ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা হলেও বাড়ির পথে নির্বিঘ্ন যাত্রা

বাড়ি যাওয়ার আনন্দ ছিল সবার চোখেমুখে। পথের শঙ্কা হয়তো ছিল মনের ভেতরে, কিন্তু চেহারায় তার ছাপ দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত স্বস্তিদায়কই ছিল গতকালের যাত্রা। বাসের যাত্রীদের যানজটে পড়তে হয়নি। বেশির ভাগ ট্রেনই সময়মতো ছেড়েছে। লঞ্চও ছেড়েছে ঠিকঠাক। তবে টিকিটের জন্য হাহাকার ছিল। বাড়তি ভাড়া আর কালোবাজারি কষ্ট ছিল যথারীতি।

>>ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা হলেও হাসিমুখেই তা মেনে নিয়েছেন ট্রেনের বগিতে জায়গা না পাওয়া এই যাত্রীরা। নিষেধ অমান্য করে ছাদে উঠেছেন তাঁরা। দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকলেও নিরাপদেই বাড়ি ফিরবেন—এমন আশা নিয়েই গতকাল রাজধানী ছেড়েছেন তাঁরা। ছবিটি টঙ্গী রেলস্টেশন থেকে তোলা: প্রথম আলো
এবারের ঈদযাত্রা শুরু হয়ে গেছে গত বৃহস্পতিবারই। সে অর্থে গতকাল ছিল ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিন। তবে জুমাতুল বিদা ও শবে কদরের কারণে গতকাল শুক্রবার অনেক যাত্রী হয়তো যাত্রা করেনি। তাই অস্বাভাবিক জনস্রোত ছিল না। বিপণিবিতানকেন্দ্রিক যান-জটলা বাদ দিলে রাজধানীর রাস্তাঘাট ছিল মোটামুটি ফাঁকা। ভিড় ছিল কেবল গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে উত্তরবঙ্গে চলা শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের কর্মী নুরুল ইসলাম বলেন, শবে কদরের রাতের পরের দিন ভিড় বেশি থাকে। এ ছাড়া পোশাক কারখানার কর্মীরাও শনিবার (আজ) থেকে যাত্রা শুরু করবেন। সে হিসেবে শনিবার মানুষের চাপ বেড়ে যাবে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা, পুলিশ ও পরিবহনের মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন হওয়ার কয়েকটি কারণের কথা জানা গেছে। এগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশের বিশেষ দল টার্মিনালগুলোতে সক্রিয় ছিল। তৎপর ছিল হাইওয়ে পুলিশও। আর ছিল ঈদের আগে ও পরে পাঁচ দিন ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণের প্রভাব। সড়ক-মহাসড়কের খানাখন্দ মেরামতের কাজ গতকালও চলছিল।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে কল্যাণপুর থেকে বগুড়া যাওয়ার জন্য এসআর পরিবহনের একটি বাসে ওঠার সময় কথা হয় যাত্রী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, পথে টুকটাক যানজট বাদ দিলে নির্বিঘ্নেই বগুড়ায় পৌঁছান সাড়ে চারটার দিকে।
কমলাপুর স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট পথের যেসব ট্রেন ছেড়ে গেছে সেগুলোতে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও তা উপচে পড়া ছিল না। তবে সকালে উত্তরবঙ্গের তিস্তা এক্সপ্রেসে যাত্রীদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। রাতে উত্তরবঙ্গের দ্রুতযান ও লালমনি এক্সপ্রেসেও যাত্রীদের দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। এ দুটি ট্রেনে বিমানবন্দর থেকে অনেক যাত্রী ছাদেও চড়ে বসে।
রেলের মহাপরিচালক তাফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত কমলাপুর স্টেশন থেকে ৫৪টি ট্রেন ছেড়ে যায়। এর মধ্যে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও নোয়াখালীমুখী উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি এক ঘণ্টা ২০ মিনিট করে দেরিতে যায়। বাকি সবগুলোই সময়মতো ছেড়েছে।
রাত-দিন মিলিয়ে কমলাপুর থেকে ৬৬টি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা। এসব ট্রেনের আসনসংখ্যা আছে প্রায় ৬০ হাজার। ঈদে দাঁড়িয়েও প্রচুর যাত্রী ভ্রমণ করে।
রেলের মহাপরিচালক বলেন, শুক্রবার যাত্রীর চাপ তুলনামূলক কম ছিল। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের চাপ বেড়ে যাবে ঈদের আগের দুই দিন। আজ শনিবার থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও খুলনাসহ কয়েকটি পথে বিশেষ ট্রেন চলানো হবে বলে জানান তিনি।
টিকিট না কাটার বিড়ম্বনা: ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন সেলিম, ওবায়দুল্লাহ, রাকিবসহ একই এলাকার আটজন। যাবেন নওগাঁর সাপাহার। কিন্তু আগে থেকে টিকিট কাটা নেই বলে পড়েন বিড়ম্বনায়।
এই আট রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কল্যাণপুরে এই প্রতিবেদকের কথা হয় গতকাল বেলা তিনটার দিকে, হানিফ পরিবহনের কাউন্টারের সামনে। সবার বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে। হাতে ব্যাগ, আছে রাজমিস্ত্রির কাজের কিছু যন্ত্রপাতিও। সেলিম বলেন, পুরো কল্যাণপুর ঘুরে তিন-চারটার বেশি টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সবাই একসঙ্গে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।
এরই মধ্যে রাকিব বলে ওঠেন, ‘চল, সবাই কমলাপুর স্টেশনে যাই। ট্রেনে বাড়ি যাব।’ কিন্তু এতে অন্যরা সায় দেননি। কারণ, ট্রেনের টিকিট পাওয়া আরও কঠিন। এর মধ্যে রাকিব প্রস্তাব করেন মহাখালী বাস টার্মিনালে যাবেন। সেখান থেকে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এই প্রতিবেদক বিকেল পাঁচটার দিকে মহাখালী টার্মিনালে গেলে সেখানেও এই আট যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। টিকিট জোগাড় হয়েছে কি না, জানতে চাইলে শুকনো মুখে সেলিম বলেন, ‘না, তবে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করব।’
কিছুক্ষণ আলাপ করার পর সেলিম জানান, রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও তাঁদের আটজনই কিছুটা পড়ালেখা জানা। পরিবারও একেবারে অসচ্ছল নয়। তাই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো মানসিকতা নেই। অপেক্ষা করে হলেও একটু ভালো আসন নিয়ে যেতে চান। কাজের চাপের কারণে আগে এসে টিকিট কাটতে পারেননি।
আগে থেকে টিকিট না কাটা এমন অনেককেই গাবতলী, কল্যাণপুর ও মহাখালীর বিভিন্ন বাস কোম্পানির কাউন্টারে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। আবার যানজটের আশঙ্কা নিয়ে অনেকে আগেভাগে বাসা থেকে বের হয়ে স্টেশনে এসে বিড়ম্বনায় পড়েন, বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
বিকেল চারটার দিকে গাবতলী টার্মিনালের উল্টো দিকে হানিফ পরিবহনের নিজস্ব টার্মিনালে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহিদুল ইসলাম। যাবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে বেলা একটায় রওনা দিয়ে গাবতলী পৌঁছে যান সাড়ে তিনটায়। কিন্তু তাঁর বাস ছাড়ার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। তাই পত্রিকা পড়ে সময় কাটাচ্ছেন। মুহিত বলেন, অন্যবার যানজটের কারণে সময়মতো টার্মিনালে পৌঁছাতে পারেননি। এ জন্যই আগেভাগে রওনা দিয়েছিলেন। মাহিদুল অভিযোগ করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে যাওয়ার জন্য তাঁকে ৮৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এই পথে ভাড়া ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
মাছ ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী আকন্দ ও পোশাক কারখানার কর্মী রাজিয়া বেগম গাবতলী টার্মিনালে বসা দুপুর থেকে। তাঁরা জানান, দুই ছেলেকে বরগুনার বাসে তুলে দিতে এসেছেন। অগ্রিম টিকিট ছিল না। টার্মিনালে এসে সোনার তরী পরিবহনের রাত সাড়ে আটটার বাসে টিকিট পেয়েছেন। প্রতিটির দাম ৬০০ টাকা। অন্য সময় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় যাওয়া যেত। ইয়াকুব আলী ও রাজিয়া বলেন, তাঁরা সাভারের ফুলবাড়িয়ায় থাকেন। ছেলেদের বাসে তুলে দিয়েই বাসায় ফিরবেন।
কল্যাণপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার থেকে বিকেল সোয়া তিনটায় দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাসে রংপুরের গাড়িতে চড়েন ফরিদুল হক। তিনি বলেন, অনেক শঙ্কা ছিল যানজটের। কিন্তু কাউন্টারে এসে জানতে পারেন সময়মতোই বাস ছেড়ে যাবে। রাত ১০টার দিকে মুঠোফোনে ফরিদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ততক্ষণে বাড়িতে পৌঁছে গেছেন। যাত্রাটি আনন্দেরই ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফেরিতে জট: প্রথম আলোর মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার রাত ও ভোরে ছেড়ে যাওয়া দক্ষিণবঙ্গের বাসের অনেকগুলোই মাওয়া ফেরিঘাটে আটকা পড়ে।

>>প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করতে রাজধানী ছাড়ছে মানুষ। গতকাল সকাল থেকে ঘরমুখী মানুষের স্রোত দেখা গেছে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে। লঞ্চে করে মানুষের রাজধানী ছেড়ে যাওয়ার এই দৃশ্য পোস্তগোলা ব্রিজের ওপর থেকে তোলা l ছবি: সাজিদ হোসেন
মাওয়া ঘাট সূত্রে জানা যায়, মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে উজানের তীব্র স্রোত ও ঘাট এলাকার উল্টো পানির স্রোতের কারণে কয়েক দিন ধরেই ফেরি চলাচল কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে শুক্রবার সকালে ব্যক্তিগত গাড়িসহ যাত্রীবাহী বাসের চাপ বেড়ে গেলে জট লেগে যায় ঘাটে। অবশ্য বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জট কমতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে আবারও যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়।
মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে লঞ্চেও যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। অনেক লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিতে দেখা যায়। এ পথের লঞ্চগুলোর ধারণক্ষমতা ৮৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৯৮ হলেও ২০০-৩০০ পর্যন্ত যাত্রী বহন করে। সিবোটে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘাটে পিরোজপুরের সোলেমান দেওয়ান বলেন, সরাসরি যাওয়ার বাসের টিকিট না পেয়ে ভেঙে ভেঙে মাওয়ায় এসেছেন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের মাওয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক সিরাজুল হক বলেন, সোমবার আরও ভিড় বাড়তে পারে। এটা সামাল দেওয়ার জন্য তাঁদের প্রস্তুতি আছে।
লঞ্চযাত্রীদের ভিড়: দক্ষিণের জেলাগুলোর মানুষ রাতের লঞ্চে ওঠার জন্য গতকাল সকাল থেকেই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে জড়ো হতে শুরু করে। সেখানে পটুয়াখালীর আমিন হোসেন বলেন, সকাল ১০টায় এসে ডেকের টিকিট পেয়েছেন। তবে বসার ভালো জায়গা হয়নি। ব্যাংক কর্মকর্তা জালাল মোল্লা ক্ষোভ প্রকাশ করেন টার্মিনাল এলাকায় হকারদের উৎপাতের বিষয়ে। তিনি বলেন, অন্তত ঈদ মৌসুমে টার্মিনাল থেকে হকার উচ্ছেদ করার দরকার ছিল। নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক সাইফুল হক খান বলেন, যাত্রীদের হয়রানি ও লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী এবং মালামাল বহন রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত সদরঘাট টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.