আপিলে সাঈদীর সাজা কমায় সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা ও তদন্ত সংস্থা মুখোমুখি by মহিউদ্দিন ফারুক ও কুন্তল রায়

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দেওয়া রায় নিয়ে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সহসমন্বয়ক এম সানাউল হকের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একে ‘দুঃখজনক ও দায়িত্বহীন’ কাজ বলে মন্তব্য করেন। ট্রাইব্যুনালে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে না টেকার কারণ হিসেবে তদন্তের দুর্বলতাকে মুখ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত বুধবার রায় ঘোষণার পরই নিজের হতাশা প্রকাশ করেছেন। এক দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেছেন, সাঈদীর আপিলে প্রত্যাশিত রায় না পাওয়ার পেছনে তদন্ত সংস্থার দুর্বল তদন্তই মুখ্য। তিনি ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তদন্ত সংস্থা এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে বলেছে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।
গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত বুধবার সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন। এই রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আসামিপক্ষ একটি এজাহারের সত্যায়িত অনুলিপি আদালতে জমা দেয়। এতে সাঈদীর নাম ছিল না। আসামিপক্ষের জোরালো বক্তব্য ছিল, কুট্টিকে যদি সাঈদী মারতেন, তবে কুট্টির স্ত্রীর করা মামলায় অবশ্যই সাঈদীর নাম থাকত। তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে এমন কোনো নথি সংগ্রহ করা হয়নি, যাতে প্রমাণ করা যায় ওই এজাহারটি এই মামলার জন্য বানিয়েছে আসামিপক্ষ। এ ছাড়া ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত হয়েছে কি না, অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে কি না বা বিচার হয়েছে কি না, হলে কতদূর হয়েছে, তার নথিপত্র খুঁজে বের করা প্রয়োজন ছিল। তা করা হয়নি।
মাহবুবে আলম আরও বলেন, ‘শুনানির সময় যখন আমি এ বিষয়ে কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাচ্ছিলাম না, তখন আমি নিজ উদ্যোগে একবার পিরোজপুর হয়ে বরিশালে যাই। আরেকবার শুধু বরিশালে যাই। পিরোজপুর মহাফেজখানায় সামান্য খোঁজাখুঁজিতেই একটি জিআর রেজিস্টার পাই, যাতে ওই এজাহারের উল্লেখ আছে। কিন্তু মামলার অভিযোগপত্র কবে হয়েছে, মামলা খারিজ বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে কি না, তার উল্লেখ ওই রেজিস্টারে ছিল না। তখন আমি বরিশাল যাই। কিন্তু রেকর্ডরুম ও কোর্টের সেরেস্তায় ওই সময়ের কোনো রেজিস্টার খুঁজে পাইনি। এ থেকে আমার ধারণা, ওই এজাহারের পরে নিশ্চয়ই তদন্ত হয়েছে এবং এতে কয়েকজন ব্যক্তির নাম ছিল, যেসব নাম লুকানোর জন্যই মামলার রেজিস্টার ও নথি হয়তো গায়েব বা নষ্ট করা হয়েছে।’
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যকে উড়িয়ে দেন তদন্ত সংস্থার সহসমন্বয়ক এম সানাউল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত কি রায়ে উল্লেখ করেছেন যে তদন্ত সংস্থার গাফিলতি ছিল? আমরা আরও ১০টা মামলা তদন্ত করেছি, যেগুলোতে আসামিরা শতভাগ দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সেগুলোর তদন্ত তো আর জিন-ভূতে করেনি, আমরাই করেছি। এখন আমাদের বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা চলছে। পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে যদি উনি (অ্যাটর্নি জেনারেল) এসব কথা বলতেন, তাহলে অনেক ভালো হতো। সেটি না দেখে কারও ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘পিরোজপুর-বরিশালে আমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। মুঠোফোনে আমাকে হুমকিও দেওয়া হয়। এ থেকে আমার স্পষ্ট ধারণা হয়, ওই নথি গায়েবের সঙ্গে একটি চক্র আছে, যারা সাঈদীকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, তারা আমাকে অনুসরণ করেছে এবং ভয়ভীতি দেখিয়েছে। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মামলা চলাকালে নথি খোঁজার দায়িত্ব আমার নয়। যখনই আসামিপক্ষ থেকে এসব নথি দাখিল করা হয়, তখনই তদন্ত সংস্থার উচিত ছিল সর্বশক্তি দিয়ে ওই এজাহারের ধারাবাহিকতায় পরে কী হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সঙ্গে বসে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া।’
সানাউল হক বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে বরিশাল-পিরোজপুরে গিয়ে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর এজাহার উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ওই জেলার প্রশাসক, পুলিশ কর্মকর্তারা এমন কোনো নথির অস্তিত্ব পাননি। এ ছাড়া এটা আসামিপক্ষের দাখিল করা নথি, তাই এটা প্রমাণের দায়িত্বও আসামিপক্ষের। তিনি বলেন, ‘তদন্ত সংস্থা যখন প্রতিবেদন জমা দেয়, তখন এতে কী কী ঘাটতি আছে, তা রাষ্ট্রপক্ষ বললে অধিকতর তদন্ত করার সুযোগ থাকে। সাঈদীর তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের কিছুই বলেনি, ট্রাইব্যুনালও তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন। কিন্তু এখন আপিল বিভাগে সাজা কমে যাওয়ায় তদন্ত সংস্থাকে জাতির সামনে হেয় করা হচ্ছে।’
ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগের একাংশে সাঈদীকে ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বিসাবালী হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা দেন আপিল বিভাগ। এ দুটি অভিযোগেই ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন।
বিসাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের যে অভিযোগ আসামিপক্ষ করেছে, সে বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘যখনই বিচার শুরু হয়, তখনই তদন্ত সংস্থার উচিত ছিল মামলার সম্ভাব্য সাক্ষীদের এলাকা থেকে সরিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সাক্ষীদের যেন ভয়ভীতি না দেখাতে পারে, সে জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তদন্ত সংস্থা তা অনুধাবন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ায় সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারকে আপিল শুনানি চলাকালে দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করেছে।’
তবে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান প্রশ্ন তোলেন, ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাহলে এখানে তদন্ত সংস্থার দুর্বলতা কোথায়? আর ট্রাইব্যুনাল তাঁর রায়ে কি তদন্ত সংস্থার কোনো দুর্বলতার কথা লিখেছেন?
সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়ে সানাউল হক বলেন, সাক্ষী সুরক্ষার কাজ তদন্ত সংস্থার নয়, আইনে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। ট্রাইব্যুনালের বিধিতেও সাক্ষী সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারকে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সংস্থার তাগিদেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয়ভাবে সাক্ষী সুরক্ষা কমিটি করেছে। এরপর জেলায় জেলায় সাক্ষী সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক।
ট্রাইব্যুনালে দায়িত্বরত রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, ‘ফৌজদারি মামলা বিচারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ প্রসিকিউটর নিয়োগ করা জরুরি; যাঁরা ওকালতি জীবনে অন্তত কয়েকটি ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেছেন। আমার জানামতে, ট্রাইব্যুনালে গুটি কয়েক প্রসিকিউটর ছাড়া অনেকেই ফৌজদারি মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।’
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্তে বা মামলা পরিচালনায় অনভিজ্ঞতা আমাদের সবারই ছিল; কিন্তু গাফিলতি ছিল না। প্রসিকিউশনের সবাই মিলে আমরা এ মামলাটি করেছি, ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’
জানতে চাইলে ওই সময়ের আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে, কারণ তিনি আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনা করেছেন। মন্ত্রী থাকাকালে আমি কখনোই তদন্ত সংস্থা বা প্রসিকিউশনের কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিনি, কারণ তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন।’ তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল কি আপিল বিভাগে মামলা চালানোর সময় ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি বা অন্য কৌঁসুলিদের ডেকেছিলেন, মামলা নিয়ে আলোচনা করেছেন বা কথা বলেছেন?’
তবে মাহবুবে আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার আপিলে কোনো ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকে না। আপিল বিভাগে যখন মামলাটি শুরু হয় তখন আমি সৈয়দ হায়দার আলীকে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু উনি ট্রাইব্যুনালের মামলার কাজে ব্যস্ত থাকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সময় দিতে পারেননি।’
সার্বিক বিষয়ে বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রাতে বলেন, ‘যা হয়েছে তার কিছুই আমার সময়ে হয়নি, আমি তখন মন্ত্রী ছিলাম না। আমি যা করতে পারব তা হলো, এসবের একটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। তবে কাউকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই, এখন যা হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও সবার তরফ থেকে দায়িত্বহীন কাজ। এটা না করার জন্য আমি অনুরোধ করছি।’

No comments

Powered by Blogger.