ইতিহাসের সত্য আদালত উপেক্ষা করেছেন -সাক্ষাৎকারে:মুনতাসীর মামুন by ফারুক ওয়াসিফ

যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাঁর শাস্তি কমিয়ে আমৃতু্য কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন–এর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো।

প্রথম আলো: এই রায়ের অভিঘাত কী হবে বলে মনে করেন আপনি?
মুনতাসীর মামুন: অনেকেরই অনুমান ছিল, এ রকম রায়ই হবে। এই রায় আমাদের শুধু হতাশই করেনি, ক্ষুব্ধও করেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা। তিনটি অভিযোগ উঠছে—১. প্রসিকিউশন দুর্বল, ২. সরকারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আঁতাত হয়েছে, ৩. বিচারকেরা দীর্ঘ প্রক্রিয়া নিচ্ছেন। এগুলো সবই অনুমান। দ্বিতীয়ত, এই রায় শোনার জন্য আদালতে কেউ যায়নি। আমার যেটা অনুমান তা হলো, আইনের ব্যাখ্যা যেভাবে ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালত সেভাবে করেননি। ১৯৭৫ সালের ঘটনা আওয়ামী লীগের ওপরে যে রকম অভিঘাত হেনেছিল, এই রায়ও একই রকম অভিঘাত হানবে।
প্রথম আলো: আপিল বিভাগের কথা বলছেন?
মুনতাসীর মামুন: হ্যাঁ। সরকার যদি আদালতকে প্রভাবিত করত, তাহলে সাঈদীর যাবজ্জীবন হতে পারত, যেখানে তাঁর মুক্তির সম্ভাবনা থাকত। সরকার বিচারকে প্রভাবিত করলে বিচারকেরা বিভক্ত হতেন না। অন্যদিকে, আমৃত্যু অন্তরীণ থাকা কিন্তু ফাঁসির থেকেও যন্ত্রণাদায়ক। আমরা সব সময় সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে এসেছি। আজকে বিচারকেরা হয়তো কৌশলগত চিন্তা করেছেন, প্রসিকিউশনের চিন্তা করেছেন। কিন্তু বিচারটা হচ্ছে ১৯৭১-এর অপরাধের। ১৯৭১ এমন এক বিষয়, এটাকে যদি উপেক্ষা করলে জটিলতার সৃষ্টি হবে।
প্রথম আলো: কিন্তু বিচারকেরা তো সাক্ষ্য–প্রমাণ এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিবরণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন?
মুনতাসীর মামুন: তা যদি হয়, তাহলে আইনজীবীর দরকার পড়ে না। উচ্চ আদালতে তো সওয়াল জবাব হয় না। আইন তো একটাই থাকে। আমার কথা হচ্ছে, ১৯৭১-কে সাধারণ মামলার মতো বিচার করা যাবে না। তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে কেন? বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্য–প্রমাণের বিষয়টা তো সাধারণ মামলার মতো না।
প্রথম আলো: এই মামলাকে উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়াই সমস্যা মনে করছেন?
মুনতাসীর মামুন: সুপ্রিম কোর্টে এটা দেওয়ার তো কোনো দরকার ছিল না। প্রধানমন্ত্রী এটা করেছেন অতি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য। আমি বারবার বলছি, একাত্তরকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে, নইলে জটিলতার সৃষ্টি হবে। আইনের দৃষ্টিতে দেখলে তো একাত্তর হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তো অনেকে বলেছেন যে আইন ভঙ্গ করা হচ্ছে। যেখানে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে, সেখানে আপনি যদি জানেন কেউ অপরাধী, সেখানে আইনের দোহাই দিয়ে তাকে রেয়াত দেওয়া হবে? এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
প্রথম আলো : তাহলে দায়টা কার?
মুনতাসীর মামুন: অন্তিমে এটা তো বিচারকদের রায়।
প্রথম আলো: একদিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ, অন্যদিকে প্রসিকিউশনের দুর্বলতা, দুইখানেই তো সরকারের ভূমিকা?
মুনতাসীর মামুন: এই কথাগুলো কিন্তু পূর্ণ রায় না দেখে বলা যাবে না। আমি আপাতত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। আমি বলছি যে এ ধরনের বিচার কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে যায় না। বিচারকদেরও মনে রাখতে হবে, তাঁরা ১৯৭১-এর অপরাধের বিচার করছেন। একে নিছক আইনের কারিগরির মধ্যে ফেলে দেখলে হবে না। এ কারণেই বিদ্যমান সাক্ষ্য আইন এ মামলার বেলায় প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, বিচারকেরা ওই এভিডেন্স অ্যাক্টের মানসিকতা থেকে বেরোতে পারেননি। দুই নম্বর হচ্ছে, আমরা তো জানি, সাঈদীকে দেল্লা রাজাকার বলা হতো। এটা তো ইতিহাসের সত্য। এটাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে, কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। ইতিহাসের সত্যকে কীভাবে আইন দিয়ে বিচার করা যাবে?
প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলছেন, ইতিহাসের সত্য আদালতে প্রতিষ্ঠা পেল না।
মুনতাসীর মামুন: ইতিহাসের সত্য আদালত উপেক্ষা করেছেন। বিচারকেরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়তো কিছু করেননি, কিন্তু এগুলো সরকারের জন্য, সমাজ-রাষ্ট্র সবকিছুর জন্য খুব ক্ষতিকর হবে। এ কারণে বলছি, ১৯৭৫ সালে কিন্তু অনেকেই চিন্তা করেননি এর অভিঘাত কী হবে? ২০ বছর পর সেটা বোঝা গেল। এই রায় কিন্তু ১৯৭৫-এর মতো অভিঘাত সৃষ্টি করল।
প্রথম আলো: ২০টা অপরাধের মধ্যে আটটা অপরাধের বিচার হলো। বাকিগুলোর রায় কি অন্য রকম হতে পারে?
মুনতাসীর মামুন: প্রশ্ন অন্যভাবে জেগেছে। একই অপরাধে কাউকে এক শাস্তি, কাউকে অন্য ধরনের শাস্তি দিলে সেটা কীভাবে কার্যকর হবে? সে কারণেই বলছি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসব হলে তো জটিলতার সৃষ্টি করবে। আমরা কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে কিছু বলিনি। এখন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সবকিছু অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে, দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে, সেখানে কী হবে আমরা বলতে পারি না। তাঁরা বলবেন এভিডেন্স অ্যাক্ট দেখতে হবে, ১৯৭১-কে বিশেষভাবে দেখতে হবে—এটা আমাদের ব্যাপার না। এই বাধ্যবাধকতা ট্রাইব্যুনালের আছে। এখানে মনে হয়, দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা জন্মে যাচ্ছে। আপনি বলবেন, আইন অন্ধ, কিন্তু অন্ধও তো যষ্টি ছাড়া চলতে পারে না। হয়তো সরকার প্রসিকিউশন দুর্বল করে রেখেছে, তার কারণে এমনটা হয়েছে।
প্রথম আলো: কাদের মোল্লার দুটি রায়ের মাঝখানে বড় আন্দোলন ছিল। এখন মাঠে সে রকম কিছু না থাকাতেই কি...
মুনতাসীর মামুন: ভেবে দেখতে হবে এসব বলে আমরা সরকার, আদালত ও বিচারকে আর ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারি না। আমি সরকারের বা আওয়ামী লীগের লোক নই। তাই আমি বলতে পারি না, কারও সঙ্গে কারও কোনো আঁতাত হয়েছে কি না। যত প্রকার আইন থাকুক, ১৯৭১ সবকিছুর ওপরে। যত দিন এই বিবেচনাবোধ আমাদের মধ্যে কাজ না করবে, তত দিন জটিলতার সৃষ্টি হবে।
প্রথম আলো: আপনি ১৯৭৫ সালের মতো অভিঘাতের কথা বলছিলেন, সেটা কি ব্যাখ্যা করবেন?
মুনতাসীর মামুন: অভিঘাতটা হচ্ছে এই, প্রতিক্রিয়া আমাদের এখানে সব সময় জিতে যাচ্ছে। এই রায় তো প্রতিক্রিয়ারই অংশ। যুদ্ধাপরাধকে যেখানে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। যদি না-ই হয়, তাহলে সমন্বয়ের রাজনীতির কথা চলে আসে। তখন তো মুক্তিযুদ্ধই আর থাকে না। দুই নম্বরে, সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলো রাজনৈতিক, সামাজিক ও আদর্শিকভাবে। আদর্শটা হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মানে একাত্তরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
প্রথম আলো: ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারের পক্ষে কি কঠিন পথ নেওয়া সম্ভব?
মুনতাসীর মামুন: তার মানে বলতে চাইছেন আদালত কি সরকারের মুখ দেখে রায় দিচ্ছেন? এ ধরনের কথা আমার অবস্থান থেকে বলা সম্ভব নয়। আদালত আছেন, আমরা আদালতে গেছি এবং আদালতের রায় আমাদের মানতে হবে। আমি আমার দুঃখ প্রকাশ করছি, আমি আমার হতাশা প্রকাশ করছি এবং অপমানিত বোধ করেছি।
প্রথম আলো: যাঁদের বিচার হয়েছে, তাঁরা যে একাত্তরে অপরাধ করেছেন, সেটা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হলো।
মুনতাসীর মামুন: তাঁদের অপরাধী হিসেবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধ এবং নিছক অপরাধ কিন্তু ভিন্ন বিষয়। সাঈদী একজন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নয়। সেখানেই আমাদের ক্ষোভ। আমৃত্যু কারাদণ্ডও সর্বোচ্চ শাস্তি। সেখানেও মানুষের ভয়, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে তো তারা বেরিয়ে আসবে। ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে দুর্বলতাটা চিহ্নিত করা যাবে। যদি প্রসিকিউশনের দুর্বলতা পরিস্ফুট করেন বিচারকেরা, তাহলে আইনমন্ত্রীকে অবশ্যই প্রসিকিউশনের খোলনলচে পাল্টাতে হবে। না হলে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.