চান্দ্রেয় আর্তনাদ by অদিতি ফাল্গুনী

তেতা ফাত্তুমের জলপাই বাগান
গরমের দিনে গন্ধে ম-ম করত ফাত্তুমের বাড়ির সামনের জলপাই বাগান। ফাতেমাকেই এই ফিলিস্তিন বা গোটা আল-জাজিরা আল-আরাবিয়ায় আদর করে ‘ফাত্তুম’ ডাকা হয়। ওহো, এ দেশে সবাই আল-জাজিরা শুনলেই ভাবে টিভি চ্যানেল। আল-জাজিরা অর্থ যে আরবের দ্বীপমালা, তা এ দেশে কারও জানার কথা নয়। স্কুলের নাম ফাতিমা হলেও বাপের আদরের মেয়ে হিসেবে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ফাত্তুম।’ বুড়ি হয়ে যাওয়ার পরও তাকে সে নামেই সবাই ডাকত। সেই ফাত্তুমের বাড়িতে গরমের দিনে পাখিরা উড়ে এসে বসত জলপাইয়ের মুকুলিত ডালে আর বুড়ি ফাত্তুম ঘেমে নেয়ে উঠে লাঠি হাতে তাড়ানো শুরু করত পাখিগুলোকে। ওমরের তখন স্কুলে ১০ ক্লাসের পরীক্ষা শেষ হয়ে মাত্রই তিন মাসের ছুটি শুরু হয়েছে। বাসার সবার কথাতেই সেবার সে তিন মাস ফাত্তুমের কাছে এসেছিল। সিদ্দি (মাতামহ) ইব্রাহিম মারা গেছে সেই কত দিন! তেতা (মাতামহী) ফাত্তুম একা একাই থাকে। ছেলেরা কেউ লেবানন কিংবা কেউ আরও নানা দূরের দেশে অভিবাসী। দুপুরবেলা খাবার টেবিলের সামনে দীর্ঘ আয়ত কালো চোখের, সাদা-কালো ছবির পঞ্চদশীকে চিনতে খুব কষ্ট হতো ওমরের।
‘তেতা, এটা কি সত্যিই তুমি? সঙ্গে তোমার ইয়াব্বা (বাবা)?’
‘শ্রমিক কলোনির ছেলেদের সঙ্গে মিশে তোর কথাও তেমন হয়ে গেছে ওমর! যে কবিলার ছেলে তুই, সেই আল-আফসা বংশে...ভালো বংশের উচ্চারণ হবে “বাবা”। তা না তোর মা তোর ওপর কোনো নজর রাখে না আর তোর মুখে এখন “ইয়াব্বা” “ইয়াম্মা” কী সব উচ্চারণ!’
কথা ঠিক। স্কুল শেষে প্রায়ই শ্রমিক কলোনির ছেলেদের সঙ্গে খেলার মাঠে খেলতে যেত ওমর। ওমরের ভাষা নিয়ে হাসত ওরা। বইয়ের মতো শুদ্ধ তার উচ্চারণ। ইয়াম্মা (মা)-কে সে ‘মামা’ বলে কিংবা ‘ইয়াব্বা’-কে ‘বাবা’। বড়লোক আরব আর গরিব আরবদের মুখে বিভিন্ন সম্বোধনের উচ্চারণ তো বরাবরই আলাদা।
‘উঁহু তেতা, বলো না এটা কি সত্যিই তুমি?’
‘হ্যাঁ, ইয়াফা শহরে আমাদের বাড়ির ছাদে বাবার সঙ্গে আমার ছবি।’
‘ইয়াফা মানে তেল-আবিব?’
‘ওহ্ এই ইহুদিদের দেখাদেখি তোরাও কি ইয়াফাকে তেল-আবিব ডাকবি, ওমর?’
‘আচ্ছা আচ্ছা, আর ডাকব না!’
ফাত্তুম তখন নানা গল্পের ঝুড়ি মেলে দিত। আজ থেকে দু/তিন কুড়ি বছর আগে, যখন আকাশে বড় বড় বিমান দেখা দিত আর আকাশ থেকে বোমা পড়ত যখন তখন, সবাই যাকে বলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ঠিক সে সময় কী জানি কী হলো, হঠাৎই একদিন ইয়াফা অর্থাৎ আজকের তেল-আবিব শহরে ফাত্তুমদের বিশাল ফলের বাগানসহ দোতলা প্রাসাদের মতো বাড়িটা ছেড়ে তার বাবা বোঁচকায় কিছু নগদ টাকা, বউ, ছেলেমেয়ে উটের পিঠে চাপিয়ে ভেসে ভেসে এল মিসরের পাশে এই গাজায়। প্রথমে ছিল তারা রাফায়। সেখান থেকে খান ইউনিস। তারপর দির আল বেলাহর শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয়। দির আল বেলাহর জাবেলিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের ১৫ বছরের কিশোরী ফাত্তুমকে একদিন চোখে লেগে গেল বেইত লাহিয়া ক্যাম্পের ২০ বছরের যুবক ইব্রাহিম আল-আফসার। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব ও বিয়ে। ইব্রাহিমরাও ইয়াফা থেকে আসা। মেয়ের বিয়ের আসরে, বেদুইন তাঁবুর মতো করে টানানো শরণার্থী ক্যাম্পে ছোট করে আয়োজন করা ভোজসভায় ফেলে আসা শহর, বিশাল বাড়ি আর আত্মীয়-পরিজনের কথা ভেবে অথবা এমন সম্পন্ন পরিবারের মেয়ের এমন দীনহীন বিয়ের আয়োজনের মনঃকষ্টেই হোক, ফাত্তুমের বাবার হঠাৎ শ্বাস উঠল। মরার আগে বউ না, ছেলেদের কাউকে না, মেয়ের হাতে সে দিয়ে গেল ইয়াফায় তাদের ঘরের চাবি।
‘কোনো দিন যদি ইয়াফায় তোরা ফিরে যেতে পারিস, তবে এই চাবিটা দিয়েই সোজা দরজা খুলে নিস!’ বলেছিল সে তার মেয়েকে।
ফাত্তুমের এখন ওই এক বাতিক। বিশেষত স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে; আর তার ছেলেরাও যেহেতু এখন দূর-দূরান্তের নানা দেশে ছড়িয়ে, বুড়ি গুনগুন করে তোরঙ্গ খুলে ইয়াফা শহরের সাদা-কালো সব ছবি দেখে—তার পাড়া-পড়শি মেয়েদের ছবি, ফলের বাগানের ছবি। বাবার দিয়ে যাওয়া চাবি তার কোমরে আবেয়ার সঙ্গে গোঁজা থাকে সব সময়।
‘তেতা, তোমার চাবিটা দাও তো!’ দুষ্টুমি করে এ কথা একবার বললেই হলো—ব্যস, তেতা গরম! এর চেয়ে তার কলিজাসুদ্ধ টান দিলেই হয়। ইয়াফার বাড়ির চাবি প্রাণ থাকতে সে কাউকে দেবে না, এক মুহূর্তের জন্যও না।
না, ওমরের মা নাজাহর ইয়াফা বা তেল-আবিব শহর নিয়ে এমন কোনো মাথাব্যথা নেই বা ছিলও না কখনো। নাজাহ সায়েদ মুস্তাফা আল-আফসার জন্ম এই গাজাতেই। তত দিনে তার বাবা ও মা অনেকটা গুছিয়ে উঠেছে এই গাজায়। আল-আত্তাল পরিবারের কন্যা ও আল-আফসা বংশের বধূ, মুস্তাফার পৌত্রী ও সায়েদের দুহিতা নাজাহর বিয়ের গল্পটাও বলতে গেলে আর এক কাহিনি।

‘ওমর...’
‘হাই!’
‘ওমর, উই বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি উইশ টু হোল্ড আ প্রটেস্ট মিটিং টুমরো এগেইনস্ট ইসরায়েলি অকুপেশন। আই অ্যাম মোহাম্মদ ফারুক হোসেইন ফ্রম ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্ট! হাউ ইজ দ্য প্রেজেন্ট সিচ্যুয়েশন?’
‘নট শিওর। ক্যানট কানেক্ট উইথ মাই ফ্যামিলি ইদার ওভার ফোন অর নেট ফর এইট ডেইজ।’
সহপাঠী সজল মিত্র আর একটি অচেনা ছেলে ডিপার্টমেন্টের সামনে করিডর ধরে ওমরের দিকে এগিয়ে আসে। সজল হিন্দু। সে বলেছিল, হিন্দুরা এ দেশে বাবাকে ‘বাবা’ ডাকে। হাউ ফানি! সজলের সঙ্গে তার খুব ভালো ফ্রেন্ডশিপ। ২০০৯-এ এখানে আসার দুই বছর পর তেতা ফাত্তুমের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে যখন খুব মন খারাপ করেছিল, তেতার গল্প সব শুনে সজল তাকে একটু একটু বলেছিল, ১৯৪৭-এর পর এ দেশ থেকেও অনেক হিন্দুকে সব ফেলে চলে যেতে হয়েছে।
‘আই হ্যাভ নট অলসো সিন মাই গ্রান্ড মম ফর ওভার ম্যানি ইয়ার্স। শি স্টেইস ইন ইন্ডিয়া নাউ,’ বলেছিল সজল ভারী সুরে। সজলদের বাড়ির জায়গা-জমি নিয়ে মামলা চলছে তাদের দেশের বাড়িতে। মন্দিরটা কারা যেন ভেঙে রেখে গেছে গত মাসে! এটা ঠিক না। বিষণ্ন মনে ভাবে ওমর।

রুহিফার চিঠি
ভাই ওমর,
দেশের অবস্থা তো জানোই। গাজায় এখন আমরা বিদ্যুৎ পাই ভোররাতের দিকে দুই ঘণ্টা আর বিকেলের দিকে দুই ঘণ্টা। বলতে গেলে চব্বিশ ঘণ্টাই মাথার ওপর বিমান উড়ছে আর বোমার শব্দ। গতকাল আমাদের পাড়ার জয়নব, তুমি বাংলাদেশে যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল মাত্র নয়, হয়তো তোমার মনে নেই, এখন ওর বয়স আঠারো, আমার চার বছরের ছোট...তিন দিন আগে ফেসবুকে শুধু লিখেছিল, ‘ওয়েলকাম টু শাহাদা।’ শহীদ হওয়াকে স্বাগতম। তিন দিনের মাথায় ইসরায়েলিরা ফেসবুক দেখে ঠিকই ট্র্যাক ডাউন করেছে। গতকালই ওর বাসায় বোমা হামলা হয়েছে। সে আর বেঁচে নেই। এ অবস্থার ভেতর আমাদের কারোরই মাথা কাজ করছে না। বাসায় পানি থাকে না সারাটা সময়। তুমি চলে যাওয়ার পর আমাদের আগের বাড়িটা ভেঙে কত কষ্ট করে এই নতুন বাড়িটা করা হয়েছে। এত সুন্দর একটা বাড়ি! অথচ পানি না থাকলে এই সুন্দর বাড়ি দিয়ে কী করব? আমাদের পানি বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। সন্ধ্যার পর থেকে অন্ধকারে ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাই বসে থাকি। থেকে থেকে বোমারু বিমানের চক্করের শব্দ। কারফিউয়ের হুইসেল আর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। বাড়ির বাইরে বের হতে ভয় করে। ঘরে টাকা আছে। কিন্তু আশপাশের বাজারে যেতেও সাহস হয় না। এমন একটা রমজান মাস যেন শত্রুরও না হয়! সারা দিন রোজা থেকেও খেতে রুচি হয় না। তুমি ভালো থেকো।
তোমার বোন রুহিফা।
যাক, ফোনে দেশের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। এখন তবু ফেসবুক মেসেস আসায় কিছু খবর পাওয়া গেল দেশের।
‘হাই ওমর! হোয়াটস দ্য কন্ডিশন ইন গাজা নাউ?’
এ দেশে সবার মুখে একটাই প্রশ্ন। কী বলবে তাদের সে? রুহিফার চিঠির কথা?

ভিয়া ডলোরোসা
ভিয়া ডলোরোসা বা জেরুসালেম থেকে যন্ত্রণার দীর্ঘ পথ,
ইহুদিরা হত্যা করল উত্তরাধিকারীকে, হে প্রভু,
এবং ধর্ষণ করল দ্রাক্ষাকুঞ্জকে।
উদ্যত হলো জেরুজালেমের পবিত্রতা বিনাশে

ভাই ওমর,
ইসরায়েলি বোমায় অনেক মসজিদ গুঁড়িয়ে গেছে। একে একে খারাপ খবরগুলো কীভাবে তোমাকে জানাব বুঝছি না। রামি জিয়াদ, আমাদের মালিকার স্বামী, বিমান থেকে ফেলা বোমায় মারা গেছে। মালিকা নিজে ১৫ দিন আইসিইউতে কাটাল। এখন ভালো। আর ইয়াসিরকে গত ১৫ দিন কেউ খুঁজে পাচ্ছিল না। গতকাল কিছু ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ওর লাশটা পাওয়া গেছে! শুনলে তুমি অবাক হবে, আজ পাঁচ দিন হয় আমরা একটা চার্চে আশ্রয় নিয়েছি। খ্রিষ্টানরা আমাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করছে। আমরা এমনকি চার্চের ভেতর নামাজও পড়ছি। পুরুষেরা কেউ কেউ আজানও দিচ্ছে। এমন অবাক করা ব্যাপার কখনো আমার জীবনে ঘটেনি।
তোমার বোন রুহিফা।

ফেসবুকের মেসেস ইনবক্স পড়ে বুকটা ধক করে উঠল ওমরের। চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। রামি তার চাচাতো বোন মালিকার খালাতো ভাই ও স্বামী। দেশ ছেড়ে আসার সময় উনিশের লাজুক আর হালকাপলকা ওমরের সাধ্যই ছিল না তার মনের কথাটা মালিকাকে খুলে বলার। এ দেশে আসার পর তো আর দেশে ফিরে যেতেও পারেনি। বছর দুই আগে মালিকার বিয়ের খবর পেয়ে মন খারাপ হয়েছিল তার। অদ্ভুত বিষাদবোধে আক্রান্ত ছিল সে। এ দেশে বেশ কিছু বাঙালি মেয়ে তার প্রতি আগ্রহী হয়েছে কখনো কখনো। কিন্তু ওপথে সে হাঁটেনি। এ দেশে সে দুই দিনের মুসাফির। আজ আছে, কাল নেই। পরশু কোথায় যাবে তারও নেই ঠিক। এ দেশে পড়াশোনা শেষ করে এখন তার বছর দুই চলছে জাতিসংঘের শরণার্থী স্ট্যাটাসে। সে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে। গাজায় তো কোনো কাজ নেই। বিদেশ থেকে পড়ে-শুনে গাজায় ফিরে মানুষজন কোনো কাজ পাচ্ছে না। এই অনিশ্চিত অবস্থায় খামোখা কোনো মেয়েকে জড়ানো কেন?
মালিকার স্বামী আজ আর নেই। দেশে তবে ফিরবে তুমি ওমর? মনে পাপ এনো না! কোনো তরুণীর বৈধব্য সংবাদে তোমার হৃদয়ে যেন স্বস্তির আভাস না দেখা দেয়! মালিকার স্বামী ছাড়া আরও মারা গেছে ইয়াসির। ইয়াসিরের বাবা এবং তার বাবা কাজিন। সেকেন্ড কাজিন হলেও ইয়াসিরের সঙ্গে দারুণ খাতির ওমরের। ইয়াসির অবশ্য ওমরের আট বছরের ছোট। ওমরের বয়স ২৮ হলে ইয়াসিরের বয়স হয়েছিল মাত্র ২০। আজ থেকে নয় বছর আগে এ দেশে যখন সে পড়তে আসে, ইয়াসির তখন ১১ বছরের বালক। আট বছর বয়স অবধি ওমরের কাঁধে চড়ত ইয়াসির। প্রিয় নেতার নামে চাচাতো ভাইয়ের ছেলের এই নামটি ওমরের বাবাই রেখেছিল বৈকি। পিএলওর কট্টর লড়াকু সমর্থক তার বাবা। হামাস আসার পর স্বেচ্ছায় পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়া বাবা! ১৯ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ইয়াসির আরাফাতের দল করার অপরাধে ইসরায়েলিদের কাছে ২৫ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছিলেন তিনি। ১০ বছর ধরে কারাগারে বন্ধু ও সহযোদ্ধা ইয়াকুব আল-আত্তালের সঙ্গে সময় পার করেছেন। একবার ফিলিস্তিনি কমিউনিস্টরা কিছু ইসরায়েলি সেনাকে গ্রেপ্তার করার পর ওমরের বাবা হোসেইনী, মামা ইয়াকুবের মতো আরও কিছু রাজবন্দীর মুক্তির দাবি করল। বিনিময়ে ইসরায়েলি সেনাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। মামা ইয়াকুব আল-আত্তালকে অবশ্য আরও দুই বছর জেলে থাকতে হলো। ১৯ বছর বয়সে জেলে ঢোকা সদ্য তরুণ হোসেইনী জেল ছাড়ার সময় ২৯ বছরের যুবক। তত দিনে দুই যুবকের মা-বাবাই পরস্পরকে চেনেন। জেল ছাড়ার সময় কান্না কান্না চোখে বন্ধুকে আলিঙ্গন করে লজ্জায় রক্তিম হয়ে হোসেইনী বলেন, ‘মাতৃভূমির জন্য কোনো দিন বিয়ে করার কথাও ভাবিনি। তবে বিয়ে যদি করতেই হয়...তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী করতে তোমার যে তিন বোনের গল্প তুমি করেছ, তাদের যে কাউকে আমি বিয়ে করতে চাই। এমনকি আমি পাত্রীও দেখব না।’
তেতা ফাত্তুম তবু বাড়িতে হবু বরকে ডেকেছিল।
‘এই দ্যাখো আমার তিন মেয়ে, কাকে পছন্দ হয় তোমার?’
‘তিন মেয়েই কি এখনো অবিবাহিত?’
‘হ্যাঁ।’
‘তবে সবচেয়ে বড় যেজন তাকেই বিয়ে করব।’
সেদিনই আংটি পরানো হয়েছিল। দ্বিতীয় দিন বিয়ে পড়ানোর পর বউ নিয়ে বাড়ি ফেরা। ১০ বছর জেলে থেকে চালচুলোহীন জামাইকে শ্বশুর কিছু জমি দিলেন। সেখানেই ট্রাক্টর চালিয়ে বাবার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব বা কৃষক অধ্যায়ের শুরু। তাঁর ৩৯ বছর বয়সে, ওমরের বয়স তখন ১০, ইয়াসির আরাফাত গাজায় এলেন। তাঁর অনুরোধেই বাবা পুলিশের বড় চাকরিতে ঢুকলেন। সেই সঙ্গে নাইট কোর্সে পড়া শুরু করলেন। বড় দুঃখ ছিল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করতে না পারার জন্য। এখন হামাস আসার পর মেয়েদের একটু আগে বিয়ে হওয়া শুরু হলেও ওমরের বাবা এসব একদম পছন্দ করেন না। মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় না পড়িয়ে তিনি বিয়ে দেবেন না।
আমার শয্যায় ঘুমন্ত উদ্যান
ঘুম যখন চুম্বন করল তাকে
আর তাকালাম তার দুই চোখের পাতায়
এবং প্রার্থনা করলাম ওর অনিন্দ্যসুন্দর
দুই পায়ের দিকে তাকিয়ে।
তেমনি অনিন্দ্যসুন্দর দুই পায়ের পাতাই কি ছিল না মালিকার? দারাবিশের কবিতার নায়িকার মতো? উনিশের ওমরের দেশ ছেড়ে আসার আগের দিন মালিকাদের বাড়ির পেছনে পিচ আর কমলা ফলের ঝোপে কোনো কথা না বলে অভিমানে গুমরে উঠেছিল সে, প্রচণ্ড সাহস নিয়ে মাথার হিজাব খুলে ফেলেছিল মালিকা। সে কি চেয়েছিল ওমর তার চুলে হাত রাখুক? একবার নত হোক চুম্বনে? ভীরু ওমর, জীবন বাঁচাতে তৎপর, সুখী ও নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশী ওমর পালিয়ে এসেছিল। প্রেমিকার মাথায় হাত রেখে তাকে আশ্বাস জোগানোর সাহসও তার হয়নি। মালিকা আজ বিধবা! গাজায় শেষ ইসরায়েলি হামলায় নিহত দুই হাজার ৪০০ মানুষের ভেতর তোমার প্রেমিকার স্বামীও একজন। তেতা ফাত্তুম যেমন গুনত, কোন যুদ্ধে সে কয় ছেলেকে হারিয়েছে, কোন বোমাবর্ষণে কয় মেয়ে? তবু আরবরা কমে না সংখ্যায়!

ঘুমাও ওমর হোসেইনী সেলিম হুসেইন আল-আফসা। আল-আফসা গোত্রের সন্তান, হোসেইনীর পুত্র, সেলিমের পৌত্র ও হুসেইনের প্রৌপোত্র ওমর তুমি ঘুমাও। এই আরব গোত্র ও বংশ-পরিচয় ছাড়া তোমার আর একটি পরিচয়— জাতিসংঘে ঘর শরণার্থী, কার্ড নম্বর ৩৯৩-০৯সি০০০০৩। দারাবিশের কবিতার সেই প্রত্যয়নপত্র? কাল সকালেই তোমাকে ইউএনএইচসিআর অফিসে ছুটতে হবে শরণার্থী কার্ড রিনিউ করাতে। তুমি কে? তুমি কি সামিথ আল-কাসিমের কবিতার পারসোনা নন গ্র্যাটা? কোনো রাষ্ট্রেরই নাগরিক নও? হায়, তোমার কোনো রাষ্ট্র নেই ওমর, তোমার কোনো দেশ নেই—থেকেও নেই—

অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি
এখানেই ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা।
এটাই চূড়ান্ত: আমার চান্দ্রেয় আর্তনাদ
এসো।
তোমার বিদ্বেষের যাবতীয় ভয়াবহ আগুন নিয়ে তুমি এসো।
এসো! এখানে আমার আছে স্বর্গকে পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগকারী এক সর্পিল মই, মরুর উত্তাপকে শীতল করতে সমর্থ একটি ফ্যান, এক গর্ভবতী উদরে পদাঘাত করা একটি ট্যাংক ও বন্ধ্যা জাতিসমূহ।
আমার ক্লেশ: উজ্জ্বলতা
আমার রোষ: আর্তি
এসো।
আমার অবস্থিতি হলো উড্ডয়ন।
আমার মৃত্যু সংঘর্ষ।
আমি শপথ করছি ডুমুর এবং তেলের নামে, নৈঃশব্দ্য ও তূর্যনিনাদের নামে, উর্বরতা ও বন্ধ্যত্বের নামে, মধু ও বিষের নামে, কুঁড়ি ও রক্তের নামে, অজ্ঞানতা ও জ্ঞানের নামে, গতকাল ও আজকের নামে, আমি শপথ করছি যুদ্ধ করার।
আমার সংগ্রাম চলবে!
যত দিন না মিথ্যের অন্ধকার ফুঁড়ে জন্ম নেয় সত্য।

No comments

Powered by Blogger.