সেই মন্ত্রী কবে হবে by কাজল ঘোষ

কুসুমকুমারী দাসের একটি কবিতার লাইন খুবই মনে পড়ছে। আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। মনে পড়ার সঙ্গত কারণ আমাদের মন্ত্রীদের অতিকথন। এটা যে এ সরকারের মন্ত্রীরা করছে আর অন্য সরকারের মন্ত্রীরা করেনি তা নয়। আমাদের এখানে কালে কালে মন্ত্রীদের সুবচন প্রশংসিত এবং আলোচিত। ঈদ এলেই অনেক পুরনো বিষয় ঘুরে-ফিরে আমাদের মধ্যে আলোচনায় আসে। এবারকার ঈদেও এসেছে। মন্ত্রীদের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী বরাবরই ঈদ ঘিরে আলোচনায় থাকেন। এবারও এর ব্যতিক্রম নন। বলা যায়- অনেকটা রেকর্ডও করেছেন। তিনি অনেক রকমের আলটিমেটাম আমাদের উপহার দিয়েছেন। সবশেষে শুনিয়েছেন আগামী ঈদ নির্বিঘ্নে করার প্রতিশ্রুতি। আগামীতে সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও কোন ঈদে এটা স্পষ্ট নয়। এটা কি আরো দু’মাস পরই আসছে যে ঈদ। নাকি তারও পরের। যা হোক আমরা আশায় আবারও বুক বাঁধলাম। হয়তো সামনে সুদিন আসছে। তবে এটুকু বলতেই হবে, সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করতে না পারলেও তিনি পথে নেমেছেন। অন্তত হেঁটেছেন। তবে ঈদের আগে যোগাযোগমন্ত্রীর বাইরে এবার সরকারি দলের বর্তমান ও সাবেক আরও দু’জন আলোচনায় আছেন। একজন সাবেক মন্ত্রী খন্দকার হাসান মাহমুদ এবং অন্যজন সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী। গাজায় লাশ পড়ছে ইসরাইলি হামলায়। বিশ্বমানবতা যেখানে গুমরে কাঁদছে সেখানে আমাদের সাবেক মন্ত্রী হাসান মাহমুদ এটাকে রাজনৈতিক রঙ লাগালেন। বলে বসলেন, গাজায় ইসরাইলি হামলায় যুক্ত ইহুদিদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক থাকতে পারে। রাজনীতিকরা ভালোরকমের কথাশিল্পী। কথার জোরেই এত অসঙ্গতি আর অভিযোগ নিয়েও আমাদের মন্ত্রীরা সফেদ হয়ে যান। তাদের পোস্টারে ছাপা অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। অমুক ভাইও যেখানেই যান মাইক পেলে অমায়িক হয়ে যান। আমজনতা বিভ্রান্ত হয়ে সেইসব নেতাদের বরণ করে নেন। ফিরে আসি মূল কথায়। গাজায় হামলার সঙ্গে বিএনপিকে সম্পৃক্ত কি ধরনের গাঁজাখুরি মাথায় ঢুকে না। যা হোক নেতা বলে কথা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রীতো হঠাৎ বোমা ফাটালেন। এমন আইনের দোহাই দিয়ে তিনি মিডিয়াকে চোখ রাঙালেন। ভাবার কারণ নেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন করবেন আর গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের কর্মীরা মন্ত্রী মহোদয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়বেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন তিনি জেগে ঘুমিয়েছেন। যা হোক গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের আওয়াজ যেকোন দুর্বল শাসকের পুরনো কৌশল। যখন দেশে বিরোধী দল থাকে সরকারের অংশ তখন গণমাধ্যমকেই মূল বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। আর গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা কখনই সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হতে পারে না। কালে-কালে আমাদের মন্ত্রীরা বহুবিধ প্রকৃতির সুবচন উগরে দিয়েছেন। তার কিছু উল্লেখ করে আজকের লেখার যবনিকাপাত টানতে চাই। বিএনপি জমানায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন দুর্ঘটনায় নিহত একটি শিশুর মৃত্যু নিয়ে বলেছিলেন, আল্লার মাল আল্লায় নিয়েছে। তাতে ওনার কি করার আছে। সেই কথা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তারপর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের লুকিং ফর শত্রুজ এখনও লোকমুখে ফিরে। তারপর আওয়ামী লীগ জমানার মন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডির দিনই হাজির করলেন নড়াচড়া তত্ত্ব। দোষ চাপালেন বিরোধী দলের ঘাড়ে। হরতালের পিকেটাররা পিলার ধরে নড়াচড়া করার কারণেই নাকি এই ভবনে ধসের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কতোটা হাস্যকর হতে পারে এমন দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে এধরনের বক্তব্য দেয়া তাতো আমরা পরবর্তীতে দেখতে পেয়েছি। আর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার নিয়ে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের পালাক্রমে দেয়া বক্তব্য মিলালে মানুষের জীবন নিয়ে কি সীমাহীন খামখেয়ালি করা হয়েছে তার হিসাব মিলবে। ঘটনার দিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সবচে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এ ঘটনার মূল হোতাদের গ্রেপ্তারে আলটিমেটাম ঘোষণা করলেন। এরপর থেকে কত দফায় এই আলটিমেটাম পার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়েতো বলে বসলেন, সবাই যেন ঘরে ঠিকমতো তালা মেরে যান। নিরাপত্তা মন্ত্রী হয়ে সবার নিরাপত্তা নিজেদের খুঁজতে বলে তিনি হাসির খোরাক যোগালেন। তারপর মহীউদ্দীন খান আলমগীর দায়িত্ব নিয়েও নানান চমক দেখালেন সাংবাদিক দম্পতি হত্যার বিচার নিয়ে। বাস্তবতা হচ্ছে মেঘ তার বাবা-মায়ের হত্যার বিচার এখনও পায়নি। আদৌ পাবে কিনা তাও সূদুরপরাহত। ফিরি কুসুমকুমারী দাসের কবিতাতেই। আধুনিক যুগের অন্যতম সেরা কবি জীবনানন্দ দাসের মায়ের এই চরণগুলো চিরায়ত কালের যন্ত্রণা বয়ে ফিরছে। আমাদের সমাজে আমরা কেবলই কথার ফুলঝুরি নিয়ে ব্যস্ত। কথায় নয়, আমরা কবে দেখবো আমাদের সমাজে সেই মন্ত্রী কবে হবে- কথায় নয় কাজে বড় হবে।

No comments

Powered by Blogger.