কী ঝামেলা! by আহমেদ রিয়াজ

টুনিকে নিয়ে পারা গেল না। বাড়িতে ওর ভয়ডর বলতে কিছু নেই। যত ভয় বাড়ির বাইরে এলে। কিছুতেই ওজন মাপার যন্ত্রে উঠতে চাইছে না।
তিন দিন ধরে টুনির জ্বর। মা-বাবা ওকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ওর পেট টিপলেন, কপালে হাত দিলেন, পিঠে হাত বোলালেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, জটিল কিছু না। এমনি জ্বর। ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
ওষুধের মাত্রা লিখতে গিয়ে হঠাৎ ডাক্তার সাহেবের মনে হলো, ওজন জানা দরকার। ওজন না জেনে ওষুধ দেওয়া যায় না। ওষুধও এখন ওজনের ওপর নির্ভর করে। টেবিলের তলা থেকে ওজন মাপার যন্ত্রটা টেনে বের করলেন ডাক্তার। তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে উঠে দাঁড়াও তো মা।’
টুনি ছিল বাবার কোলে। বাবাকে একেবারে ঘাপটি মেরে ধরে আছে, দুহাত দিয়ে বাবার গলা আর পা দুটো দিয়ে বাবার পেট। ভাবটা এমন, কেউ আমারে বাবার কোল থেকে সরাতে পারবা না।
বাবার কোল ওর ভীষণ প্রিয়।
ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওজন না মাপলে কেমন করে হবে?’
বলে নিজেই টুনিকে ওজন মাপার যন্ত্রের উপর দাঁড় করাতে চাইলেন। কিন্তু বাবার কোলে ঘাপটি মেরে আছে টুনি। রেগে গেলেন মা, ‘টুনি! বাবার কোল থেকে নামো বলছি।’
উঁহু। টুনি বাবার কোল পেয়েছে। আর কারও কথা এখন ওর কানে ঢুকবে না। তার ওপর ওর জ্বর হয়েছে। এমনিতেই বাবার আহ্লাদের কমতি নেই। এখন জ্বরের সময় বাবার আহ্লাদ আরও বেশি। কিন্তু ওজনটা তো মাপতে হবে!

এবার বাবা ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘দেখি মা, এবার এখানে একটু দাঁড়াও তো!’
টুনি বলল, ‘না, আমি উঠব না।’
বাবা জানতে চাইলেন, ‘কেন?’
‘আমার ভয় করে।’
‘কিসের ভয়? এখানে তো আমরা সবাই আছি। কোনো ভয় নেই মা।’
‘তাহলে তুমিও আমার সঙ্গে ওঠো।’
বাবা বুঝিয়ে বললেন, ‘উঁহু। আমিসহ উঠলে তো তোমার ওজন জানা হবে না।’
টুনি এবার সাফ সাফ জানিয়ে দিল, ‘তুমি না উঠলে আমিও উঠব না।’
মা কিন্তু তখন থেকেই বিরক্ত। মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘কী যন্ত্রণা!’
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘যন্ত্র যন্ত্রণা।’
মা বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব, যা হয় একটা ওজন ধরে...’
ডাক্তার বললেন, ‘তা হয় না। শিশুদের আন্দাজে ওষুধ দেওয়া ঠিক নয়।’
মা বললেন, ‘তিন মাস আগে একবার ওজন মাপিয়েছিলাম। তখন ১২ কেজি ছিল।’
বাবা বললেন, ‘এখনো মনে হয় ওজন ১২ কেজির বেশি হবে না।’
ডাক্তার বললেন, ‘মনে হলে তো হবে না। সঠিক ওজন জানা চাই।’
কী মুশকিল! ওদিকে বাইরে আরও রোগী অপেক্ষা করে আছে। মা-বাবা দুজনই বড্ড বিব্রত।
তক্ষুনি ডাক্তারের ঘরে ঢুকে পড়লেন করিম চাচা। বাজারের মুদি দোকানি। ভালোমতোই চেনেন বাবা। বাবা চট করে টুনিকে দুহাতে তুলে নিলেন। তারপর করিম চাচার হাতে দিয়ে বললেন, ‘ধরে দেখুন তো চাচা।’
করিম চাচা তো অবাক! এসেছেন তাঁর ভাগনেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে। টুনিকে ধরে কোলে নিলেন চাচা। বাবা বললেন, ‘আপনি তো সারা দিন মাপামাপি করেন। আপনার ওজনের আন্দাজও ভালো। বলুন তো ওর ওজন কত?’
করিম চাচার মুখ হাসি হাসি থাকে সারা দিন। এখনো হাসিমুখে বললেন, ‘মনে হয় সাড়ে ১৩ কেজি।’
বাবা এবার ডাক্তারের দিকে তাকালেন। ডাক্তার বললেন, ‘মনে হলে হবে না। সঠিক ওজন চাই।’
বাবা আবার অনুরোধ করলেন টুনিকে, ‘মা। ওজন মাপার যন্ত্রে উঠতে চাইছিস না কেন?’
টুনি বলল, ‘বললামই তো, আমার একা একা উঠতে ভয় করে।’
তাহলে...
বাকিটা বাবার কানে কানে বলল টুনি। ফিস ফিস করে। আর কী অবাক! তখনই টুনিকে নিয়ে যন্ত্রটায় উঠলেন বাবা। বাবা আর টুনি—দুজনের ওজন ৭৬ কেজি। টুনিকে মায়ের কোলে দিয়ে বাবা এবার একা উঠলেন ওজন মাপার যন্ত্রে। ৬৩ কেজি। করিম চাচা এবার ঝটপট টুনির ওজন বের করে ফেললেন—১৩ কেজি।
বাহ্! বাবা মুগ্ধ হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুধু বাবা নয়, ডাক্তার আঙ্কেল, করিম চাচা আর মাও টুনির দিকে তাকালেন। ঝটপট ওষুধের মাত্রা লিখে বাবার হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেন ডাক্তার।
কিন্তু বুদ্ধিটা বড়দের মাথায় এল না কেন? চার বছরের টুনির মাথায়ই-বা এল কেমন করে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওজন মাপার যন্ত্রে টুনি একা উঠলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। বড়দের এই এক সমস্যা। সব ব্যাপারে ছোটদের জোরাজুরি করা চাই। বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু করতেই পারে না। এই যে টুনি ওর ওজন বের করার একটা সুন্দর উপায় বাতলে দিল, এ জন্য তো ওর বাহবা পাওয়ার কথা। তা নয়, ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোতে বেরোতে উল্টো মা ওকে বললেন, ‘তুমি বড্ড ঝামেলা করো টুনি!’

No comments

Powered by Blogger.