অভিনব জালিয়াতি, প্রতারণা by মনজুর আহমেদ

রীতিমতো প্রতারণা ও জালিয়াতি করে অভিনব উপায়ে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে বেসিক ব্যাংক। সব ধরনের ব্যাংকিং রীতিনীতির বাইরে গিয়ে পর্ষদ বৈঠক ছাড়াই ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং ইতিহাসে এমনটি আর কখনো শোনা যায়নি।
এই অভিনব প্রতারণাও করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ করা পর্যবেক্ষকের সামনেই। তিনি উপস্থিত ছিলেন গত ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পর্ষদের ৩২৯তম সভায়। এই সভার কার্যতালিকায় ছিল ৩০৮টি বিষয়। সভার পর দীর্ঘদিন পার হলেও এর কার্যবিবরণী দেওয়া হয়নি পর্যবেক্ষক অশোক কুমার দেকে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে তিনবার টেলিফোন করার পর অবশেষে কার্যবিবরণী পান তিনি। আর তা পেয়েই অভিনব প্রতারণা দেখতে পান কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষক।
সভার কার্যতালিকায় ৩০৮টি বিষয় থাকলেও অনুমোদিত কার্যবিবরণীতে দেখানো হয়েছে ৪১৪টি। অর্থাৎ পর্ষদ বৈঠকে প্রস্তাব উত্থাপন না করেই ১০৬টি ঋণ অনুমোদন করা হয়। এই ১০৬টি অননুমোদিত ঋণে টাকার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৫৪ কোটি।
পর্যবেক্ষক বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক অশোক কুমার দে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিস্তারিত জানিয়ে চিঠি দিয়ে বলেছেন, ‘এ ধরনের কার্যক্রম ব্যাংকিং রীতিনীতির চরম লঙ্ঘন এবং প্রতারণা ও জালিয়াতির শামিল।’ এ ছাড়া, মহাব্যবস্থাপক থেকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দুজনের পদোন্নতির বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বিকৃত করারও অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষক। এই দুই ঘটনার বিষয়ে চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘গুরুতর এ অনিয়মের জন্য পর্ষদের চেয়ারম্যান ও বিশেষভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়ী।’ এ নিয়ে পর্ষদের পরের সভায় আপত্তিও তোলেন অশোক কুমার দে। তখন পর্ষদের সব সদস্যই এর জন্য এমডিকে দায়ী করে ব্যাখ্যা তলবের সিদ্ধান্ত নেন।
বেসিক ব্যাংকের সেই এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি সে সময় চেয়ারম্যানের সঙ্গে এসব অনুমোদনের বিষয়ে কথা বললে তিনি (চেয়ারম্যান) টেলিফোনে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এগুলোর অনুমোদনের জন্য আমাকে বলেছিলেন।’
বেসিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের সে সময়ের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বাসায় তৈরি হতো পর্ষদ সভার কার্যতালিকা। সব ধরনের লেনদেনও তখনই হতো। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এভাবে ব্যাংক পরিচালনার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
বেসিক ব্যাংক নিয়ে প্রায় তিন বছর ধরেই গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকও একাধিকবার চিঠি লিখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। আর এর মধ্যেই ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ঘটেছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও প্রতারণা।
ব্যাংকটিতে নিয়মিত পর্ষদ বৈঠকও হতো না। দুই দিন পর বৈঠক হলেও সেখানে কার্যতালিকায় রাখা হতো ৩০০-এর বেশি ঋণপ্রস্তাব। কম সময়ের মধ্যে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সভায় বিপুল পরিমাণ অর্থের ঋণপ্রস্তাবের অনুমোদন দেওয়া হতো। অশোক কুমার দে এ নিয়ে চিঠিতে লিখেছেন, ‘পর্ষদের সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ব্যাংকের ভালো গ্রাহকবৃন্দ হয়রানি ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং ঋণ ও অগ্রিম কার্যক্রমসহ ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ডে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব তথ্য গত সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা ও গুলশান শাখার ওপর নতুন করে অধিকতর পরিদর্শনের প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছে। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, সরকারঘনিষ্ঠ আবদুল হাইকে পদত্যাগের সুযোগ দিয়ে ‘সম্মানজনকভাবে’ বিদায় দিয়েছে। অথচ তাঁর সময়েই জালিয়াতি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে ঋণ ও নথি জালিয়াতি হয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি, পরিচালনা পর্ষদের কার্যতালিকা ও কার্যবিবরণী জালিয়াতি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের জঘন্য জালিয়াতি ফৌজদারি অপরাধের শামিল। এর দায়িত্ব প্রধানত ব্যাংকের চেয়ারম্যানের। আর এমডিও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাঁদের যোগসাজশে এগুলো হয়েছে বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিশ্চয় এমনই বিবেচনা করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে ১৬ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণের গুরুতর অনিয়ম উদ্ঘাটন করেছে। এর মধ্যে রিলায়েন্স শিপিং লাইনসের স্বত্বাধিকারী জনৈক আসিফ ইকবাল ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলেন। যার শনাক্তকারী ছিল নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামের এক প্রতিষ্ঠান। শনাক্তকারী এই প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্বহীন ও হিসাব পরিচালনাকারী ভুয়া।
কিন্তু বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০১২ সালে ২ ফেব্রুয়ারি এই হিসাব পরিচালনাকারীকে জাহাজ কিনতে ১৬ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ ক্রয় করার নিমিত্তে বের করে নিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।’
ঋণ হিসাবটি পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছে, এর থেকে ১৬ কোটি ছয় লাখ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে বেলায়েত নেভিগেশনের হিসাবে জমা হয়েছে। বেলায়েত নেভিগেশনের মালিক বেলায়েত হোসেন আসিফ ইকবালের আত্মীয়। যদিও ব্যাংক শাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদের বলেছিল, বেলায়েত আসিফ ইকবালকে চেনেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেলায়েত নেভিগেশনের মালিক বেলায়েত হোসেন চট্টগ্রামে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের আহ্বায়ক এবং কোস্টাল ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। গত বৃহস্পতিবার তাঁর কয়েকটি মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বন্ধ পাওয়া গেছে। পরে একটি সূত্র জানায়, তিনি বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের পদত্যাগের এক দিন আগে কানাডায় চলে গেছেন। জানা যায়, আবদুল হাইয়ের সঙ্গে বেলায়েত হোসেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
আরেক প্রতিষ্ঠান সিমেক্স লিমিটেড। যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনৈক রাশেদুল হাসান। এই হিসাবটি খোলা হয় ২০১০ সালে ৭ ডিসেম্বর। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ পর্ষদ সাত কোটি ৯০ লাখ টাকার ঋণসীমা অনুমোদন করে। শাখা থেকে কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়েছিলেন গ্রাহকের জামানত দেখতে। তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, এই ঋণকারীর বাসা, অফিস ও ফ্যাক্টরির যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো অস্তিত্ব তাঁরা খুঁজে পাননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ‘সার্বিক বিচারে প্রতিষ্ঠানটি নামসর্বস্ব, অর্থাৎ ভুয়া।’ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বকেয়ার পরিমাণ ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যার পুরোটাই ক্ষতির পর্যায়ে শ্রেণীকৃত হয়েছে। ঋণ হিসাবটিতে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পাদিত হওয়ার কোনো নজির বাংলাদেশ ব্যাংক পায়নি, বরং নগদে ঋণ হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনকে সন্দেহজনক মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রতিষ্ঠানটি নামসর্বস্ব বা অস্তিত্ববিহীন হওয়ায় এবং ঋণের টাকা অধিকাংশ নগদে উত্তোলিত হওয়ায় এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত ঋণের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে শাখার সে সময়ের কর্মকর্তারা এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইন্ধন আছে বলে প্রতীয়মান হয়।’
আরেক প্রতিষ্ঠান সাহারা ইমপোর্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ঋণের ১২ কোটি টাকা মাত্র ১২ দিনের মধ্যে পুরোটাই নগদে উত্তোলন করেছে। কোনো প্রকার ব্যবসায়িক কাজের জন্য পরিশোধ করা হয়নি। যাকে সন্দেহজনক মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো প্রতিবেদনের বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি ও সংযুক্ত প্রতিবেদনগুলো পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কী করব, তা আগামী কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.