ঈদ উৎসবের চরিত্র সেকালে একালে by আহমদ রফিক

সন্দেহ নেই ঈদ মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়েও সেই সঙ্গে সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসবের চরিত্র নিয়ে। এ উৎসব সর্বজনীন। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ থেকে মহাবিত্তবান নাগরিক একই রকম প্রেরণায় ঈদ উৎসব পালন করে থাকে। যদিও ‘পালনের’ মহিমায় দুইয়ের মধ্যে অনেক ফারাক। শুধু অর্থের হিসাবে নয়, মানসিকতার দিক থেকেও ভিন্নতা তাৎপর্যপূর্ণ।
ঈদে বিত্তবানদের কেনাকাটায় ও আচরণে এক ধরনের আর্থ-সামাজিক অহংকারবোধ প্রচ্ছন্ন থাকে, অভিজাত গৃহিণীদের ক্ষেত্রে তা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতার চরিত্র অর্জন করে। পোশাক ও গয়নাগাটির অভিজাত বিপণি বিতানের ভিড়ে তার প্রমাণ মেলে। নিুমধ্য বা নিুবিত্ত শ্রেণী থেকে নিুবর্গীয়দের মধ্যে ঈদ-উৎসবের আন্তরিকতাই বড় হয়ে থাকে। ধর্মীয় ও সামাজিক এ দুইদিক থেকেই। বড়দের জন্য ঈদের প্রথাসিদ্ধ আনুষ্ঠানিক (ধর্মীয় ও সামাজিক) দিকটিই প্রধান। ছোটদের জন্য ঈদের একটাই চরিত্র- তা হল উৎসব-আনন্দ।
দুই
ঈদের অনুষ্ঠান, উৎসব বা আনন্দ যেদিকটাতে হোক এর সেকাল একালের চিত্র চরিত্র ধর্মে এক হয়েও ভিন্ন। আজ যাদের বয়স ৭০-৮০ বা ততোধিক তারা সেকাল-একালের প্রভেদ বুঝতে পারবেন। পারবেন গ্রাম বনাম নগর বা রাজধানীর তুলনামূলক বিচারে। সেকালের শহর বা গ্রামে ঈদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও উৎসব-আনন্দের সামাজিক চরিত্রটিই ছিল প্রধান।
তাতে অবশ্যই নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ কেনা অপরিহার্য হলেও ছিল বইপত্র উপহার, সেই সঙ্গে নানা পদের সুখাদ্যের আহার্য-বিলাস। সকাল থেকে সব পরিবারে রান্নার ব্যস্ততায় ছড়িয়ে পড়া সুগন্ধ। রোজার ঈদে তাতে বিশেষ মাত্রা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ব্যক্তিক প্রীতিসম্ভাসনে ও মেলবন্ধনে দেখা গেছে আন্তরিকতা। তাতে সামাজিক চরিত্রের সামূহিক প্রকাশ।
ভোরে স্নান সমাপন। নতুন পোশাক, সেমাই-পায়েসের মিষ্টি সুস্বাদু, স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায়, আলিঙ্গন, দুপুরের সুস্বাদু আহার। বিকালে বাড়িতে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের আমন্ত্রিত বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, গল্পগুজব, পরে আহার। এটা রোজার ঈদেরই বিশেষত্ব। ছোটদের, তরুণদের এবাড়ি-সেবাড়িতে আনন্দিত সময় যাপন, বই পড়া- এমন একটা দিনের ছবি তৈরি করে ঈদ পর্বের অভিজ্ঞতা শেষ। ছবিটা গ্রামের সেকালের। অন্তত ৬০-৭০ বছর আগেকার, গ্রামবাংলার তো বটেই। মফস্বল শহরে চিত্রটাও প্রায় একই রকম।
তিন
বাংলাদেশে একালের ঈদ নগর-বন্দরে, বিশেষত রাজধানী ঢাকায় যেন এক মহাযজ্ঞের আয়োজন। কোরবানির ঈদের কথা না-ই বলি। সেখানে বিত্ত ও সামাজিক মর্যাদা এবং আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা প্রচ্ছন্ন হলেও বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। কোরবানির ব্যয় ও পুণ্য অর্জনের প্রতিযোগিতা সেকালে বহুলদৃষ্ট ছিল না। একালে ঈদুল ফিতরও তার
ঐতিহ্য হারিয়েছে।
তাই সিয়াম সাধনার মাস, সংযম-আত্মশুদ্ধি ও কৃচ্ছ সাধনার মাস রমজান ব্যয়বহুল আহারের মাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। অবশ্য বিত্তবান, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্গীয় শ্রেণীতে। এর চরম প্রকাশ ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটায়- বিশেষ করে পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারে। সেকালের ঈদ উৎসবের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে ভাবা কঠিন যে লক্ষাধিক টাকা মূল্যের লেহেঙ্গাও কেনা যায় এবং কিনতে হয়। শুধু সোনায় মধ্যবয়সী গৃহিণী বা তরুণী গৃহিণীর এখন মন ভরে না। হিরার জৌলুসে আভিজাত্য না হোক অন্তত সামাজিক মর্যাদার প্রকাশ।
কমবয়সী তরুণীদেরও প্রবল ঝোঁক বিশেষ ব্র্যান্ডের পোশাকের প্রতি, মূল্য সেখানে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। হতে পারে তা পণ্যবিশেষে লক্ষাধিক টাকার ব্যয়। এর পেছনে থাকে টি-ভি চ্যানেলগুলোর বাহারি বিজ্ঞাপন যা মন কাড়ে, আকাক্সক্ষার প্রসার ঘটায়। প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতার অথবা পছন্দের ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া। এ ক্ষেত্রে তারুণ্যের জয়জয়কার।
চেইনশপ না হলেও ব্র্যান্ড শপজাতীয় পণ্য বিতান সাজসজ্জায় যেমন আকর্ষণীয় তেমনি অন্তত ঈদে কাগজে বা পর্দা-প্রচারে কার্পণ্য করে না। এদিক থেকে জুয়েলারি দোকানগুলো সবার সেরা। আর বিদেশী ব্র্যান্ড পণ্যের নামিদামি ‘শপ’গুলো। দরিদ্র বাংলাদেশ কত দ্রুত রাজধানী ও বন্দর নগরীতে ধনী, সমৃদ্ধ দেশের প্রতীক হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারা যায় ঈদ উৎসবের নির্বিচার কেনাকাটায়।
এ বিকিকিনির পেছনে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে অতিদ্রুত বিশাল একটা মহাবিত্তবান শ্রেণীর উদ্ভব। পোশাকই নয়, দামি গাড়ির নিত্য-নতুন ব্র্যান্ড বদল এক ধরনের শখ বা বলা যায় নেশা। একই জিনিস ব্যবহারে মলিন, কতদিন তা নিয়ে চলা যায়? সমাজ গ্রহণ করে না বিধায় ব্র্যান্ড বদলের মতো সবকিছু বদল সম্ভব হয় না। রসনায়-বাসনায় নতুনত্বের উপভোগ একালের তথা একুশ শতকের ঈদ উৎসবের বিশেষত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন বিত্তবান শ্রেণী তেমনি উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য।
এতটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই মোটামুটি সচ্ছল বা একালের আটপৌরে মধ্যবিত্তের ঈদ। কেনাকাটার দৈর্ঘ্য পোশাকে মেলে না। তাই আটপৌরে মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের মহলে বহু প্রচলিত উক্তি- দু’মাসের আয় এক মাসে ব্যয়, বোনাস-বাড়তি আয় সবকিছুর মিলেও ঈদের মহাগ্রাসে শেষ। কারও কারও জমার হিসাবে টান পড়ে। মহার্ঘ মূল্যের টানে নীতিবোধ, মূল্যবোধ ভেসে যায়। বাংলাদেশের জন্য মস্ত বড় সুবিধা দুর্নীতিতে প্রতিযোগিতায় এক নম্বর হওয়ার কারণে।
কিন্তু সবাই তো আর সুবিধাভোগী শ্রেণীর সদস্য নন। কাজেই বাহারি পাঞ্জাবি, ফতুয়াদির জন্য বাড়তি আয়ের পথ ধরতে হয়-
ঈদ বলে কথা। নিুবিত্তের ঈদ নিয়ে আশা-আকাক্সক্ষা থাকবে না? শুনছি রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তার কারণে, কোথাও কোথাও সিসি ক্যামেরার কল্যাণে আপাতত ছিনতাইয়ে ভাটা। কিন্তু হাইওয়েতে চাঁদাবাজির রমরমা ব্যবসা, পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিচারে। নিরাপত্তা এ মুহূর্তে সর্বত্রবিস্তারি নয়। পবিত্র রমজান শেষে এমনটাই ঈদ সমাচার। নব্য প্রযুক্তিই বরং রাজধানীতে ঈদ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। অবশ্য সীমাবদ্ধভাবে।
পঞ্চাশের দশকের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার কয়েক লাখ লোক সংখ্যা বেড়ে একুশ শতকে এখন শোনা যায় দেড় কোটির অধিক। আধুনিক চেতনার প্রসারে মানুষের চাহিদা বেড়ে যায় সংখ্যায় ও আকাক্সক্ষায়। ছোট বড় নানা পেশার জমজমাট তৎপরতা ঈদ উপলক্ষে। দর্জি দোকান থেকে রকমারি ব্যবসার দোকানদারি। হেন জিনিস নেই যা বেচাকেনা হচ্ছে না। ওই যে প্রাচীন প্রবাদ : ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ’। সব কিছুই এখন পণ্য, ভোগবাদের কল্যাণে।
রাজধানীর বৈশিষ্ট্য হল, বাসিন্দাদের একটি অংশ ভাসমান জনসংখ্যা, দীর্ঘদিন থেকে এদের শিকড়-বাকড় গ্রামের মাটিতে, অথবা দূর শহরগঞ্জে। তাই ঈদ সন্ধ্যার বা ঈদ রাতের বেচা-বিক্রি শেষ করে এরা ছুটে যায় পিতৃ পিতামহের ভিটেবাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে বলে। ঢাকা মহানগরে পরিণত হওয়ার উপলক্ষে এই শ্রেণীর উদ্ভব। এদের মতোই ঢাকা ত্যাগী নিুমধ্যবিত্ত নানা পেশার মানুষ। তাদের মধ্যে চাকরিজীবীও রয়েছে।
ঈদ উৎসব এদের টেনে নিয়ে যায় রাজধানীর বাইরে নিজ নিজ স্বজন-অধ্যুষিত স্থানে। অনেক সময় পথ এদের নিয়ে যায় ফিরে না আসা লোকে। তাদের ঘরে তখন নিদ্রাহীন রাত জাগার পালা। তবু এদের যাওয়া বন্ধ হয় না। মহানগর ঢাকাকে দিন কয়েকের বিশ্রাম দিতে এসব নানা শ্রেণীর মানুষের রাজধানী ত্যাগ।
এরা একালের ঈদ উৎসবে গোটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা প্রাণ বিবেচিত হলেও আসল কেন্দ্র মহানগর ঢাকা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের নাভি কেন্দ্র ঢাকা-চট্টগ্রাম তথা নগর-বন্দর। স্বাধীন দেশে জাতীয় বুর্জোয়া নয়, কমপ্রেডর পুঁজিপতি- ধনিক-বণিক আমলা শ্রেণীর দ্রুত গড়ে ওঠা ভোগবাদী সমাজ তার ভালো-মন্দের বিস্তার ঘটাচ্ছে। গ্রামের সঙ্গে নগর-মহানগরের বিশাল ব্যবধান তৈরি করছে। গ্রাম উঠে আসতে চাইছে রাজধানীতে, বন্দর নগরীতে। তার অন্তত একটি দিক লাখে লাখে গ্রামীণ তরুণীর পোশাক-শিল্পের কাজে ঢাকায় বস্তিবাসী হওয়া। এদেরও শিকড় গ্রামে।
বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক নাগরিক চরিত্রই একালে ঈদ উৎসবের রাজধানীকেন্দ্রিক নাগরিক চরিত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ভোগবাদ নাগরিক সমাজের আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমাজ গড়ে তুলেছে শিল্পপতি, বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণী, সেই সঙ্গে সামরিক-বেসামরিক আমলা, বৃহৎ আয়ের পেশাজীবীরা (অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী) এবং অনুরূপ ধনিক শ্রেণী।
ঈদ উৎসব ঘিরে রাজধানী ঢাকা বা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বা অনুরূপ সমৃদ্ধ শহরে উল্লিখিত শ্রেণীর অর্থ ব্যয়ের সমারোহ, এমনকি তাদের ভোগবাদী চরিত্র ঈদের সেকাল ও একালের মধ্যে বিপুল ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধ সুবিধাভোগী শ্রেণীতে অনুপস্থিত বললে চলে। এ শক্তিমান শ্রেণীর জীবনাচরণের প্রভাব পড়েছে এবং পড়ছে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত অন্যান্য শ্রেণীর ওপর। এদেরও চরিত্র বদল ঘটছে ধীরগতিতে। কিন্তু ঈদের উৎসব-আনন্দের ঘরোয়া, সহজ, সবল দিক, এর মানবিক আবেগের দিক, এর পারিবারিক সামাজিক সহমর্মিতার দিকগুলো এসব গ্রামমুখী শ্রেণীর মধ্যে এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তাই এদের ছুটে যেতে হয় শিকড়ের টানে গ্রামে-গঞ্জে বা ছোট ছোট শহরের স্থায়ী আবাসনে পিতৃ পুরুষের বাস্তুভিটায়। এ যাত্রা যদিও ঈদকেন্দ্রিক, তবু এ ক্ষেত্রে ধর্মবোধের চেয়ে মানবিক মমত্ববোধই প্রধান নিয়ামক শক্তি। তা যেমন পরিবারকেন্দ্রিক তেমনি সমাজকেন্দ্রিক।

No comments

Powered by Blogger.