নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দূর হবে কি? by তুহিন ওয়াদুদ

পিএসসি (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) দেশের ক্যাডার, নন-ক্যাডারভিত্তিক প্রথম শ্রেণির এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা, নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিভাগীয় পরীক্ষা, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা সম্পন্ন করে থাকে। এসবের মধ্যে একেকটি বিসিএস পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সময় লাগে দু-তিন বছর। নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে চাহিদাপত্র পাঠায়। অনেক বিসিএসে চাহিদাপত্র পাঠানোর দিন থেকে নিয়োগদান পর্যন্ত তিন বছরের বেশি সময় প্রয়োজন হচ্ছে। পিএসসির একটি বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘২৮তম বিসিএসের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চাহিদা পাঠিয়েছে ১২ আগস্ট ২০০৭, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে ২২ জানুয়ারি ২০০৮।’ নিয়োগের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ ডিসেম্বর ২০১০। নিয়োগ–প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যত দিন প্রয়োজন হয়, তত দিন শূন্য পদগুলোতে কোনো কর্মকর্তা থাকেন না। সরকারের উচিত, পরবর্তী নিয়োগ দেওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যেসব পদ শূন্য হবে, সেই পদে আগাম নিয়োগ–প্রক্রিয়া শুরু করা। এতে করে পদগুলো বেশি দিন শূন্য থাকবে না।
বর্তমানে প্রতিবছর একটি করে বিসিএস নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার কথা। কিন্তু বিসিএসজটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ৩৪তম বিসিএসের পর প্রায় দেড় বছর হলো এখন পর্যন্ত ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। পিএসসির এ উদাসীনতায় অনেক মেধাবীর আবেদন করার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ, এক বছরের কম সময়ে একটি করে বিসিএস নিয়োগ–প্রক্রিয়া অনায়াসে সম্পন্ন করা সম্ভব। পিএসসি বিসিএসের কোন স্তরের পরীক্ষার জন্য ন্যূনতম কত দিন প্রয়োজন হবে, এ বাধ্যবাধকতা নিজেরাই করে নিতে পারেনি বলে অকারণ সময় বেশি প্রয়োজন হয়। যেমন, ২৮তম বিসিএস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রায় ১০ মাস পর, ২৯তম বিসিএস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সাত মাস পর প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যে এক মাস সময় দেওয়া হয় আবেদনের জন্য, সেই সময়ের পর ১৫ দিনের মধ্যেই প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব।
প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশেও বেশি সময় ক্ষেপণ করা হয়। ওএমআর পদ্ধতিতে গ্রহণ করা বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশে দুই-তিন-চার মাস লাগছে। মূলত এ ফল প্রকাশ করতে সাত দিনের বেশি প্রয়োজন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলো তার দৃষ্টান্ত।
প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশের পর লিখিত পরীক্ষা শুরু করতে মধ্যবর্তী সময় নেওয়া হচ্ছে তিন মাস থেকে আট মাস পর্যন্ত। আন্তরিক হলে বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই লিখিত পরীক্ষা শুরু করা সম্ভব। বর্তমানে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মাত্র ১২-১৪ হাজার পরীক্ষার্থীর ফল প্রকাশে প্রায় তিন-চার মাস লেগে যাচ্ছে। এ সময় কমিয়ে আনা সম্ভব।
লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অনেক ক্ষেত্রে এক মাসের বেশি সময় লাগছে মৌখিক পরীক্ষা শুরু করতে। এটাও যৌক্তিক নয়। মৌখিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বোর্ডসংখ্যা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা প্রয়োজন। বর্তমানে পাঁচ-সাত হাজার পরীক্ষার্থীর মৌখিক পরীক্ষা শেষ করতে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস লাগছে। অযৌক্তিকভাবে মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে কমিশন প্রায় ছয় মাস নিচ্ছে। এতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ বেশি থাকে।
পরীক্ষার অংশটুকু ছাড়াও সময় নষ্ট হয়। কখনো কখনো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শূন্য পদে নিয়োগের জন্য যে চাহিদাপত্র পাঠায়, তার পাঁচ-ছয় মাস পর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। আবার চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পরও নিয়োগ পর্যন্ত কয়েক মাস নষ্ট হচ্ছে। ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নিয়োগ পর্যন্ত নয় মাস শেষে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন, স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ চূড়ান্ত ফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে নিয়োগ–প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব।
পিএসসি বছরে অনেক পরীক্ষা সম্পন্ন করে থাকে। যেমন ২০১০ সালে পিএসসি ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৪৯ দিনে ১২৫টি পরীক্ষা গ্রহণ করে। বর্তমানে বছরে পাঁচ-সাত লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে হয় পিএসসিকে। একটি পিএসসি যদি এ কাজ সম্পন্ন করতে না পারে, তাহলে সাংবিধানিকভাবে একাধিক পিএসসি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
শূন্যসংখ্যক পদের তুলনায় সীমিতসংখ্যক প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যেমন বিজ্ঞাপিত পদসংখ্যার আট গুণ প্রার্থীকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা থেকে এবং লিখিত পরীক্ষা থেকে পদসংখ্যার চার গুণ প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা উচিত। এতে করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময়ই কমিশন জানতে পারবে, লিখিত পরীক্ষায় কতজন এবং মৌখিক পরীক্ষায় কতজন অংশ নিচ্ছে। সেটা অনুযায়ী তারা আগাম সব পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সঙ্গে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার তারিখও বলা সম্ভব।
বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষায় অনেকেই উত্তীর্ণ হন। কিন্তু পদ থাকে না বলে এদের মধ্য থেকে মেধার ভিত্তিতে নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে ৫০ শতাংশ প্রার্থীকে পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়। যদি ৫০ শতাংশ না করে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে যতজন পাস করে তাদের থেকে নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে পিএসসিকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ-পরীক্ষার আয়োজন করতে হবে না। বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষা থেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। কারণ, প্রথম শ্রেণির নিয়োগের শর্ত আর দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগের শর্ত সমান নয়। এ সিদ্ধান্তে অনেককেই বঞ্চিত করা হবে। তার চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে, দ্বিতীয় শ্রেণির সব নিয়োগের জন্য একটি মাত্র পরীক্ষা গ্রহণ করা। সেখানে পছন্দক্রম থাকবে। সেই ক্রম অনুযায়ী পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে করে পরীক্ষার সংখ্যাও কমবে, কাউকে বঞ্চিত করা হবে না এবং পিএসসির অনেক সময় সাশ্রয় হবে।
বিসিএসের সব স্তর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর কালক্ষেপণ না করলে নিয়োগ দেওয়া পর্যন্ত সর্বমোট আট-নয় মাস প্রয়োজন। বিসিএসে নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতা দূর করার জন্য পিএসসিকে আন্তরিক হতে হবে। অথবা, সংসদ থেকে একটি কমিটি করে বিসিএস নিয়োগের সময় বিশ্লেষণ করে, সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসিকে একটি নির্দেশনা দিতে পারে। বছরের পর বছর পিএসসি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষায় কালক্ষেপণ করে দেশ ও জাতির ক্ষতি করতেই থাকবে, তা কিছুতেই হতে পারে না।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.