ঈদে জমজমাট চাঁদার বাজার

ঈদকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শিল্পপতি সবাইকে দেয়া হচ্ছে হুমকি। হয় চাঁদা, নইলে মৃত্যু। কারও কারও কছে কাফনের কাপড়ও পাঠানো হচ্ছে। মেরে মেলার হুমকি দেয়া হচ্ছে স্ত্রী-সন্তানদের। এমন হুমকিতে কেউ কেউ গোপন সমঝোতায় সন্ত্রাসীদের হাতে নগদ অর্থ তুলেও দিচ্ছেন। পিছিয়ে নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। ঈদকে কেন্দ্র করে থানা পুলিশের সদস্যরাও মরিয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজিতে। মিরপুরে চাঁদার দাবিতে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে খোদ মিরপুর থানা পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টর। মহাসড়কেও চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। হাইওয়ে পুলিশ আর ট্রাফিক পুলিশের যৌথ চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পরিবহন ব্যবসায়ীরা। আর চাঁদাবাজিতে একধাপ এগিয়ে রাজনৈতিক ক্যাডাররা। দলীয় নেতাকর্মীদের নাম ভাঙ্গিয়ে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। ফুটপাত থেকে শুরু করে মার্কেট, বিপণি বিতান, শপিং মল সব জায়গা থেকেই চাঁদা আদায় করছে তারা। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীলা সবচাইতে বেশি এগিয়ে। এদিকে র‌্যাব-পুলিশের কাছেও আসছে একের পর এক অভিযোগ। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ঈদের আগে চাঁদাবাজি ঠেকাতে বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। র‌্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও করছেন সতর্ক নজরদারি। তবুও চাঁদাবাজি থামছে না। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে চাঁদাবাজের তৎপরতা তত বেড়েই চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, চাঁদাবাজি ঠেকাতে পুলিশ সবসময় কঠোর অবস্থানে থাকে। এবারও ঈদ কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি ঠেকাতে পুলিশ সদস্যরা তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, কোন পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ঈদ এলেই চাঁদাবাজির মাত্রা বেড়ে যায়। মূলত বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের নামে আদায় করা হয় চাঁদা। প্রথমে টার্গেটকৃত ব্যক্তির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা। পরে ওই ব্যক্তির স্ত্রী-সন্তানেরা কোথায় যাতায়াত করে বা কে কোন স্কুলে পড়ে সেই তথ্য সংগ্রহ করে। পরে ফোন দেয়া হয় টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে। বলা হয়, চাঁদা না দিলে স্ত্রী-সন্তানদের গুলি করা হবে। ভয়ে অনেকেই গোপনে সন্ত্রাসীদের হাতে চাঁদার টাকা তুলে দেন। যে যেভাবে পারেন সমঝোতা করে পরিমাণটা কমিয়ে নেন। সূত্র জানায়, চাঁদাবাজের তালিকায় বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি কারাবন্দি  সন্ত্রাসীরাও রয়েছে। তাদের নাম ব্যবহার করে চাঁদা আদায় করে সহযোগীরা। এলাকা ভাগ করে আদায় করা হয় চাঁদা। বৃহত্তর মিরপুরে চাঁদা আদায় করা হয় কলকাতায় পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের নামে। মোহাম্মদপুর এলাকায় নবীর হোসেনের নামে। কাওরান বাজার এলাকায় আশিক, রমনা-মগবাজার-মালিবাগ এলাকায় সুব্রত বাইন ও জিসানের নামে আদায় করা হয় চাঁদা। পুরান ঢাকার এক সময়ের ত্রাস ডাকাত শহীদ বন্দুক যুদ্ধে নিহত হলেও তার সহযোগীরা এখনও চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা আদায়ের সময় এখনও তারা ডাকাত শহীদের লোকজন বলে ভয় দেখায়। বলে, ভাই মরেছে আমরা কিন্তু মরি নাই। চাঁদা দিতে হবে না হলে গুলি খেতে হবে। সম্প্রতি নাবিল আহমেদ চৌধুরী নামে ধানমন্ডির ৯/এ সড়কের এক বাসিন্দার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নামে তাকে ফোন করা হয়। বলা হয়, সারা বছর কোন দাবি করি নাই। ঈদ আসছে ছেলেপেলেদের টাকা পয়সা লাগবে। ৫০ লাখ টাকা দিয়েন। না দিলে বাসার সামনে প্রথমে ককটেল ফাটানো বা গুলি করা হবে। না হলে আপনার স্ত্রী-সন্তানের সব তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। তাদের ওপর হামলা করা হবে। ওই ব্যবসায়ী ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনুসন্ধান করে জানতে পারেন কলটি এসেছে দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে। কাওরান বাজার এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোফাজ্জলের কাছে আশিকের নামে দাবি করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। টাকা না দিলে তাকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। তেজগাঁও থানায় জিডি করেছেন ওই ব্যবসায়ী। বিষয়টি পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ২-এর একটি দলও অনুসন্ধান করছে। চলতি মাসের শুরুতে মোহাম্মদপুরের দুই ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ ও আলমগীরের কাছে নবীর হোসেনের নামে পাঁচ লাখ ও দুই লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হয়েছে।
পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অনেক ছিঁচকে সন্ত্রাসীও এখন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করছে। মোবাইল কললিস্টের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় মাদারীপুরের লুন্দি গ্রামের ‘হ্যালো পার্টি’ এর সঙ্গে জড়িত। বেশির ভাগই আবার রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোবাইল দিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়। এ কারণে সন্ত্রাসীদের ধরতেও বেগ পেতে হয়। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে কিছু চাঁদাবাজির অভিযোগ এসেছে। এগুলো অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করছে। র‌্যাব ২-এর অপারেশন অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান জানান, চাঁদাবাজির কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির মহোৎসবে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে। সূত্র জানায়, রাজধানীসহ এর আশপাশের এলাকার থানায় এখন প্রতিদিনই সাধারণ মানুষকে ধরে এনে হয়রানি করা হচ্ছে। ভয় দেখানো হয় পেন্ডিং মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দফারফা করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ ব্যবসা বা কার্যকলাপের সঙ্গে যারা যুক্ত তারাই এখন প্রধান টার্গেট পুলিশের। এছাড়া পরিবহন ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ও মালিকরা জানিয়েছেন, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ কারণে-অকারণে গাড়ি আটক করছেন। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ‘ঈদ বকশিশ’ দাবি করা হচ্ছে। চাহিদামতো টাকা না দিলেই রেকারিং করাসহ বিভিন্ন মামলা দেয়ার ভয় দেখানো হয়। মহাসড়কগুলোতে দায়িত্বরত ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ আরও এক ধাপ এগিয়ে। ঈদ উপলক্ষে তাদের চাহিদার পরিমাণও বেশি। একাধিক পরিবহন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রত্যেক ঈদেই এই চিত্র দেখা যায়। পুলিশ বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বা অভিযোগ করেও কোন সুফল পাওয়া যায় না।
সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী ও পুলিশের পাশাপাশি ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে রাজনৈতিক ক্যাডাররা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার নামে চাঁদা তোলে তারা। পরে ভাগবাটোয়ারা করে নেয় সবাই। রাজধানীর ২২৭/১ মিরহাজীরবাগের বাসিন্দা ফারুকুল ইসলাম জানান, গত তিন-চার মাস ধরেই স্থানীয় যুবলীগ নামধারী কয়েকজন ক্যাডার তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল। তিনি মতিঝিলের মদিনা টাওয়ার লিমিটেডে এজিএম হিসেবে কর্মরত আছেন। তার দুই ভাই ইউরোপ প্রবাসী। নিজেদের বাসা ভাড়া দিয়ে প্রচুর টাকা আয় হয় প্রতি মাসে। এসব কারণেই চাঁদাবাজদের নজরে পড়েন তিনি। ফারুকুল ইসলাম চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে গত ২রা জুলাই সকালে অফিসে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা তার মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। মীরহাজীরবাগের কাওসার মিয়ার গ্যারেজের পাশে এই ঘটনা ঘটে।  এ সময় ওই এলাকার দিলু কাজীর ছেলে কাজী শরীফ (২০) ও একই এলাকার রানা (২২) সহ ৭-৮ জন সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে ঘেরাও করে। সন্ত্রাসীরা দাবিকৃত চাঁদা চেয়ে বলে, বড় ভাইয়ের নির্দেশ আছে চাঁদা না দিলে তোকে মেরে ফেলবো। সন্ত্রাসীরা ফারুকুল ইসলামকে তখন বেদম প্রহার করে। তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে শফিক নামে ওই এলাকার একজন বাসিন্দাও আহত হন। এ ঘটনায় ফারুকুল ইসলাম বাদী হয়ে শরীফ ও রানাকে এজাহারনামীয় এবং ৪-৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে গত ৫ই জুলাই যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা  করেছেন। মামলা দায়েরের পর তিনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন বলে জানান ফারুকুল ইসলাম। আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করলেও সরকারি দলের সন্ত্রাসী হওয়ায় পুলিশ তাদের আটক করছে না বলে তার অভিযোগ। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সচেষ্ট। যে কোন সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
গত ৭ই জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিনবপন্থায় চাঁদাবাজি করার সময় মিঠু নামে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। ওই দিন সকাল সাড়ে ৮টায় উত্তর যাত্রাবাড়ীর সুতিরখালপাড় হয়ে গোলাপবাগ যাওয়ার সময় চার যুবক আলমগীর নামে এক ব্যবসায়ীকে মারধর করে টাকা ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। আলমগীর জানান, এক যুবক তার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বলে, টাকা না দিলে তোকে মেরে ফেলব। এ সময় আত্মীয়-স্বজন যে কাউকে টাকা নিয়ে যেতে বলার জন্য তার মোবাইল ফোন হাতে দেয় দুর্বৃত্তরা। আলমগীর ফোনে কথা বলেন তার আত্মীয় মেহেদি হাসানের সঙ্গে। আলমগীর কৌশলে মেহেদিকে ওই ঠিকানা জানিয়ে বলেন, ঝামেলায় আছি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে হবে। পরে মেহেদী বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ওই দিন যাত্রাবাড়ী থানার সুতিরখাল এলাকার শওকতের ছেলে মুহাম্মদ আলী (২৭), একই এলাকার লিটন, রাব্বিকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন আলমগীর। এই মামলায় গত ৯ই জুলাই সুতিরখালের মুহাম্মদ সিদ্দিকের ছেলে মিঠুকে আটক করেছে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.