আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উল্লাস by মোহাম্মদ আবুল হোসেন


আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মুখে তখন হাত। স্তব্ধ সবাই। হাতে ধরা চায়ের কাপ কখন ঠান্ডা হয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি অনেক সমর্থক। কি হচ্ছে ব্রাজিলের করিন্থিয়ান্স স্টেডিয়ামে! বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি, অ্যানজেল ডি. মারিয়া প্রাণান্ত যুদ্ধ করছেন সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের ‘কংক্রিটের’ নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ওই চার কোণার টার্গেটে বল পৌঁছাতে পারছিলেন না। যখনই মেসি, ডি. মারিয়া লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান বীরবিক্রমে তখনই বুকে আশার সঞ্চার হয় আর্জেন্টিনা সমর্থক শিবিরে। কিন্তু না। প্রতি বারই লক্ষ্যভ্রষ্ট। উত্তেজনার পারদ তখন স্ফুটনাংকে। রক্তের গতি বেড়ে গেছে বহুগুণ। হিমোগ্লোবিন হয়তো আস্তে আস্তে হিম হয়ে আসছে। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। শুধু কি তাই! যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে লড়ছে, এবারের বিশ্বকাপে ফেভারিট- তাদের দেশে তখন হিমশীতল এক অনুভূতি। মানুষের মুখে কোন কথা নেই। আঠার মতো কোটি চোখ লেগে আছে টেলিভিশন পর্দায়। দম বন্ধ করা এক মুহূর্ত। ঠিক এমন সময় যেন বোমা ফাটলো। বোমা নয় তো নিউক্লিয়ার বোমা। হিরোশিমা নাগাসাকিকে যে হাইড্রোজেন বোমা মৃতপুরীতে পরিণত করেছিল তার চেয়ে যেন শতগুণ শক্তি নিয়ে ফাটলো সে বোমা। পটোম্যাক থেকে পদ্মা, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্রই যেন ভূমিকম্প হলো। গগনবিদারি চিৎকারে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে সমস্বরে বিস্ফোরণ হয় ‘গো...ল’। হ্যাঁ, গোল। অতিরিক্ত সময়ের শেষ হওয়ার তখন দুই কি তিন মিনিট বাকি। ঠিক এমন সময়েই আর্জেন্টিনার ‘খাঁটি সোনা’ সেই লিওনেল মেসি শতভাগ খাঁটি কাজটি করলেন। প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের সামনে গিয়ে যে বল পাস দিলেন ডি. মারিয়ার কাছে, তার শতভাগ সদ্ব্যবহার করলেন মারিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার- যেখানে মানুষ ঘুমিয়ে পড়েন সন্ধ্যা সাতটা বা আটটার মধ্যে, সেখানকার মানুষও আনন্দে ফেটে পড়লেন। একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ প্রকাশ করলেন। কেউবা আবেগে কেঁদে ফেললেন। অনেক গ্রামে-গঞ্জে, বাজারে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে শুরু হলো মিছিল, আনন্দমিছিল। দূর গ্রামের রাজ্জাক শেখ বললেন, বাড়িতে টেলিভিশন নেই। এক কিলোমিটার দূরে ভাটদি বাজারে গিয়েছিলাম খেলা দেখতে। একপর্যায়ে ভাই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু কি দেখালেন মেসি! অবিশ্বাস্য! পুরোপুরি জাদু! তাই তাকে নিয়ে সারা বিশ্বে এত মাতামাতি। ঢাকার চিত্র তো বলার অপেক্ষা রাখে না। রোজা রেখে ক্লান্ত হয়েও ঢাকার কোটি দর্শক টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। শ্বাসরুদ্ধকর এ প্রতীক্ষার অবসান হতেই ঢাকার দালানগুলোর ভিতর থেকে চিৎকার, উল্লাস, আনন্দ-আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। এমন দৃশ্য, এমন অভিজ্ঞতা সহসা মেলে না। যারা আর্জেন্টিনার ভক্ত, যারা ভক্ত নন, ব্রাজিলের ভক্ত- সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন মেসিযুদ্ধ। মেসির সমালোচনা করেন অনেকে। কিন্তু মুখ টিপে গোপনে তার খেলা ভালবাসেন। এমনকি প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের গোলের নায়ক নেইমারও মেসির ভক্ত। মঙ্গলবার রাতের ফুটবলযুদ্ধ শেষে ঢাকার আকাশে, দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দ্বীপের মতো দাঁড়ানো গ্রামের মাথার ওপরে টাঙানো আর্জেন্টিনার পতাকা যেন আরও পত্‌ পত্‌ করে উড়ছে। এদেশের গ্রামে-গঞ্জে আর্জেন্টিনার যে অগণিত, স্বার্থহীন প্রেমিকদল আছেন তারা পকেটের টাকা খরচ করে উৎসবে মেতে উঠেছেন। কোথায় নেই তারা! যেমন আছেন ব্রাজিলের ভক্ত। তেমনি আছেন আর্জেন্টিনার ভক্ত। আর্জেন্টিনার ভক্তরা এখন উল্লাস করতে করতে বলছেন, ব্রাজিল তো জিতেছে টাই-ব্রেকারে। কিন্তু আর্জেন্টিনা জিতেছে খেলে। হতে পারে সে জেতা অনেক কঠিন ছিল। এর মূল্য অসীম। আর তাই তো আর্জেন্টিনা এখন কোয়ার্টার ফাইনালে। আর্জেন্টিনার রাজধানী  মঙ্গলবার রাতে ঘুমায়নি। সুনসান বুয়েন্স আয়ারস যেন এক তিলিকের মধ্যে আনন্দের নগরীতে পরিণত হলো। মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সমস্বরে তারা গাইলেন মেসি বন্দনা। গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত। গাড়ির হর্নে বেসামাল হয়ে পড়লো প্রতিটি গলিপথ, রাজপথ। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। খুলে গেছে সব বার, পাব। সেখানে মানুষের ভিড়। সবারই এক আনন্দ। কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নেই। সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়েন। তাদের মুখে, বুকে আর্জেন্টিনার পতাকা আঁকা। কেউ চুল কাটিয়েছেন মেসির মুখাবয়বে। কত যে আয়োজন তখন বুয়েন্স আয়ারসে তার শেষ নেই। আর গ্রাম, গাঁয়ে ছেলে-বুড়ো-ঝি বেরিয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে হাতে পতাকা। দেশের পতাকা। কিন্তু এই আনন্দের মাঝে তারা একজনের অভাব বড় বেশি করে অনুভব করলেন। তিনি হলেন আর্জেন্টিনার ফুটবলের কিংবদন্তি দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা।

No comments

Powered by Blogger.