স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার মূল্য by জেফরি ডি স্যাকস

যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্কটল্যান্ডের গণভোট গতকাল বৃহস্পতিবার হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে সারা দুনিয়ার নজর এর ফলাফলের দিকে। কিন্তু এ সময় শুধু স্কটল্যান্ডই নিজেদের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে চাইছে, ব্যাপারটা এমন নয়। দুনিয়ার নানা প্রান্তেই স্বাধীনতার আন্দোলন হচ্ছে, ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৯টি নতুন রাষ্ট্র জাতিসংঘে যোগ দিয়েছে। স্কটল্যান্ডের মানুষেরা ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে আরও অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে।

মূলত চারটি দাবির ওপর ভিত্তি করে স্কটিশরা এই স্বাধীনতার দাবি তুলেছে। প্রথমটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক: স্কটিশ জনগণের স্বরূপ রক্ষা ও তা জোরদার করা। দ্বিতীয়টি আদর্শিক: স্কটল্যান্ডকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর আদলে সামাজিক গণতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত করা। তৃতীয়টি রাজনৈতিক: গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা জনগণের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। আর চতুর্থ কারণটি অর্থনৈতিক: নর্থ সির তেল ও গ্যাসের ওপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা।
যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা ও ইউরোপীয় সরকারগুলো স্কটিশদের ‘না’ ভোট দিতে উৎসাহিত করেছেন। এই ‘না’ বাদীরা বলছেন, স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে উল্লিখিত দাবির খুব সামান্যই পূরণ হবে। কিন্তু স্বাধীনতা এলে দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষতিই হবে বেশি, কারণ এতে দেশটি থেকে শিল্পকারখানা সরে যেতে পারে, ফলে কর্মসংস্থানের অভাব হবে। তদুপরি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোয় স্বাধীন স্কটল্যান্ডের ঠাঁই না-ও হতে পারে।
এই বিতর্ক নিয়ে দুনিয়ার মনোভাব কী হতে পারে? এই স্বাধীনতা কি সাংস্কৃতিক পরিচয় ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ প্রাপ্ত সফলতা হিসেবে গণ্য হবে? অথবা এটাকে কি ইউরোপের অস্থিতিশীলতার আরেকটি উৎস হিসেবে দেখা হবে, যার কারণে ইউরোপ দুর্বল হয়ে পড়ছে? যার প্রভাব দুনিয়ার অন্যান্য স্থানেও অনুভূত হবে?
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারণে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা যেতে পারে। কসোভো, দক্ষিণ সুদান, কুর্দিস্তান ও ক্রিমিয়ায় যে সংকট চলছে, সে কথা একবার ভাবুন। তার পরও জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন আরও শান্তিপূর্ণ ও নির্ঝঞ্ঝাটে পরিচালনা করা যায়। যেমন, ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া গঠন হলেও এর কোনো সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশ দুটিতে অনুভূত হয়নি—এটা ‘মখমল বিচ্ছেদ’ হিসেবে সুপরিচিত। উভয়ই এই বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছিল, তারা জানত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের ভাগ্য জড়িয়ে আছে, ফলে তারা এর ওপর নজর দেয়।
স্কটল্যান্ড হয়তো শেষমেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। এরপর যুক্তরাজ্যের (বর্তমান বিতর্কে ‘আরইউকে’ হিসেবে আখ্যা পেয়েছে) অন্য তিন রাষ্ট্র ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের কাজ হবে স্কটল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে এই স্বাধীনতার শর্ত প্রণয়ন করে ফেলা: যুক্তরাজ্যের ঋণ পরিশোধ, সমুদ্রের তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য সম্পদ ভাগাভাগি। উভয় পক্ষকেই তাদের দাবিতে ন্যায়সংগত ও বাস্তবানুগ হতে হবে।
একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত হবে সব আইন ও গণতান্ত্রিক নীতিমালা মেনে চলা সাপেক্ষে স্কটল্যান্ডের সদস্যপদ টিকিয়ে রাখা। একই ভাবে, ন্যাটোরও উচিত হবে দেশটির সদস্যপদ বাতিল না করা (যদিও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি মার্কিন ও ব্রিটিশ পরমাণু সাবমেরিন ঘাঁটি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সমস্যাজনক হবে)।
স্কটল্যান্ড সাময়িকভাবে ব্রিটিশ পাউন্ড ব্যবহার করবে, স্কটল্যান্ড ও আরইউকে উভয়ই হয়তো এ বিষয়ে রাজি হতে পারে। কিন্তু শিগগিরই তারা হয়তো স্কটিশ পাউন্ড বা ইউরো চালু করবে। এসব আর্থিক আয়োজন যদি স্বচ্ছতা বা সহযোগিতার ভিত্তিতে হয়, তাহলে এসব নির্বিঘ্নে বা আর্থিক বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ঘটতে পারে।
কিন্তু আরইউকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো যদি প্রতিশোধপরায়ণতার মনোভাব নিয়ে স্কটিশদের ‘হ্যাঁ’ ভোটের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ব্যাপারটা খুব নোংরা হয়ে যাবে, এর জন্য মূল্যও দিতে হবে অনেক। যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো থেকে স্কটল্যান্ডকে দূরে রাখা হয়, তাহলে সেখানে এক আর্থিক ক্ষেত্রে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে পারে, সে কারণে স্কটল্যান্ড ও আরইউকে উভয়েরই আর্থিক ক্ষতি হতে পারে।
শানে নজুল হচ্ছে, এই বিচ্ছেদ কোনো অনিবার্য ব্যাপার নয়, এটা ইচ্ছার ব্যাপার। আরইউকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো ‘হ্যাঁ’ ভোটের ব্যাপারে কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। আর সে ক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীন স্কটল্যান্ড তার আপসরফার ক্ষেত্রে কতটা ন্যায়সংগত অবস্থান নেয়। তারা ঠান্ডা মাথায় কাজ করলে এই স্বাধীনতার জন্য তেমন কোনো মূল্য দিতে হবে না। যেসব অঞ্চলে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো মুরব্বি নেই, সেখানে এরূপ পৃথক হওয়ার বিপদ অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন হলে ও জাতীয় সরকার তা প্রত্যাখ্যান করলে, সে দেশ দুটোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। আবার কখনো কখনো সরাসরি যুদ্ধও শুরু হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া ও সম্প্রতি সুদানের ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই দেখা গেছে।
উল্লিখিত ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার পর গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, এসব সংকট একপ্রকার দীর্ঘস্থায়ীও হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যেসব রাষ্ট্র নতুন গঠিত হয়েছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো তাদের সবাইকে সদস্যপদ দেয়নি। ফলে এক গুরুতর ভূরাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়।
একবিংশ শতকে ভূরাজনীতি শুধু জাতিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হতে পারে না। মূল ইস্যুগুলোর অধিকাংশই জাতির কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয়: বাণিজ্য, অর্থ, আইনের শাসন, নিরাপত্তা ও পরিবেশ। এটা আবার নির্ভর করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপস্থিতি ও কার্যকারিতার ওপর। স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলেও দেশটির উচিত হবে ইউরোপীয় ও বৈশ্বিক আইন ও কর্তব্যের আওতায় থাকা, তারা হয়তো সেটা করবেও।
ব্যক্তিগতভাবে আমি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সমর্থক, এটা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও গণতন্ত্র সংহত করবে। তবে এই সমর্থনের একটি পরিপ্রেক্ষিত আছে, আমার আশা, স্কটল্যান্ড ও আরইউকে উভয়ই একটি কার্যকর ও শক্তিশালী ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর অংশ হয়ে থাকবে।
স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে নিশ্চিতভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল হবে, গণভোটের ফলাফল হয়তো আজকের মধ্যেই জানা যাবে। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো যদি স্কটল্যান্ডকে অন্তর্ভুক্ত না করে, তাহলে আক্ষরিক অর্থেই বিপর্যয় নেমে আসবে। না, শুধু স্কটল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যই নয়, ইউরোপের গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার জন্যও তা বিপর্যয় বয়ে আনবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.