ইসলামিক স্টেটকে কি নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব? by আলী রীয়াজ

জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যে কোয়ালিশন গড়ে উঠেছে, তার লক্ষ্য সামরিক অভিযানের মাধ্যমে এই সংগঠনের বিলুপ্তি ঘটানো। প্যারিসে আনুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এই কোয়ালিশন গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির সমন্বয়ে। গত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি, কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযানের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো এই যে তারা একটি জায়গায় সমবেত থাকে না। যদিও আইএসকে একটি ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা নিয়ে কারও কারও আপত্তি থাকতে পারে যে এই সংগঠন একটি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে এখনো সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়নি, কিন্তু তার আক্রমণের শিকার হয়েছে বিদেশি নাগরিকেরা এবং এই সংগঠনের হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরের নাগরিকেরাও এবং তাদের লক্ষ্য যে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তা অনস্বীকার্য। আইএসের অবস্থান চিহ্নিত নির্দিষ্ট এলাকায়৷ ফলে তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো সম্ভব এবং এটি কোয়ালিশনের জন্য একটি অনুকূল অবস্থা। দ্বিতীয় অনুকূল বিষয় হলো এই যে এই কোয়ালিশনে রয়েছে ১০টি আঞ্চলিক মুসলিম দেশ। তাদের সমর্থন ও অংশগ্রহণের ফলে এই অভিযানকে পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযান বলে চিহ্নিত করা যাবে না।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও এই অভিযানের সাফল্য নিয়ে এবং তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, সামরিক কৌশলের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। এ যাবৎ পশ্চিমা শক্তিগুলো বলেছে যে তারা ইরাককে সাহায্য করবে এবং এ পর্যন্ত বিমান হামলার বাইরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সেনা পাঠানোর ব্যাপারে তাদের অনীহা জানিয়েছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান অভিযান এবং ২০০৩ সালে ইরাক হামলার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দেশই আর প্রত্যক্ষভাবে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে রাজি নয়। কিন্তু কেবল বিমান হামলার মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের একটি বাহিনীকে পরাজিত করা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো উদ্ধার করা সম্ভব বলে কোনো সামরিক বিশেষজ্ঞই মনে করেন না। তার জন্য যে স্থলশক্তি দরকার, সেটা যে ইরাকের নেই, তা সবাই বুঝতে পারেন। কেননা, এই ইরাকি সেনাবাহিনীই আইএসের আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণ করেছে এবং তাদের ফেলে আসা অস্ত্রই জঙ্গিদের বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এসব জানা সত্ত্বেও এ বিষয় নিয়ে কেউই আলোচনায় খুব বেশি উৎসাহী নয়।
তবে মনে রাখা দরকার যে সামরিক কৌশলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে যে কারণ, তার সমাধান খোঁজা। এই কোয়ালিশনে অনুপস্থিত দুই দেশের ভূমিকা আইএসের উত্থানের পেছনে কাজ করেছে, তা হলো ইরান ও সিরিয়া। যদিও তারা উভয়েই চায় যে আইএসের শক্তি ক্ষয় হোক এবং তাদের বিলোপ হোক, কিন্তু দুই দেশের ক্ষমতাসীনেরা চায় না তাতে এমন কোনো শক্তির হাত জোরদার হোক, যা তাদের জন্য হুমকি হতে পারে। যেমন ইরান চায় যে সুন্নি গোষ্ঠী হিসেবে আইএসের অবসান ঘটুক, এতে ইরাকে সুন্নিদের অবস্থানও দুর্বল হবে এবং শিয়ানিয়ন্ত্রিত সরকার জোরদার হবে। আইএস প্রশ্নে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের মিল থাকলেও সিরিয়া প্রশ্নে দুই দেশের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। যেহেতু আইএসের একটি অংশ সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে, সেহেতু আসাদ সরকার চায় যে এদের শক্তির অবসান হোক; কিন্তু তারা মোটেই এটা চায় না যে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করুক বা এই সুযোগে দুর্বল হয়ে পড়া আসাদবিরোধীরা আবার শক্তি সঞ্চয় করুক।
আইএসের প্রতি সৌদি আরবের সক্রিয় সমর্থনের কথা অনেক দিন ধরেই জানা। সৌদি ক্ষমতাসীনেরা নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্ন যে আইএস অতিরিক্ত সাফল্য লাভ করলে তা তাদের জন্যই হুমকি হয়ে উঠবে। কিন্তু আইএসের পরাজয় হলে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যকার প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে সৌদি আরব দুর্বল হবে কি না, সেটাও তাদের বিবেচ্য। ফলে তারা এই অভিযানে কতটা ভূমিকা রাখতে চাইবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আইএসের উত্থানের অন্যতম কারণ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। সেখানে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলনের গোড়াতে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনপুষ্টদের একাংশ যে এই নতুন সংগঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, তা সরবে না বলা হলেও ওয়াশিংটন-লন্ডনের নীতিনির্ধারকেরা সেটা জানেন। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দুটি মত রয়েছে বলেই জানা যায়। একাংশের ধারণা যে সিরিয়ার সংকটের গোড়াতেই আসাদবিরোধীদের সুস্পষ্টভাবে সমর্থন ও সাহায্য প্রদান করলে এই অবস্থার সূচনা হতো না। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তা-ই মনে করেন বলে ফেব্রুয়ারি মাসে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে আরেক অংশের ধারণা, সে সময় কাউকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য না করাই সঠিক হয়েছে। কেননা, এর মধ্যেই আইএসের লোকেরা ছিল, তাদের সাহায্য করলে এখন যুক্তরাষ্ট্রই বিপদগ্রস্ত হতো। যেভাবেই দেখা হোক, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রেখে আইএসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান সফল হবে কি না, তা নিঃসন্দেহে প্রশ্নসাপেক্ষ। আসাদ সরকার বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে একত্রে কাজ করতে রাজি। কিন্তু তার মানে হবে আসাদ সরকারকে মেনে নেওয়া। অন্যদিকে, যদি আসাদ সরকারকে না জানিয়ে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ বিমান হামলা চালায়, তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ।
আইএসের মতো সংগঠনকে আদৌ নিশ্চিহ্ন করা যায় কি না, সে বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা সব সময়ই সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বারবার বলা হয়েছে যে সংগঠন হিসেবে একে অস্তিত্বহীন করে ফেলার ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। যা করা যেতে পারে তা হলো তাকে নেতৃত্বহীন করে ফেলা, তার আবেদন অকার্যকর করা এবং আদর্শিকভাবে এ ধরনের আদর্শের বিরুদ্ধে প্রচারণা অব্যাহত রাখা। তা ছাড়া যেসব কারণে এ ধরনের সংগঠনের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হওয়ার যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া। এখন আবার যখন আইএসের ধ্বংসসাধনের ও নিশ্চিহ্ন করার কথা বলা হচ্ছে, এই আলোচনা আবারও ফিরে এসেছে।
আইএসের বিরুদ্ধে অভিযানের এসব সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এক দিনে পাওয়া যাবে না। কেননা, এমন ধারণা করার কারণ নেই যে এই অভিযান হবে স্বল্প সময়ের অভিযান। যে কারণে প্যারিসের ঘোষণাপত্রে কেবল সামরিক অভিযানের কথা বলা হয়নি; বলা হয়েছে আঞ্চলিক সীমান্তগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা, আইএসের অর্থের সংস্থান বন্ধের ব্যবস্থা করা, বিদেশিদের এই যুদ্ধে যোগদান বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া এবং এই আদর্শের মোকাবিলা করার কথা।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.