ফরিদুর রেজা সাগরের মানুষের মুখ

স্বজনের অভিমান কষ্ট বেদনা না বুঝলে আত্মীয়তা কি করে জন্মাবে। কনে দেখার আলো বলে একটা কথা আছে, মানুষ দেখার জন্য একটা আলো দরকার যার নাম মনের আলো। মনের আলো দিয়ে মানুষের মুখ দেখলে অনেক দুঃখ, হতাশা ও ঘৃণা দেখা যাবে অর্থ নয় বিত্ত নয় শুধু মানুষের মুখ দেখে আনন্দ পাওয়ার বিষয়টা কৌতূহলোদ্দীপক। তাও আবার ২৯ জন মানুষের মুখ। মানুষের মুখ ৩-এর লেখক ফরিদুর রেজা সাগর এভাবেই মানুষ দেখার আনন্দকে মহিমান্বিত করেছেন তার গ্রন্থে। সময় সবকিছু বদলে দেয় কিশোর তরুণ যুবা ও বৃদ্ধ একটা দীর্ঘপথ পরিক্রমা। আমরা কিছু স্মৃতি কাঁধে নিয়ে যাই- সঙ্গে কিছু আশ্চর্য মানুষের মুখ, মানুষের সঙ্গী আনন্দ। সফোক্লিসের চার হাজার বছর আগের উক্তি এখনও অম্লান- ‘হে স ষ্টা মানুষ দেখার আনন্দে যেন আমি কখনও ক্লান্ত না হই। ফরিদুর রেজা সাগর কার্যার্থে যে খানেই গেছেন সেখানেই মানুষের মুখের অনুসন্ধান করেছেন। কার মধ্যে কতটা সদগুণ আছে, সুযোগ পেলে একজন মানুষ নিজেকে কতটা প্রতিষ্ঠা দিতে পারে তারও একটা নিরীক্ষা করেছেন বাস্তব জীবনে। ফরিদুর রেজা সাগর দেখেছেন প্রতিটি মানুষ আলাদারকম এবং তাদের মুখাবয়ব, তাদের হাঁটার ভঙ্গি, কথা বলার ধরন ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের মুখ দেখার এবং তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন শুধু চিত্রকরদের নয়, তা’ একজন খাঁটি লেখকেরও। লিও টলস্টয় তার ডধৎ ধহফ ঢ়বধপব গ্রন্থে চরিত্র চিত্রন করেছেন পাঁচশ’ মানুষের।
কিছুদূর পড়লে চরিত্রগুলো মিলিয়ে যায় আবার পেছনে পড়ে দেখে নিতে হয় কার নাম কি কে কোন ভূমিকায় আছেন। পাঠক ভুলে গেলেও লিও টলস্টয় কিন্তু কোথাও এক কর পরিমাণ খামতি রাখেননি- প্রত্যেকটি মানুষ তার কাজ করেছে সঠিক মাত্রায়। মাঝে মাঝে এই মহান শিল্পীর শ্রমনিবিড় কার্যক্ষমতা বিস্ময় জাগায়। আনা কারানিনা উপন্যাস লিখেছেন পুরোটা সাতবার। মানুষের মুখ দেখায় অদ্বিতীয় লিও টলস্টয় এখনও দুনিয়া কাঁপানো মানুষ অন্বেষক হিসেবে সমাদৃত। দস্তয়ভস্কি, ভিক্টর হুগো প্রমুখ লেখকরা মানুষ দেখার আনন্দে বিভোর থাকতেন। ফরিদুর রেজা সাগরের মানুষের মুখ নিয়ে লেখার ক্ষমতা আমাকে মোহিত করে। এ জন্য মানুষের মুখ-১ ও ২ পাঠ করেছি, আলোচনা করেছি। ৩-এর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। হাতে পেয়েই গোগ্রাসে পড়ে দেখেছি। পড়ার সময় দু’-একটি প্রশ্ন জানতে আনন্দে মাঝে মাঝে ফোন করেছি। বিখ্যাত লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় পথে প্রবাসে গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন- তিনি এবং মনীন্দ্রলাল রায় ফ্রান্সে রমা রলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। মনীন্দ্রলাল রায় একপর্যায়ে রমা রলাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন আর মানুষ কবিতা পড়ে না কেন? রমা রলা একটা চমৎকার উত্তর দিলেন, এখনকার কবিতায় মানুষের মুখ এবং সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার কথা থাকে না বলেই মানুষ কবিতা পড়ে না। যদি ভিক্টর হুগো থাকতেন তাহলে তিনি মানুষের জন্য কবিতা লিখত এবং মানুষ কবিতামুখী হতো। অর্থাৎ মানুষের জন্য শিল্প এই বিশ্বাসে অটল না থাকলে লেখকের সিদ্ধি লাভ হয় না।
ফরিদুর রেজা সাগর যখন খাবার-দাবার রেস্টুরেন্ট চালাতেন তখন বেশকিছু মানুষের সঙ্গে তার দেখা হতো। একজন মাঝে মাঝে খেতে আসতেন তখন খাবার-দাবার হোটেলে বেইলি রোডের নাটকের টিকিট বিক্রি হতো। অসামর্থ্যরে কথা বলে একজন ফরিদুর রেজা সাগরের কাছ থেকে টিকিট নিয়ে সেই টিকিট বেইলি রোডে বিক্রি করে দেয়। লোকটি একদিন খাবার-দাবার হোটেলে খেতে এসে ধরাও পড়ে। কিন্তু, তার কথা কেউ সহযোগিতা না করলে যাব কোথায়? এই খাবার-দাবার হোটেলে মমতাবশত: চাকরি পেল সোহরাব এবং রুস্তম। কিন্তু সোহরাব গেল অন্ধকার পথে আর রুস্তম বুদ্ধিদীপ্ত পরিশ্রমী সে এল সংসারে- জীবনের দিকে। রুস্তমের ছেলে এখন নটরড্যাম কলেজের ছাত্র। এভাবেই একটা স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে মানুষ এগোয়। কাঠমন্ডুতে বাংলাদেশের নিজামউদ্দিন কঠিন পরিশ্রমী, পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা রাস্তায় পিঠে করে বাড়ি বাড়ি ফ্রিজ পৌঁছে দেয়ার কাজ করে, ক্লান্তি নেই। এখন অনেকের কাছে তিনি উদাহরণ। কিংবা যে বাংলাদেশী মালয়েশিয়ার স্কেটিং টিচার বনে গেছে আর মদিনার হাশেম মিয়া এখন শ্রমিক থেকে গাইড। বাহরাইনের বাংলাদেশী মনসুরার সততা ও নিষ্ঠা তাকে নিয়ে গেছে বহুদূর। আরও কত বাংলাদেশের সৎ মানুষ এ দেশে যাদের মূল্যায়ন নেই দুবাইয়ের ট্যাক্সিচালক আবদুল হালিম অনেক ডলার আর হীরা পেয়ে ফেরত দিলেন এবং সততার প্রতীক হয়ে উঠলেন। নিজেই বাংলাদেশ হয়ে উঠলেন। আরও কত মানুষ কানাডায় ভাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য কত কৌশল শ্রম কত ত্যাগ। কিন্তু কানাডায় যখন ছোট ভাই পৌঁছাল তখন আর বড় ভাইকে চিনল না। মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ কত বিচিত্র তা একটু পর্যাবেক্ষণ করলে জানা যায়। ঠিক একই ঘটনা বড় ভাই ভালো সঙ্গীতশিল্পী কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি- ছোট ভাই বড় ভাইয়ের পরিচিতজনদের কাছে ধর্ণা ধরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠল আর সেই কিনা বড় ভাইকেই শুরু করল অবজ্ঞা করতে, ঘটনাটা মর্মান্তিক।
ফরিদুর রেজা সাগর দেশের বাইরে নানা কাজে যান আর আবিষ্কার করেন দেশপ্রেম। নিজের দেশের পোশাক পরার জন্য কতজন মরিয়া হয়ে থাকে। দেশের মায়ায় অর্থ উর্পাজন করে টাকা পাঠায় আবার যখন এয়ারপোর্টে আসে তখন নিরীহ মানুষগুলো পড়ে দুর্ভোগে আর চ্যানেল আই যারা স্বদেশীকতায় বিশ্বাসী তারা বিদেশী কাপড়ের প্রশংসা করলে কষ্ট পায় প্রবাসীরা। এক অমুসলিম ভদ্রলোক বাড়ি কুমিল্লায়। থাকে দীর্ঘদিন প্রবাসে নর্থ আমেরিকায় কিন্তু দেশ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে ফিরতে নারাজ। কিন্তু তার কথা, আমার মৃত্যুর পর সৎকার হবে কুমিল্লায়। কেন এই প্রতিজ্ঞা জানতে চেয়েছিলেন ফরিদুর রেজা সাগর। তিনি বললেন, আমার কবর কুমিল্লায় হবে তাহলে আমার সন্তানেরা কখনও না কখনও বাংলাদেশে ফিরবে অন্তত তার পিতার অন্তিম আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ দেখতে। এই সব মহৎ মানুষের মুখ দেখেছেন ফরিদুর রেজা সাগর। ঠিক রফিক আজাদের কবিতার মতো খুব খুটিয়ে মানুষ দেখি/ যেমন করে বরের বাবা/কনের চলাফেরা এবং চুল থেকে তার পা অব্দি/ দেখতে থাকে/ঠিক তেমনি মানুষ দেখি। মানুষ দেখার ক্ষেত্রে আমরা কেউ একান্ত মানুষকেও সঠিকভাবে নির্ভুলভাবে নির্ণয় করি না। স্বজনের অভিমান কষ্ট বেদনা না বুঝলে আত্মীয়তা কি করে জন্মাবে। কনে দেখার আলো বলে একটা কথা আছে, মানুষ দেখার জন্য একটা আলো দরকার যার নাম মনের আলো। মনের আলো দিয়ে মানুষের মুখ দেখলে অনেক দুঃখ, হতাশা ও ঘৃণা দেখা যাবে।
সিগমন্ড ফ্রয়েড একটা প্রশ্ন করেছিলেন মানবতার কাছে, মানুষের সহজাত আক্রমানাত্মক এবং আত্মবিধ্বংসী প্রবৃত্তি দ্বারা যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় মানব সংস্কৃতি সেটাকে কি এবং কতটা প্রতিহত করতে পারবে? আমার ধারণা, মানব সংস্কৃতিই প্রেমের দ্বারা প্রীতির দ্বারা হৃদয়ের স্পন্দনের দ্বারা এক অসীম মানবিক তরঙ্গ তৈরি করতে সক্ষম যা দৃশ্যমান হয় মানুষের মুখে। মানুষের এই ক্ষমতা অসাধারণ যাকে স্বর্গীয় ক্ষমতা বলেছেন গেটে। এই শিরোনামের কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন তার দুটো লাইনে এখানে প্রাসঙ্গিক- পৃথিবী তুমি এক ক্লান্ত পৃথিবী/ক্ষমা করে দিয়েছিলে মানবতার দোষ-ত্র“টি/ কতযুগ পেরিয়ে/ অনুতাপের দাহে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে/দেখালে/ একটি মুহূর্তের ভুলে যুগ যুগান্তর এত মর্মপীড়া। স্বর্গচুতির পর মানুষের যে মর্মপীড়া তা কিছুটা ঘুচানো যাবে মানুষকে আবিষ্কার করে, মনের আলোয় তার মুখ দেখে। মানুষের মুখ- তিন প্রকাশ করেছে অনন্যা অসাধারণ প্রচ্ছদ মাশুক হেলালের। মূল্য ৩৫০ টাকা। রেজাউদ্দিন স্টালিন

No comments

Powered by Blogger.