প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফরের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বিশ্বজুড়ে অশান্তির আগুন সামলাতে পাশ্চাত্যের কথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকেরা যখন হিমশিম খাচ্ছেন, তখনই যে তাঁদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়—এটুকু শিক্ষা দীর্ঘ কূটনৈতিক জীবনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর যে হয়েছে তার একটা নমুনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রিটেন সফর। কূটনীতিকেরা সাধারণত কম কথা বলেন এবং এমনভাবে কথা বলেন, যা নানাজনের নানাভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক সম্পর্কে মাহমুদ আলী লন্ডন থেকে টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন যে ব্রিটেন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে চায়। তিনি বলেছেন যে নির্বাচন শেষ হয়েছে,
এটা অতীত। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই। আগামী দিনে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই, ২০১৪)। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস সূত্রে জানা যায়, ওই একই বৈঠক সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী লন্ডনে সাংবাদিকদের বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন অর্থনীতি এবং নারীর অধিকার ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছেন এবং এই অগ্রগতি দেখার জন্য দেশটি ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ মৌলবাদের সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করছে, তা দেখতেও ক্যামেরন আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাসসের ওই খবরে আরও বলা হয় যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের মধ্যে ওই বৈঠকে উপস্থিত কার সূত্রে এই অভিনন্দনের কথা জানা গেল, বাসস তা জানায়নি। এত বড় একটা তথ্য জানাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব দুজনেই কী করে ভুলে গেলেন, তা রীতিমতো বিস্ময়ের বিষয়। আবার বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা মোকাবিলায় ক্যামেরনের কথিত আগ্রহ এবং তা দেখতে আসার বাসনা প্রকাশের গুরুত্বই বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে উপেক্ষা করলেন, তা বোধগম্য নয়।
ব্রিটেনের বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার অন্যতম প্রধান গন্তব্য যে দেশটি, সেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন আলোচনা করলেন, তার কিছুই তাঁর দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের সরকারি ভাষ্যই ভরসা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিবের বয়ান এবং বাসসের খবরের মধ্যে ফারাকগুলো চোখে পড়ার মতো। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করার আগে অবশ্য যে কথাটুকু বলে নেওয়া দরকার তা হলো, আলোচনা যা-ই হোক, ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে বর্তমান সরকারের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, তার পটভূমিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটিই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের একটা বড় সাফল্য। গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে বিবেচিত ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টের বিশেষ বিতর্কে দল–মতনির্বিশেষে যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে সমালোচিত হয়েছে, সেই পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহিকারী ক্যামেরন সেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধানমন্ত্রীকে যে স্বাগত জানিয়েছেন, সেটাই তো এক বড় বিস্ময়। সফরটি যেহেতু দ্বিপক্ষীয় নয় এবং তার উপলক্ষও আলাদা, সেহেতু এই বৈঠক না–ও হতে পারত। সে রকমটি হলে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য তা একটা বড় প্রচারণার বিষয় হয়ে উঠত। বিশেষ করে গার্ল সামিটে স্বাগতিক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া একমাত্র সরকারপ্রধান যিনি অংশ নিয়েছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সামিটের মূল বিবেচ্য বিষয় দুটির একটি মেয়েদের খতনার কোনো চল বাংলাদেশে আছে বলে শোনা যায় না, আর অপরটি মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের সমস্যাও আগের মতো প্রকট নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী নিজে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভায় বলেছেন, বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে সন্তুষ্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তাঁর কথিত ‘নির্বাচনী সাফল্য’কে অভিনন্দিত করার কোনো কথা তিনি বলেননি। এই সফরের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল কয়েকজন ব্রিটিশ এমপির তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়াও আওয়ামী লীগের সভায় ডজন খানেক ব্রিটিশ এমপি ও এমইপির (ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য) উপস্থিতি। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, কথিত ভারতীয় খাবারের (ইন্ডিয়ান কারি) আকর্ষণ ক্ষমতার প্রভাবেই এটি সম্ভব হয়েছে (ব্রিটিশ রাজনীতিকেরা, যাকে বাংলাদেশিদের কারি পাওয়ার বলে অভিহিত করে থাকেন)। ওয়েস্টমিনস্টার পাড়ায় অতীব সমাদৃত এক বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলেও শোনা যায়। তবে বাংলাদেশের বিভাজনের রাজনীতিতে বিদ্যমান তিক্ততা সম্পর্কে সচেতন ব্রিটিশ এমপিদের মধ্যে যাঁদের এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি ভোটার রয়েছে, তাঁরা অনেকেই অবশ্য দূরত্বটা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এঁদের অনেকেই অতীতে তাঁদের দলে টানার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি প্রকাশ্যে বিরক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বর্ণনা যেমন বাহুল্যবর্জিত, তেমনি প্রত্যাশিত। তাতে কোনো চমক নেই, যেটা বাসসের খবরে আছে। যেকোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পর যদি ভবিষ্যতে সম্পর্ক নিবিড় করার আগ্রহটুকু প্রকাশিত না হয়, তাহলে সেই সম্পর্ক যে স্বাভাবিক নয়, সেটা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। একই সঙ্গে কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোর মানে দাঁড়ায় সম্পর্কচ্ছেদ বা বয়কট। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ব্রিটেন কোনো দিন সে রকম কোনো ঘোষণাও দেয়নি। সুতরাং বৈঠকটি সম্পর্কে গতানুগতিক ভাষ্যই স্বাভাবিক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর ভাষ্য অনুযায়ী, ক্যামেরন বলেছেন যে নির্বাচন শেষ হয়েছে, এটা অতীত। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই। বৈঠকের সূত্র বলছে, এই কথাগুলো বলার আগে মি. ক্যামেরন বলেছেন যে ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের অবস্থানগত ভিন্নতা থাকলেও সেটা এখন অতীত।’ তাঁর বক্তব্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মূল্যায়নে কোনো পরিবর্তনের কথা ছিল না। নির্বাচনকে সংবিধানসম্মত স্বীকার করলেও অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকা এবং ভোটার উপস্থিতির দৈন্য যে জনমতের প্রতিফলন নয়, তাঁরা শুরু থেকে সে কথাটাই বলে এসেছেন।
একইভাবে ভবিষ্যতে ব্রিটেন যে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে, সে কথা ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার এবং সদ্য সাবেক হওয়া প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকানও একাধিকবার জানিয়েছেন। সুতরাং, ক্যামেরনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই বৈঠককে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সার্টিফিকেট হিসেবে প্রচার অথবা তা নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা হবে একেবারেই অর্থহীন। ডাউনিং স্ট্রিটে যেদিন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, সেই একই দিনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর বিশ্বে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঝুঁকি মূল্যায়নের নতুন ভাষ্য প্রকাশ করেছে, যাতে বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে বিএনপি বয়কট করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন মহাজোট অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। ২০১১ সালের জুনে একটি বিতর্কিত সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি বাতিলের কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, বয়কটের ফলে জাতীয় পার্টি এখন সরকারিভাবে স্বীকৃত বিরোধী দল, যদিও তারা মন্ত্রিত্ব গ্রহণসহ সরকারে অংশ নিয়ে একটি অতুলনীয় অবস্থানে রয়েছে। এই বিবরণীতে দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির দৈন্যদশা, আইনের শাসনের সংকট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দুর্নীতির যে সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হয়েছে তা যে দেশের জন্য মোটেও মর্যাদাকর নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অভ্যন্তরীণ যেকোনো বিষয়—তা সে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারী অধিকার কিংবা নির্বাচন—এগুলোতে বিদেশিদের প্রত্যয়ন বা সার্টিফিকেশনের বিপদটা আমাদের রাজনীতিকেরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, তাঁদের জন্য সেটা ততটাই ভালো। কেননা, তাহলে তাঁদের বিড়ম্বনাও কিছুটা কমবে। পুনশ্চ, ডাউনিং স্ট্রিটে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সময় বাইরে বিরোধী দল বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিবাদ একটা স্বীকৃত অধিকার। সুতরাং, সেই প্রশ্নে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে ইউটিউবে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে দেখা যায় যে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর সেখান থেকে বেরোনোর সময় এঁদের মধ্য থেকে কয়েকজন ঢিল ছুড়ছেন। এই আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের লাঠিয়ালনির্ভর রাজনীতি আমদানির যেকোনো উদ্যোগ নিন্দনীয়, তার লক্ষ্য যিনিই হোন না কেন।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷

No comments

Powered by Blogger.