বিমানে ওঠার আগে শেষ ই-মেইল শারলিনকে দেখার অধীর অপেক্ষা

২ সন্তানের জনক এক বৃটিশ নাগরিক থাকতেন নিউজিল্যান্ডে। বৃহসপতিবার ইউক্রেনে বিধ্বস্ত  মালয়েশিয়ান বিমানের নিহত যাত্রীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। ২৮ বছর বয়সী রবার্ট আয়লেয় বাড়ি ফিরছিলেন নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে দেখার জন্য। দুই সন্তানের একজনের বয়স দুই, অপরজনের বয়স চার বছর। তিনি প্রায় একমাস ধরে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে একটি পেশাগত কাজে অবস্থান করছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার পরিবার এক বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করে, রবার্ট সেই বিমানে ছিলেন। তার পরিবার জানায়, রবার্ট নিজের জীবন নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন। উচ্ছ্বসিত ছিলেন নিজের পরিবার নিয়েও। নিজের দুই সন্তানের মাঝে তিনি জগতের সমস্ত সুখ ও ভালবাসা খুঁজে পেতেন। শারলিন ছিল তার জীবনসঙ্গিনী, তার ‘রানী’। একে-অপরজনের জীবনটাই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন তারা দু’জন। তার পরিবার আরও জানায়, বিমানে ওঠার আগে নিজের সর্বশেষ ই-মেইলটি পাঠান রবার্ট। সেখানে তিনি লেখেন, আমার ফ্লাইট আগামীকাল বেলা ১২টায়। এই মুহূর্তে আমি কেবলমাত্র আমার দুই বাচ্চা ও শারলিনকে দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছি। ...এখন আমি বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত।
বিধ্বস্ত বিমান নিয়ে কূটনৈতিক সঙ্কট
মালয়েশিয়ার বিধ্বস্ত বিমানের ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। রাশিয়ার মদতে বিদ্রোহীরা আন্তর্জাতিক তদন্ত বিশেষজ্ঞ দলকে তদন্তকাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেছে ইউক্রেন। রাশিয়াপন্থি ওই বিদ্রোহীরা বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করছে বলেও অভিযোগ এনেছে তারা। এক বিবৃতিতে ইউক্রেন সরকার বলেছে, রাশিয়াপন্থি বিদ্রোহীরা ঘটনাস্থল থেকে ৩৮টি মৃতদেহ সরিয়ে বিদ্রোহী অধ্যুষিত শহর দোনেৎস্কের একটি হিমঘরে সরিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও বিমানের ধ্বংসাবশেষ রাশিয়াতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছে ইউক্রেন সরকার। এদিকে, ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক দল ওএসসিই বলেছে, তাদেরকে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দিয়েছে মিলিশিয়ারা। মালয়েশিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী লিইও তিওং লাই বলেন, মালয়েশিয়ার বিশেষজ্ঞদের যদি ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে না দেয়া হয় তবে সেটা হবে অমানবিক। যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীকে ঘটনার জন্য দায়ী করেছে। তাদের ইঙ্গিত রয়েছে রাশিয়ার দিকেও। উভয় রাষ্ট্র মনে করছে, মালয়েশিয়ার ওই বিমানটিকে বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভূপাতিত করা হয়েছে। আর এতে রাশিয়ার সহায়তা ছিল ধারণা করছে তারা। এসব অভিযোগের কড়া সমালোচনা করেছে রাশিয়া। গতকাল রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রাবকভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তদন্ত ফলাফলের অপেক্ষা না করেই বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাশিয়ার ওপর দোষারোপ করছে। রাশিয়ার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, মার্কিন কর্তৃপক্ষের এ হেন বিবৃতি ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে তাদের গুরুতর রাজনৈতিক ভ্রান্তধারণার প্রমাণ। পশ্চিমা বিশ্বকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তথ্যযুদ্ধ পরিচালনা করার অভিযোগ এনে দায়ী করে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ক্রেমলিনের মদতপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী না করে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের উচিত মালয়েশীয় বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় তাদের নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী কি করছিল তা ব্যাখ্যা করা। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবটও দুর্ঘটনাস্থল সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজন ব্যক্ত করেছেন। সেখানে আলামত নষ্টের প্রচেষ্টা হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক দলকে প্রাথমিক ভাবে বাধা দেয়ার পর তাদেরকে পায়ে হেঁটে এগোতে দেয় বিদ্রোহীরা। কিন্তু তাদের গতিবিধি ধ্বংসাবশেষ স্থানের আগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। ইউক্রেন সরকার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে সন্ত্রাসী কর্মকা- বলে অভিহিত করে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে ইউক্রেন সরকারের প্রতি পাল্টা অভিযোগ করেছে। তাদের দাবি ইউক্রেন বিমান বাহিনীর একটি বিমান ওই মালয়েশীয় বিমানকে ভূপাতিত করেছে। বৃহস্পতিবার পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত বিমানটি ২৯৮ আরোহীর প্রত্যেকে প্রাণ হারার। আমস্টারডাম থেকে ফ্লাইট এমইচ-১৭ কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে যাচ্ছিল। লুহানস্ক এলাকার ক্রাস্নি লুচ ও দোনেৎস্ক এলাকার শাখতারস্ক নামক স্থানের মাঝামাঝি বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী বিমান আরোহীদের মধ্যে নেদারল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন ১৯৩ জন। এছাড়াও ছিলেন ৪৪ মালয়েশীয় (১৫ ক্রু সহ), ২৭ অস্ট্রেলিয়ান, ১২ ইন্দোনেশিয়ান, ১০ বৃটিশ, ৪ জার্মান, ৪ বেলজিয়ান, ৩ ফিলিপিনো এবং কানাডা ও নিউজিল্যান্ড থেকে একজন করে নাগরিক।
এমএইচ-১৭ এর পূর্ণ যাত্রী তালিকা প্রকাশ
মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন্স গতকাল এমএইচ-১৭ এর পূর্ণ যাত্রী তালিকা প্রকাশ করেছে। নিহত ব্যক্তির মৃতদেহ শনাক্ত করতে সহায়তা করার জন্য যাত্রীদের পরিবার ও স্বজনদের প্রতি আবেদন জানিয়েছে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানের এক মুখপাত্র বলেন, তারা নিহতদের পরিবারের সদস্যদেরকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। তবে তেমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তারা ইউক্রেনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। ওই মুখপাত্র আরও জানান, এয়ারলাইন্সের একটি দল আমস্টারডামে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তা করছে। অন্যদিকে তাদের একটি নিরাপত্তা দল রয়েছে ইউক্রেনে। গতকাল নেদারল্যান্ড জুড়ে একাধিক ফরেনসিক দল নিহতদের পরিবার থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ করেছে। এছাড়াও, গত ৪৫ ঘণ্টায় এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সহযোগিতায় মৃতদের নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। নিহতদের মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ নমুনা ও ছবি ব্যবহার করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.