ইসরায়েলের উন্মত্ততা চলছেই -গাজায় মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে

আহত শিশুর আর্তনাদ, সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কান্না কিংবা বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড়—কোনোটিতেই ভ্রূক্ষেপ করছে না ইসরায়েল। গাজার কট্টরপন্থী গোষ্ঠী হামাসকে দমন করার নামে নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনিদের নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে দেশটি। গতকাল শনিবার গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েল তার স্থল ও বিমান হামলা আরও তীব্র করে। গতকালসহ নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৩৪২ জনে উঠেছে, যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশই শিশু।

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় গতকাল ওই অঞ্চল সফরে গেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। অন্যদিকে ইসরায়েলের চলমান ‘উন্মত্ততা’ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত। খবর এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএনের।
৮ জুলাই থেকে গাজায় শুরু হওয়া ইসরায়েলের অভিযান ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’ দ্বাদশ দিনে পড়েছে গতকাল। ১০ দিন বিমান হামলার পরও হামাসের রকেট ছোড়া বন্ধ করতে না পারায় বলদর্পী ইসরায়েল বৃহস্পতিবার থেকে স্থল অভিযান শুরু করে।
গতকাল গাজার বিভিন্ন জনপদে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর লক্ষ্য করে বিমান থেকে ব্যাপক বোমা ফেলে ইসরায়েলি বাহিনী। এ ছাড়া ছোড়ে ট্যাংকের গোলা। এ অভিযানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয় আরও ৪৮ জন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, গতকাল দুপুরের পর ইসরায়েলি বিমান থেকে ছোড়া বোমায় নয়জন নিহত হন। এর আগে সকালে দক্ষিণ গাজার খান ইউনুস শহরে বিমান হামলায় নিহত হন সাতজন। অন্যদিকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে অনমনীয় হামাসের রকেট হামলাও অব্যাহত ছিল। তবে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অধিকারী দেশটিতে তা তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সুড়ঙ্গ দিয়ে সে দেশের মাটিতে ঢুকে পড়া এক ফিলিস্তিনি জঙ্গিকে হত্যার দাবি করেছে গতকাল। সেনাবাহিনী বলেছে, মেশিনগান নিয়ে ইসরায়েলি জনপদে হামলা চালানোর জন্য ঢুকে পড়েছিল একদল জঙ্গি। গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের দুজন সেনা প্রাণ হারায়।
মৃত্যু উপত্যকা: দুই দিকে ইসরায়েল আর একদিকে সাগরঘেরা ফিলিস্তিনশাসিত গাজা উপত্যকা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এক আতঙ্কের জনপদ। ইসরায়েলের মুহুর্মুহু হামলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর। মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ছে এমনকি ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুনির্বিশেষে যে কেউ। উগ্রপন্থী হামাসকে শায়েস্তা করাই ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হলেও হতাহতদের মধ্যে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের সংখ্যা নগণ্য। অতীতের অনেক ঘটনার মতোই হামাসের রকেট হামলার জবাবে বহুগুণ শক্তিশালী ইসরায়েল প্রত্যাঘাত করছে জঙ্গিবিমান আর কামান বা ট্যাংক দিয়ে। গাজায় পদাতিক সেনা পাঠানোরও চিন্তাভাবনা আছে ইসরায়েলের। তবে বেসামরিক প্রাণহানি অনেক বেড়ে যাওয়া ও ইসরায়েলের সেনাদের দিকেও হতাহতের আশঙ্কা থাকায় দেশটির ভেতরেই এ নিয়ে বিরোধিতা আছে।
‘উন্মত্ততা’ বন্ধের দাবি: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত গতকাল সকালে সিএনএনকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টার হামলায় ৬৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ সময়ে ধ্বংস করা হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো। ক্ষতিগ্রস্ত বা একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক হাজার বাড়িঘর। এ উন্মত্ততা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
ফিলিস্তিনের জরুরি সেবা বিভাগের মুখপাত্র আশরাফ আল-কাদরা বলেন, হামলায় গতকাল যাঁরা প্রাণ হারান তাঁদের মধ্যে আছেন গাজার উত্তরে বেইত হানুন শহরের জুবেইদা পরিবারের এক সদস্যও। ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়ে গত কয়েক দিনে পরিবারটির আরও চার সদস্য প্রাণ হারান। এর মধ্যে রয়েছে ছয় ও দুই বছর বয়সী দুটি শিশু। চিকিৎসা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, গতকাল সকালে বেইত হানুনে ইসরায়েলি হামলার শিকার হয় আবু জুরাদ পরিবারের চার শিশু। ট্যাংকের গোলায় প্রাণ হারায় তারা। এ নিয়ে এই পরিবারের আট সদস্য নিহত হলেন। এর আগেও ইসরায়েলের গোলায় গাজার একটি পরিবারের চার শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিকতম অভিযান শুরুর পর গাজায় এখন পর্যন্ত নিভে গেছে ৭২টি শিশুর প্রাণ।
বিবিসি জানায়, অভিযান শুরুর পর সহিংসতায় ইসরায়েলের পক্ষে নিহত হয়েছেন এক সেনা ও এক বেসামরিক লোক। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন।
গাজার শাসন পরিচালনাকারী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের মুখপাত্র সামি আবু জুহরি বলেছেন, ‘নেতানিয়াহু আমাদের শিশুদের হত্যা করছে, এর মূল্য তাঁকে পরিশোধ করতে হবে।’©
নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি: ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্থল আক্রমণের আওতা ‘উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর’ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, স্থল অভিযান জোরদারে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিমান হামলার পাশাপাশি স্থল অভিযানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে স্থল অভিযানের প্রয়োজন আছে। শুধু বিমান হামলা চালিয়ে সেনারা এ কাজ করতে পারেনি।
প্রায়ই ইসরায়েলের ঘেরাও ও নিরাপত্তা কড়াকড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া গাজা থেকে মিসর ও ইসরায়েলে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক আছে। জঙ্গিরা যেমন অস্ত্র পাচারের জন্য এগুলো ব্যবহার করে তেমনি বিভিন্ন বৈধ ও ইসরায়েল ঘোষিত অবৈধ পণ্য আমদানির সুযোগ করে দিয়ে তা স্থানীয় নির্জীব অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
হতাহত কমানোর আহ্বান ওবামার: ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন রয়েছে। কোনো দেশ তার ভূখণ্ডে একের পর এক রকেট এসে পড়া সহ্য করতে পারে না। তবে গাজায় বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানির ঘটনায় তিনি উদ্বিগ্ন। প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, সহিংসতা বৃদ্ধি ও নিরীহ মানুষের আরও প্রাণহানির ঝুঁকিতে ওয়াশিংটন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইসরায়েল বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা নেবে বলে ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা।
ওবামার এ আহ্বানের জবাবে ইসরায়েলি সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেন্নি গ্যান্টজ বলেছেন, সেনাবাহিনী স্থল অভিযান আরও জোরদার করছে। চরম মুহূর্ত সামনে আসছে।
জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থল অভিযান থেকে বাঁচতে এরই মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
পাশ্চাত্যের অন্যান্য তৎপরতা: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, ক্রমাবনতিশীল গাজা পরিস্থিতি নিয়ে ফোনালাপ করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এ প্রসঙ্গে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বলেছে, রকেট হামলা থেকে আত্মরক্ষায় সংগতিপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার ইসরায়েলের অধিকারের প্রতি আলাপে দুই নেতা তাঁদের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরা ফ্যাবিয়াস গতকাল গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় তিনি মিসরের নেওয়া শান্তি উদ্যোগের প্রতি আবারও তাঁর দেশের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন।
অভিযানের প্রেক্ষাপট: ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সর্বশেষ এই হামলার শুরু সম্প্রতি ইসরায়েলি তিন কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ইসরায়েল এ জন্য হামাসকে দায়ী করলেও তারা তা অস্বীকার করেছে। পরে ফিলিস্তিনি এক কিশোর একইভাবে দৃশ্যত প্রতিশোধমূলক অপহরণ ও হত্যার শিকার হওয়ার পর উত্তেজনা নতুন মোড় নেয়। গাজা থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাসের রকেট ছোড়া বন্ধের অজুহাতে ইসরায়েল নতুন করে এই অভিযান শুরু করে।
এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বরেও হামাসশাসিত গাজায় বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছিল ইসরায়েল। পরে আট দিনের মাথায় মিসরের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়। ফিলিস্তিনি শাসিত অপর অঞ্চল পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত ফাতাহ গোষ্ঠীর হাতে। তবে গত এপ্রিল মাসে দুই সংগঠনের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করে এ বছরের মধ্যে যৌথভাবে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.