গাজা জ্বলছে, অথচ বিশ্ব নির্বিকার by হাসান ফেরদৌস

ফিলিস্তিনের গাজা একটি অতি ক্ষুদ্র অঞ্চল। এক দিকে ভূমধ্যসাগর, আরেক দিকে মিসর, বাকি দুই দিকে ইসরায়েল। মোট আয়তন মেরেকেটে মাত্র ১৪০ বর্গমাইল। একটা বড় অংশ মরুপ্রবণ, ফলে বসবাসের অযোগ্য। এরই মধ্যে ঠাসাঠাসি করে প্রায় ২০ লাখ লোকের বাস, যাদের অধিকাংশই উদ্বাস্তু। অর্ধেকের বেশি মানুষ বেকার, জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থার খয়রাতির ওপর নির্ভরশীল। সেই গাজা জ্বলছে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে গাজার উত্তরাঞ্চল ভেঙে চুরমার, নিহতের সংখ্যা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাত শতাধিক। আহতদের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। হতাহতদের অধিকাংশই শিশু ও নারী।

গাজায় এই নির্বিচার বোমা হামলা টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ও স্মার্টফোনের কল্যাণে আমরা যার যার ঘরে বসেই নিরাপদ দূরত্বে দেখতে পাচ্ছি। বিচলিত যে হচ্ছি না, তা নয়। কিন্তু কোনো প্রকৃত ক্রোধ—ইংরেজিতে যাকে বলে আউটরেজ—সে বোধের কোনো প্রকাশ আছে, তা বলা যাবে না। এ নিয়ে অবিলম্বে কিছু করা দরকার, কোনো পক্ষ থেকেই তার কোনো বিশেষ তাড়না নজরে পড়ছে না। সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা, এ ঘটনায় সবচেয়ে বিচলিত হওয়ার কথা যাদের, সেই আরবদের মধ্যে লক্ষণীয় উদ্বেগ নেই। এমনকি পশ্চিম তীরের অন্য ফিলিস্তিনিরাও কার্যত নীরব। সে কথা উল্লেখ করে বিখ্যাত ইসরায়েলি সাংবাদিক আমিরা হাস সম্প্রতি হারেৎস দৈনিকে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘পশ্চিম তীরে কোনো প্রতিবাদের বিস্ফোরণ নেই কেন?
(http://www.haaretz.com/news/diplomacy-defense/.premium-1.605866)
এ প্রশ্নের উত্তরও আমিরা নিজেই দিয়েছেন। পশ্চিম তীরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুখে যতই চেঁচান, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার এই বিবাদে তাঁরা নাক গলাতে চান না। পশ্চিম তীরের নাগরিকেরা তাতে জড়িয়ে পড়ুন, তা-ও তাঁদের পছন্দ নয়। প্রতিবাদ করছেন অথবা করতে পারেন, এমন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের সরকারি প্রচারযন্ত্র থেকে অনবরত ‘মিলিট্যান্ট মিউজিক’ পরিবেশন করছে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন হামাস-সমর্থকদের সমানে গ্রেপ্তার করছে। আমিরা লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিন অথরিটির বর্তমান ভূমিকা অসামঞ্জস্যপূর্ণ—একদিকে তারা মুখে ইসরায়েলি অধিগ্রহণের নিন্দা করছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের নির্দেশ অনুগতভাবে মেনে চলেছে।’
এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই যে অব্যাহত ইসরায়েলি অবরোধের মুখে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিবাদ গড়ে তোলা সহজ নয়। ঘাড়ের ওপর বন্দুক উঁচিয়ে ইসরায়েলি সেনা। বেঁচে থাকার জন্য ফিলিস্তিনিরা সর্বতোভাবে ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় সামরিক পথে তাদের সমস্যার সমাধান হবে না, এ সত্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বোঝে, ফলে তারা রাজনৈতিক আপস-আলোচনার পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু কোনো জাতীয় সম্মিলিত রণকৌশল অনুসরণের বদলে মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন সরকার চেয়ে আছে একদিকে ইসরায়েলের মর্জির আশায়, অন্যদিকে আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের খেয়াল-খুশির ওপর। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ফিলিস্তিনের বর্তমান নেতৃত্ব দুর্বল, ফলে তাঁদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার কোনো তাগিদ ইসরায়েলের নেই।
ফিলিস্তিন নেতৃত্বের এই ব্যর্থতার জন্য আমিরা সরাসরি অঙ্গুলি তুলেছেন মাহমুদ আব্বাসের প্রতি। তাঁর সরকারের কোনো যৌথ চরিত্র নেই, সব সিদ্ধান্ত আব্বাস একাই গ্রহণ করেন। সে অর্থে তিনি এক খুদে ‘একনায়ক’ ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর নেতৃত্বাধীন ফাতাহ কখনোই হামাস পরিচালিত কোনো বিদ্রোহ বা প্রতিরোধের প্রতি সমর্থন জানাবে না। রাজনৈতিকভাবে তারা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী৷ ফলে কোনো পক্ষই এমন কিছু করবে না, যা অন্য পক্ষের হাত শক্ত করে।
শুধু পশ্চিম তীর বা মাহমুদ আব্বাসের সরকার কেন, আরব বিশ্বের কোনো দেশ থেকেই গাজার হতভাগ্য মানুষ সমর্থন ও সংহতির বাণী শোনেনি। গাজার বাঁচা-মরার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মিসর। একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে ইসরায়েল থাকায় এই বদ্ধ খাঁচা থেকে তাদের বেরোনোর একমাত্র পথ হলো মিসর। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত তুলে সব সরকারি প্রবেশ-প্রস্থানের পথ বন্ধ করে রেখেছে মিসর। খুব জরুরি ত্রাণসাহায্য পৌঁছানোর চাপ বাড়লে কয়েক ঘণ্টার জন্য সীমান্ত ফাঁড়ি খুলে দেওয়া হচ্ছে। সে পথ দিয়ে বেরোতে হলে সবচেয়ে বেশি যা দরকার, তা হলো উৎকোচ। মিসরীয় পুলিশ আবার মার্কিন ডলার ছাড়া অন্য কোনো উৎকোচে বিশ্বাস করে না। মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসি হামাসের ব্যাপারে তাঁর বিবমিষা কখনো গোপন রাখেননি। হামাস ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির প্রতি সমর্থন দিয়েছিল, ফলে হামাসের প্রতি সিসির ক্রোধের কারণ বোঝা কঠিন নয়। বস্তুত, ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর মিসরের সরকারি সমর্থনে টুইটারের সবচেয়ে জনপ্রিয় যে হ্যাশট্যাগ চালু হয়, তা হলো, ‘শত্রুর নাম হামাস’৷
(http://www.bbc.com/news/blogs-trending-28310504)
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নিজেদের জাতভাইদের ব্যাপারে আরবদের এই অনীহা কেন?
প্রশ্নটি খুব স্পর্শকাতর বিধায় অধিকাংশ সময়েই আমরা তা এড়িয়ে সব দোষ হয় ইসরায়েল, নয় যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই। এ দুই নাটের গুরুর ভূমিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যারা সমস্যার কারণ, তাদের কাছ থেকেই সমাধান আশা করা মূর্খতা। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে প্রবল আগ্রাসী অবস্থান গ্রহণের কারণে বিবি নেতানিয়াহু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি দখল করেছেন। শান্তি আসুক, এমন কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তঁার নেই। তা ছাড়া সে আরব আক্রমণের শিকার—এই অদ্ভুত অজুহাতে ইসরায়েল প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের সরকারি অনুদান পেয়ে আসছে। এর বাইরে কট্টর ইসরায়েলপন্থী মার্কিনদের কাছ থেকে প্রতিবছর যে চাঁদা আসে, সে কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। অতএব, শান্তির পক্ষে কোনো যৌক্তিক ‘ইনসেনটিভ’ নেতানিয়াহু বা ইসরায়েলের নেই। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক ও কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে কঠিন আঁতাতে সম্পৃক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে যে ইসরায়েল লবি রয়েছে, তার বিরুদ্ধাচরণ করে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকবে, এমন কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের এখনো আবির্ভাব হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও দেখি না।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের কোনো নিকট বা দূরের আরব প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্যার সমাধান হোক, মনেপ্রাণে তা চায় না। আমি আরব জনগণের কথা বলছি না, বলছি আরব নেতৃত্বের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা জিইয়ে রেখে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে মিসর। তারা প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়ে থাকে মুখ্যত মধ্যপ্রাচ্যের চলতি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখতে। এখানে স্মর্তব্য যে, ১৯৪৮ সালের পর থেকে, অর্থাৎ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ পর্যন্ত এই গাজা অঞ্চল মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্য কোনো আরব দেশ, তা তারা মুখে যা-ই বলুক, বস্তুত ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন, বহুপক্ষীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হোক, তা চায় না। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রতিবেশী একটি দেশে যদি প্রকৃত গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা আসন গাড়ে, তাহলে সবচেয়ে বড় বিপদ হবে সেই সব দেশের, যারা এখনো রাজরাজড়ার শাসনাধীন। অথবা শুধু নামে গণতন্ত্রের নামাবলি চাপিয়ে বেশ চড়িয়ে খাচ্ছে। আপনারাই ভেবে দেখুন, এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে কোন আরব দেশ আছে, যারা সাধ করে এমন এক কালসাপ পুষবে?
এমনকি খোদ ফিলিস্তিনের চলতি রাজনৈতিক নেতৃত্বও বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অনুগত, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। অধিকৃত ফিলিস্তিনে সীমিত আকারের হলেও একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬, যাতে গাজা অঞ্চলে হামাস নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। সেই নির্বাচনের ফলাফল ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র তো মানেইনি, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন অথরিটিও তা আমলে আনেনি। সেটা আট বছর আগের কথা, এরপর পশ্চিম তীর বা গাজায় কোথাও নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। কারণ, নিরপেক্ষ সব পর্যবেক্ষকই মানেন, নতুন নির্বাচন হলে হামাস বা ফাতাহর চলতি নেতৃত্বের অধিকাংশই পরাস্ত হবে।
দুই বছর আগে স্বল্প কয়েক দিনের জন্য আমি অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন গাজা শান্ত, যদিও ইসরায়েলের রক্তচক্ষু এড়ানো সে অঞ্চলের কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, তাঁরা কেউ হামাস অথবা ফাতাহ কোনো দলের প্রতিই সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছেন না। এদের মাধ্যমে শান্তি আসবে, এ কথা বিশ্বাস করে, সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের বাইরের একজনকেও আমি খুঁজে পাইনি। রাফা নামে একটি মেয়ের কথা খুব মনে আছে। আমার হাত ধরে সে মিনতি করেছিল, ‘ভাই, এই নরক থেকে বেরোনোর একটা পথ বলতে পার?’
গাজা এখন জ্বলছে। খুব জানতে ইচ্ছা করে, রাফা এখন কেমন আছে।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.