এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়ে গেল। কোরবানির হাকিকত বা আসল রূপ আমাদের জানতে হবে এবং বুঝতে হবে।
হজরত ইবরাহিম আ:কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বপ্নযোগে ওহি প্রেরণ করেন তিনি যেন তাঁর প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাঈল আ:কে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে জবেহ করেন। পবিত্র কুরআনে জবেহ শব্দটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে তিনি তার প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় ঠিক সেভাবে উৎসর্গ করেন, জবাই করেন যেভাবে তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর পয়গাম্বর হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাঈল আ:কে জবাইয়ের ঘটনাটি ‘কাদ সাদ্দাকতার রুইয়া’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, জবাইয়ের ঘটনাটি ছিল বাস্তব। অর্থাৎ ইবরাহিম আ: সত্যি সত্যিই তার প্রিয়পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন, জবাই করেছিলেন। তবে গলা কাটেনি, শিশুপুত্র ইসমাঈলের কোনো ক্ষতি হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহ পাক ইবরাহিম আ:কে যেমন তার সন্তান জবাই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তেমনি গলায় চালানো ছুরিকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন সে তার কাটার কাজ না করে। এখানে ইবরাহিম আ: এবং ছুরি উভয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছেন। তারপর ফেরেশতা কর্তৃক পশু হাজির করা এবং পশু জবাইয়ের বিবরণও পবিত্র কুরআনে এসেছে। প্রাণাধিক প্রিয়পুত্রের পরিবর্তে পশু জবাইয়ের এই সুযোগকে বৃদ্ধ বয়সে সাইয়্যেদানা ইবরাহিম আ:-এর প্রতি আল্লাহ পাকের বিরাট প্রতিদান বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক পুরো ঘটনাটিকে সুস্পষ্ট এক বিশাল পরীক্ষা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর এই বিশাল পরীক্ষায় ত্যাগের সর্বোত্তম নজির স্থাপন করে কুরআনের ভাষায় ‘মুহসিনিন’ এর অন্তর্ভুক্ত হলেন হজরত ইবরাহিম আ:, হজরত ইসমাঈল আ: এবং হজরত হাজেরা আ:। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ত্যাগের এই মহান দৃষ্টান্ত হজরত ইবরাহিম আ: ও তার পরিবারের আগে মানব ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।
আল্লাহর রাস্তায় নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ করার নাম কোরবানি। এখানে আরো একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, কোরবানি কোনা ব্যক্তিগত ত্যাগের নাম নয়। এটা সামষ্টিক ত্যাগের প্রতিফলন। যেমন হজরত ইবরাহিম আ: একা এই কাজে অগ্রসর হননি। তার সাথে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন প্রিয়পুত্র হজরত ইসমাঈল আ: এবং হজরত হাজেরা আ:। এ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, কোনো মুসলমান শুধু একা আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিলেই হবে না, তার পুরো পরিবারকেও ত্যাগের এ পথে নিয়ে আসতে হবে। এটাই সুন্নাতে ইবরাহিমে ‘কোরবানির’ মর্মকথা।
আফসোস! মুসলিম সমাজে কোরবানি আজ নিছক আনুষ্ঠানিকতায় রূপ লাভ করেছে। আমরা ভুলে গেছি এর আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। লৌকিকতা আর আনুষ্ঠানিকতায় হারিয়ে গেছে কোরবানির আসল মকছুদ। কোরবানি যেন আজ তথাকথিত বড় লোকদের গরু প্রদর্শনী আর অহমিকা প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। বিয়ের প্রথম বছর মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে কোরবানি উপলক্ষে বিরাট গরু পাঠাতে না পারায় অনেকের ঘর-সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রমের খবরও পাওয়া যায়। ঢোল-বাদ্য সহকারে লাখ টাকায় কেনা গরু প্রদর্শনীর মিছিল আর হই হুল্লুড়ের কাছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনি। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কত সুন্দরভাবেই না বলেছেন- আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত, রক্ত কিছুই পৌঁছে না, আল্লাহর কাছে পৌঁছে শুধু তাকওয়া। অথচ মানুষ আজ আল্লাহকে এর জবাব দিচ্ছে ঠিক বিপরীত। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে কোরবানি আজ তাকওয়ার পরিবর্তে গোশত আর টাকার সস্তা খেল তামাশায় পরিণত হয়ে পড়েছে।
আর একশ্রেণীর মানুষের কাছে কোরবানি নিছক ব্যবসায় ছাড়া আর কিছুই নয়। কোরবানি উপলক্ষে মওসুমি পশু-ব্যবসায় খারাপ কিছু নয়, বরং নিয়ত ঠিক থাকলে তা এক বিরাট ইবাদত। কিন্তু কোরবানি উপলক্ষে পশুর চামড়া নিয়ে যা হয় তার সাথে সুন্নাতে ইবরাহিমের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। কোরবানির সময় প্রতি বছর আমাদের দেশে একশ্রেণীর চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে ফেলে। এ ছাড়া আর একশ্রেণীর মাস্তানের উপদ্রব ঘটে যাদের সামনে কথা বলার সাহসও রাখেন না কোরবানিদাতারা। এরা নিজেরাই চামড়ার দাম ঠিক করে দেয় এবং কোরবানিদাতারা তাদের নির্ধারিত মূল্যে তাদের হাতেই চামড়া তুলে দিতে বাধ্য হন। কোরবানির চামড়ার হকদার এতিম, মিসকিন গরিব মানুষগুলো। যারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম ফেলে দেয়, কিংবা যারা চামড়া নিয়ে মাস্তানি করে তারা গরিবের হক তছরুফ করছে, এতিমের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। এটা জঘন্য অপরাধ। দুনিয়ার জিন্দেগিতে তাদের বিচার হয়তো হবে না। কিন্তু কিয়ামতের মাঠে তারা ছাড়া পাবে না। স্বয়ং আল্লাহ পাক এতিম আর গরিবের পক্ষে তাদের হক আদায় করে ছাড়বেন।
যারা কোরবানির চামড়া নিয়ে মাস্তানি করে, যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পশুর মূল্য বাড়ায়, চামড়ার মূল্য ফেলে দেয় কিংবা যারা কোরবানিকে লোক দেখানো খেল তামাশায় পরিণত করে তাদের ভেবে দেখা উচিত কিয়ামতের মাঠে প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের জন্য অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। ত্যাগের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর আমাদের কাছে কোরবানি হাজির হয়। শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য, আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য যারা কোরবানি করেন, মাটিতে শোয়ানো পশুর গলায় ছুরি চালানোর পর গলা বেয়ে মাটিতে রক্ত পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।
মনে রাখা দরকার পশু জবাইয়ের সাথে সাথে মনের ভেতরে অবস্থিত পাশবিকতারও জবাই হয়ে যেতে হবে। তা না হলে গোশত খাওয়া ছাড়া কোরবানি দ্বারা আর কিছু অর্জিত হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

No comments

Powered by Blogger.