বোঝে না সে বোঝে না by আনিসুল হক

‘পাখি’ নামের পোশাক না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অভিমানী কিশোরী। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে স্বামী-স্ত্রীর। পাখি হলো স্টার জলসার সিরিয়াল বোঝে না সে বোঝে নার এক চরিত্র। এই খবর পড়ে ভাবছি, এবার আমাদেরই আত্মহত্যা করা উচিত কি না। আমরা যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সিরিয়াল লিখি, যারা বিভিন্ন চ্যানেল চালাই, পরিচালনা করি, পরিকল্পনা করি। আত্মহত্যা কথাটা বেশি বাড়াবাড়ি, কিন্তু এবার আমাদের বোধ হয় অবসর নেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। ১-৭ গোলে হারার পর ব্রাজিল ফুটবল দল থেকে যেমন ছুটি পেয়েছেন কোচ স্কলারি, এবার তেমনি করে আমাদের অবসর নেওয়ার পালা। আমরা ১-৭-এর চেয়েও বড় পরাজয়ের মধ্যে অনেক দিন থেকেই দিন গুজরান করছি।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, জরিপ পরিচালনা করেন, তাঁরা বহু আগেই বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শকেরা বাংলাদেশের চ্যানেল খুব কমই দেখেন, তাঁদের পছন্দের তালিকার প্রথম দিকের জায়গা দখল করে রেখেছে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চ্যানেল। আর বহুকাল আগে থেকেই আমরা কতিপয় রোদনকারী গভীর অরণ্যে রোদন করে আসছি যে টেলিভিশন চ্যানেল মানে কেবল টেলিভিশন চ্যানেল নয়, তা নির্ধারণ করে দেয় আমাদের রুচি-গতি-প্রকৃতি। আমাদের মনোজগতে তা গড়ে তোলে উপনিবেশ। ঠিক করে দিতে পারে আমরা কী পরব, আমরা কী খাব। বদলে দিতে পারে আমাদের সংস্কৃতির চিহ্নগুলো।
আর সংস্কৃতির চিহ্ন হারানোর ফলটা কেবল সংস্কৃতির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, তা প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে। আমরা বিদেশে প্রস্তুত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দেশি শিল্প, দেশি বাণিজ্য তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে সংস্কৃতি থেকে অর্থনীতি, আর অর্থনীতি থেকে রাজনৈতিকভাবে আমরা পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়ি। তো গভীর অরণ্যে রোদন করলে তা কে-ই বা শুনবে?
আমরা আরও উদার হচ্ছি। দরজা-জানালা সব খুলে দিচ্ছি বিদেশি টিভি চ্যানেলের জন্য। নিজেদের উন্নত করার, নিজেদের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী করার চেষ্টা করছি না। কিংবা প্রতিযোগিতা করে সফল হওয়ার কোনো যোগ্যতাই আমাদের নেই। আমরা পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছি। নইলে একসময় যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশ টেলিভিশনে হ্ুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখার জন্য টিভি অ্যান্টেনার সঙ্গে ঘটি-বাটি লাগাত, আমরা এখন তাদের তৈরি সিরিয়াল দেখার জন্য ঘটি-বাটি বিক্রি করতে প্রস্তুত আছি। তাও তো সামান্য, সেসব সিরিয়ালের চরিত্রের নামের পোশাকের জন্য প্রস্তুত আছি নিজের জীবন কিংবা দাম্পত্য জীবন বিসর্জন দিতে।
আমি দর্শকদের দোষ দেব না। যদিও স্বীকার করব যে এই দোষ আমাদের একটু আছে যে বিদেশি জিনিস দেখলেই আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আমরা মনে করি, দেশি জিনিস কখনো শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। বহুদিন আগে কার লেখায় যেন পড়েছিলাম, এই দেশে যা কিছু বৃহৎ, যা কিছু উন্নত, তার গায়ে আমরা বিদেশি তকমা লাগিয়ে দিতে পছন্দ করি। মরিচ বাংলাদেশের মাটিতে উৎপাদিত হতে পারে, কিন্তু তাতে যদি ঝাল বেশি থাকে, তাহলে তা বোম্বাইয়া মরিচ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দর্শকেরা যে ভারতীয় চ্যানেলগুলো দেখার জন্য একে একে চলে গেল, তার দায় নির্মাতা ও কর্তৃপক্ষেরই। আমরা ভালো জিনিস দিতে পারিনি। আমরা আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভরে তুলেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, যা ইচ্ছে তাই দিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনের বাহুল্যে অনুষ্ঠান দেখাটা একটা ভয়াবহ যন্ত্রণায় পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের গোটা কুড়ি চ্যানেলে আগামী ঈদে অন্তত সাত দিন ধরে অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে, প্রতিদিন দুটো করে নাটক হলেও প্রতিটা চ্যানেলে হবে ১৪টা নাটক এবং কুড়িটা চ্যানেলে নাটক ২৮০টা। ২৮০টা নাটক রচনা, পরিচালনা, ধারণ, পরিবেশন করার মতো নাট্যকার, শিল্পী, কলাকুশলী এই দেশে আছে বলে আমার মনে হয় না।
তবু একটা সান্ত্বনা আছে। আগে ছিল মাশাককালি বা দেবদাস শাড়ি, হিন্দি থেকে জিনিসটা এখন বাংলায় এসেছে। সফলভাবে সুন্দর অনুষ্ঠান দিতে পারলে তা বাংলাদেশেও আসতে পারে।
২.
এখন বোঝে না সে বোঝে না-রই জয়জয়কার। একেবারেই যে বোঝে না তাও নয়। এইবার বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় সরাসরি খেলা দেখার জন্য আমার এলাকায় অন্তত ভারতীয় চ্যানেল খুঁজে পেলাম না। শুনলাম, একটা চ্যানেলে বাংলায় ধারাভাষ্য হচ্ছে। আরেকটা চ্যানেলে খেলার আগে এবং খেলার ফাঁকে বেশ একটা আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। সেটা দেখার জন্যই, কিংবা কৌতূহলবশত রিমোট হাতে চ্যানেল সার্ফ করে ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হলো, ভারতীয় চ্যানেলের খেলা আমাদের এলাকায় দেখানো হচ্ছে না। পরে প্রথম আলোর বিনোদন পাতাতেই খবর পেলাম, সরকার ওই দুটো ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে দেখানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কেন করেছে? আমরা যদি জিটিভি, সনি টিভি, স্টার টিভির সিরিয়ালগুলো দেখতে পারি, খেলা দেখলে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হতো? হিসাব খুবই সহজ। বিটিভি খেলা দেখাচ্ছে, মাছরাঙা আর গাজী টিভি খেলা দেখাচ্ছে, তা থাকতে আবার বিদেশি চ্যানেল কেন? নিজেদের চ্যানেল দেখুন। বিজ্ঞাপনদাতারা তাহলে নিজেদের চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেবেন। তাহলে ওই চ্যানেলগুলোর বিনিয়োগটা উশুল হবে। না হলে তারা লোকসানের মুখে পড়বে।
এই সহজ হিসাবটা যদি বিশ্বকাপের সময় বোধগম্য হয়, তা অন্য সময় কেন দুর্বোধ্য বলে মনে হয়? কেন আমাদের চুল ছিঁড়তে হয়, বোঝে না সে বোঝে না? বলেছি তো। সবাই সবকিছু বোঝে।
অত্যন্ত গুরুতর একটা খবর। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ২৩ জুলাই ২০১৪ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধের জন্য আইন সংস্কার করা হচ্ছে। এরশাদ সাহেবের পতনের পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ যখন ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি হন, তখনই তিনি একটা দারুণ কাজ করে গেছেন, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার কালো আইনটা রদ করে গেছেন। যে খবর ছাপা হয়নি, সে খবরের জন্য সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা যাবে না। মানে, আগামীকাল আমি কী ছাপাব, তা ভেবে আপনি আমার আগামীকালের কাগজ বন্ধ করতে পারবেন না, মানে কোনো কাগজ আসলে নিষিদ্ধই করা যাবে না। তবে প্রকাশিত যেকোনো লেখার জন্য সব দেশে সব সমাজেই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের প্রতিবিধান পাওয়ার অধিকার আছে, সেটা আমাদের দেশেও আছে। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবেই নিরঙ্কুশ নয়, আমরা এখানে আইন দ্বারা নির্ধারিত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা উপভোগ করছি।
স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র কোথাও থেকে থাকে, তা আছে বাকস্বাধীনতায়, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায়। বিভিন্ন পক্ষ, সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক, রাজনৈতিক—নানাভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় অস্বস্তি বোধ করেছে, অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং অসংগত আচরণও করেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রাখার চেষ্টা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকেনি। সে জন্য আবার সরকার ও বিরোধী দল, এই দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ সাধুবাদ পাওয়ারও যোগ্য। একই সঙ্গে বহু সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন, এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, বেশ কিছু সাংবাদিক নিহতও হয়েছেন। এরই মধ্য দিয়ে আমাদের সংবাদমাধ্যম বিকশিত হয়ে চলেছে। সেটা সইছে না কর্তৃপক্ষের। তারা এখন অছিলা খুঁজছে সংবাদমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সহজ অস্ত্র আবিষ্কারের ও প্রচলনের। একপক্ষীয় নির্বাচন হয়ে গেছে। নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধী জোটের কণ্ঠস্বর মিইয়ে এসেছে। এখন সংবাদমাধ্যমকে খামোশ করে দিতে পারলেই তো ষোলোকলা পূর্ণ হয়! এই সুযোগ ক্ষমতাবানেরা কেন ছাড়বেন?
আর আপনারা কি সমাজকল্যাণমন্ত্রীর কল্যাণী কণ্ঠের অমৃত গর্জন শুনেছেন? টেলিভিশনের খবরে খানিকটা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ‘আপনাদের জন্য এমন আইন করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আপনাদের স্বাধীনতাই থাকবে না।’ নারায়ণগঞ্জের খুনের ঘটনা বারবার দেখানোয় বিরক্ত সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী সচিবালয়ে ২২ জুলাই এই ধমক দেন। তাঁর এই অগ্নি-উদ্গার আপনারা হয়তো ইউটিউবে দেখতে পাবেন। দেখলে আঁচ পাবেন। তাপ, জ্বালা সব আছে, শুধু সংস্কৃতির বোধটা নেই। গণতান্ত্রিক পরিশীলনটা নেই। এঁরাই করছেন আমাদের সমাজের কল্যাণ। বোঝে না সে বোঝে না-রই তো জয়জয়কার দেখতে পাচ্ছি।
তবু এ কথা বুঝতে হবে যে দেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। ১৯৪৮ সাল থেকেই তরুণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এই দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য, বাকস্বাধীনতার জন্য, এই দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য লড়াই করে আসছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা না করে নিজেদের আচার-আচরণ, কথাবার্তায় আরেকটু দায়িত্ববোধের পরিচয় দিন। সাত খুন ঘটলে তা গোপন করার চেষ্টা না করে আর যেন একটা খুনের ঘটনাও না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হোন। আর তা করতে হলে প্রকৃত অপরাধী আর তার নেপথ্যের গডফাদারদের ধরতে হবে, আইনানুগ সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়-আশকারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে এই দেশে অরণ্যের অন্ধকার নেমে আসবে। আমেরিকানরা সংবাদমাধ্যমের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছে। তারা বিশ্বাস করে তাদের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে। তাতে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো আইন কংগ্রেস পাস করবে না। তাতে তারা পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি হতে পেরেছে, এই স্বাধীনতা দেওয়ার ফলে সরকারের পরিবর্তনও ঘটেছে, কিন্তু তারা কখনো এই স্বাধীনতার বিষয়ে আক্ষেপ করে না।
আমেরিকানরা যা ১৭৭৬-১৭৯১ সালে বুঝতে পেরেছে এবং কার্যকর করেছে, আমাদের দেশে ২০১৪-তেও বোঝে না সে বোঝে না। হায়, তিনি আমাদেরই মন্ত্রী, যিনি বলেন, আপনাদের জন্য এমন আইন করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আপনাদের স্বাধীনতাই থাকবে না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.