ভাঙা রেকর্ড by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নজরে আনার জন্য আমি অনেক দিন থেকে চেষ্টা করে আসছিলাম, খুব একটা লাভ হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত আমাকে গত শুক্রবার একটা নাটকীয় কাজ করতে হল। আগের দিন পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়ে আমি সেখানে লিখলাম বিষয়টির প্রতিবাদ হিসেবে পরের দিন শুক্রবার আমি শহীদ মিনারে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকব। তখন অনেকেই আমার কাছে জানতে চাইল কখন কীভাবে সেখানে আমি যাব। সাংবাদিকরা, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু আমি কারও কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। পুরো বিষয়টি ছিল একান্তভাবেই আমার ব্যক্তিগত প্রতিবাদ, সেখানে আমি নিজে থেকে কাউকেই ডাকতে পারি না! কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না। নিজের উদ্যোগে কেউ চলে এলে সেটি ভিন্ন কথা।

শুক্রবার অনেকেই শহীদ মিনারে চলে এলো। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আছে, স্কুলের শিশুরা আছে, এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা আছে। বেশ কিছু শিক্ষক আছেন, এক-দুজন গৃহিণীও আছেন। কিছুক্ষণের ভেতর সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরাও চলে আসতে শুরু করলেন। বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভালো লাগে আর সত্যি সত্যি ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। অন্যদের বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে আমি জানি না, কিন্তু শহীদ মিনারে প্রায় সবাই সেই বৃষ্টিতে খুব আনন্দের সঙ্গে কাকভেজা হয়ে গেল (আমি অনেককে বৃষ্টিতে ভেজার কথা শুনলে আঁতকে উঠতে দেখেছি। কিন্তু সবাইকে বলে রাখি, আমাদের দেশের বৃষ্টির মতো সুন্দর আর কিছু নেই, বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়- আমার জীবনে সেটি কখনও ঘটেনি!)।
শহীদ মিনারে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমার বসে থাকার কথা ছিল। আমি তাই খুব যত্ন করে একটা প্ল্যাকার্ড তৈরি করে সেখানে লিখে নিয়ে গেলাম, প্রশ্ন ফাঁস মানি না মানব না, ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন ধ্বংস হতে দেব না। আজকাল ক্যামেরার কোনো অভাব নেই, তাই সেখানে প্রচুর ছবি তোলা হল এবং আমি প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে আছি সেই ছবিটা নিশ্চয়ই ফেসবুকে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আমি আসলে এ বিষয়টির কথা বলতে চাচ্ছি না। অন্য একটা কথা বলতে চাচ্ছি। প্ল্যাকার্ড হাতে আমার শহীদ মিনারে বসে থাকার ছবিটি নিয়ে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। কোনো একজন ছবির প্ল্যাকার্ডে আমার লেখার মাঝে খানিকটা পরিবর্তন করে সেই ছবিটা ফেসবুকে ছেড়ে দিল! এখন এই ছবিটা দেখলে যে কেউ ভাববে, আমি যে শুধু প্রতিবাদ করছি তা নয়- প্রশ্ন ফাঁস হওয়া পরীক্ষাগুলো বাতিল করারও দাবি জানাচ্ছি!
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার এই মহাবিপর্যয়ের জন্য ঠিক কী করতে হবে, আমি কিন্তু সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি-দুটি কথা বলেছি! কাউকে সব পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিইনি। কিন্তু আমি সেটাই দাবি করছি- কিছু মানুষ এই সংবাদটা প্রচার করার জন্য খুব ব্যস্ত! কারণটা কী সেটি এখনও আমার কাছে রহস্য। আমার জীবনে এটি নতুন কোনো রহস্য নয়, একসময় স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধরা আমার বিরুদ্ধে লেগে থাকত, এখন অন্যরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে!
যাই হোক, শহীদ মিনারে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকার কারণে একটা খুব বড় কাজ হল। হঠাৎ করে সারা দেশের সব মানুষ জানতে পারল, দেশে খুব বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। যারা দীর্ঘদিন থেকে মেনে নিয়েছিল যে পরীক্ষা মানেই হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁস, তারাও এবার নড়েচড়ে বসল। যেসব সংবাদপত্র এতদিন ভুলেও প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে একটি লাইনও লিখেনি, তারা সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করল; যে টেলিভিশন চ্যানেল প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কিছু প্রচার করেনি, তারা আমাকে কিংবা আমার মতো শিক্ষকদের টকশোতে ডাকতে শুরু করল, এমনকি শিক্ষাবিদরাও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কলাম লিখতে শুরু করলেন। একটা সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হলেই শুধু সেই সমস্যার সমাধান করা যায়- মনে হল শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেটি পুরোপুরি স্বীকার করে না নিলেও দেশের মানুষ সেটা স্বীকার করে নিয়েছে। কাজেই বিষয়টাকে আর সম্ভবত ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাবে না।
তবে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ে আমার এখনও কিছু বক্তব্য রয়েছে- তাদের দায়িত্বটি আমি এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। এবার যে ব্যাপকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, সেটি নিয়ে আমার কিংবা পরীক্ষার্থীদের মাঝে তিল পরিমাণ সন্দেহ নেই। পরীক্ষার আগে যে প্রশ্নটি এসেছে, দুদিন পর সেই প্রশ্নটিই পরীক্ষায় আসছে- এখানে সন্দেহ করার জায়গাটি কোথায়? কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলো কেন জানি পুরো বিষয়টি এখনও নিশ্চিত সত্য বলে স্বীকার না করে এটি অভিযোগ বলে গা বাঁচিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে। এটি শুধু একটা অভিযোগ নাকি সত্যি সত্যি এটা ঘটেছে সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব কার? আমার নাকি সংবাদমাধ্যমের? আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও সংবাদ মাধ্যম কেন সেটি বিশ্বাস করে এটাকে একটি সত্য ঘটনা হিসেবে প্রচার করে না? কেন তারা এটাকে শুধু একটা অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করে?
যাই হোক, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে এই চেঁচামেচিতে কিছু কাজ হয়েছে। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী প্রতিবাদ হিসেবে শহীদ মিনারে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছে। খবরের কাগজে দেখতে পেলাম, আগামী ১১ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব শিক্ষাবিদকে ডাকা হয়েছে। সরাসরি এখনও বলা হয়নি যে, তাদের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আলোচনা করার জন্য ডাকা হয়েছে। কিন্তু আমি আশা করছি, এ সময়ে দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদকে ডাকা হলে তারা নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটা তুলে আনবেন। আমি এখন খুব আগ্রহ নিয়ে এই ১১ তারিখের মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছি।
২.
শুক্রবার ভোরবেলা আমি শহীদ মিনারে বসেছিলাম। বিকালে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমার মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল। প্রশ্ন ফাঁসের মতো এত বড় বিপর্যয়ের জন্য কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দায়ী, যেহেতু কাউকে সেই দায় নেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই দায়টুকু শিক্ষামন্ত্রীর ঘাড়েই এসে পড়বে। পুরস্কার বিতরণীর সেই অনুষ্ঠানেও তখন তাকে শিশুসাহিত্যের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কিছু কথা বলতে হল। মঞ্চে অনেকেই বসেছিলাম, তার মাঝে বেছে বেছে শুধু আমাদের দুজনের ছবি তুলে সেই ছবিটা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে! শুনেছি সেই ছবি নিয়ে ফেসবুক জগতে অনেক ধরনের সমালোচনা হয়েছে। আমি কখনোই ফেসবুকের আলোচনা-সমালোচনা দেখি না, দেখার সুযোগও নেই। তাই ঠিক কোন বিষয়টির সমালোচনা করা হয়েছে জানি না। কিন্তু কোনো বিষয়ে কারও সঙ্গে সাময়িক মতপার্থক্য থাকলে তার পাশে কেন বসতে পারব না, আমি সেটা বুঝতে পারিনি। বিশেষ করে যখন একটা পুরস্কার দেয়ার জন্য ডেকে নিয়ে আয়োজকরা আমাকে সেখানে বসিয়েছেন!
আমার সঙ্গে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর খুব ভালো সম্পর্ক। তাই সেদিনও নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তৈরি করে দেয়া তদন্ত কমিটির সঙ্গে ফোনে কথা বলে তখনই আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমি সিলেট থাকি, শুক্র শনিবার কিংবা ছুটিছাঁটায় ঢাকা যেতে পারি। তাই তদন্ত কমিটিকে পরের দিন শনিবারই তাড়াহুড়ো করে আমার সঙ্গে দেখা করতে হল। ঢাকা শহরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোথাও হাজির হওয়ার মতো বিড়ম্বনা আর কিছুতে নেই। তাই ছুটির দিনে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন সদস্যদের এক জায়গায় উপস্থিত করতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। তদন্ত কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ সময় বসে আমার কথা শুনলেন, আমার রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-হতাশা সব কিছুই খুব সমবেদনার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমি আমার কথাগুলো শুধু পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলাম। এই তদন্ত কমিটির সদস্যদের দিয়ে সেটি সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারলে নিজেকে খানিকটা হলেও সান্ত্বনা দিতে পারব।
৩.
আমি একসময় অনিয়মিতভাবে পত্রপত্রিকায় লিখতাম। আজকাল নিয়মিতভাবে লিখি। নিয়মের বাইরেও যদি কিছু একটা লিখি, পত্রপত্রিকাগুলো সাধারণত সেগুলো ছাপাতে আপত্তি করে না। মজার ব্যাপার হল, আমি যা লিখি বা যেভাবে লিখি, এ দেশের অসংখ্য মানুষ তার চেয়ে অনেক সুন্দর করে, অনেক গুছিয়ে লিখতে পারে। আমি বিশেষভাবে চমৎকৃত হই যখন দেখি কম বয়সী তরুণ-তরুণী কিংবা কিশোর-কিশোরীরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কিছু লেখে। প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে অনেকেই আমার কাছে অনেক কিছু লিখেছে। সবই ব্যক্তিগত চিঠির মতো। আমি সেগুলো থেকে তাদের মনের কিছু কথা পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি।
ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পেয়ে একজন লিখেছে: ... আমার প্রথম পত্র পরীক্ষা ভয়ংকর খারাপ হয়েছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এসেছে দেখে লিখতে ইচ্ছে হয়নি। ঘেন্না লেগেছে। এখনও পড়ছি না, রুচি হচ্ছে না। কী হবে পড়ে বলবেন? আমার আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। এই সিস্টেম আমার জীবনকে তছনছ করতে পারবে না। আমি এতো সস্তা না। আর পারলে করুক।
এরকম একটা চিঠি পেলে কেমন লাগে সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। তারপরও আমি ছেলেমেয়েগুলোর মনের জোর দেখে চমৎকৃত হই। আরেকজন লিখেছেন, “... আমার ছোট ভাই চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ায়। তার একটা ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। গত ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার সময় হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষার পূর্বের রাতে সে দেখে তার এক ছাত্র বাজারে ঘুরছে। সে তাকে পরীক্ষার কথা স্মরণ করে দিলে সে বলে যে তার পড়তে হবে না, কারণ প্রশ্ন তার হাতে এবং প্রস্তুতি শেষ। আমার ভাই তাকে বলে, সে প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্যতা কী? ছাত্রের উত্তর ছিল, স্যার গণিত পাইছিলাম হুবহু কমন, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র ১০০ শতাংশ, অতএব হিসাব বিজ্ঞান নিয়া চিন্তা নাই, অবশ্যই কমন পড়বই। পরের দিন দেখা গেল ওই ছাত্রের কথাই সত্যি এবং সে হিসাব বিজ্ঞানে এ প্লাস এবং মোট জিপিএ ৪.৮৮ পেয়েছে। অথচ এই ছাত্র পাস করবে কি-না তা নিয়ে সবাই চিন্তিত ছিল। এই হল বাস্তবতা।”
এ চিঠির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কি সবাই লক্ষ্য করেছেন? আমরা শেষ পর্যন্ত এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে হৈচৈ করছি। এই চিঠিতে কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে- শুধু তাই নয়, গত বছরের এসএসসি। যার অর্থ, প্রশ্ন ফাঁস আসলে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটা বিপর্যয় নয়, এটা একটা নিয়মিত ঘটনা। আমি যতদূর জানি, শুধু এসএসসি নয়, পিএসসি ও জেএসসিতেও এটা ঘটছে। যখন ভয়ংকর অন্যায়কে নিয়মিত গ্রহণযোগ্য ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়া হয়, তার চেয়ে সর্বনাশা কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
এবার একজন মায়ের লেখা একটা চিঠি : “... নিরূপায় হয়ে আপনাকে লিখছি। আমার মেয়ে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। প্রথম পরীক্ষার পরের দিন থেকেই জানতে পারি প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। শুধু অভিভাবক হিসেবে নয়, নীতিগত কারণে এবং বিশ্বাস থেকেও বললাম, বিভ্রান্ত হয়ো না, মিসগাইড করার জন্যও কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ায়। তখনও জানি না আমার জন্য কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে। ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা দিয়ে এসে বলল, আম্মু, আমার আশেপাশে ম্যাক্সিমাম মেয়ে প্রশ্ন পেয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে? বলল, ফেসবুকে। .... এরপর ওকে বললাম, সেখানে ঢুকলেই যদি প্রশ্ন পাওয়া যায়, তুমিও নাও। দেখলাম মেয়ের চোখে পানি। আমাকে বলল, আমি তো পড়েছি, আমি কোনো প্রশ্ন দেখব না। বললাম, তুমি যদিও মনে করছ এটা অপরাধ, আমি মনে করছি এটা অপরাধ নয়।... আমি বা তুমি কারও শরণাপন্ন হচ্ছি না বা টাকা খরচ করছি না। ফেসবুকের মতো গণমাধ্যমে এটা প্রচার করা হচ্ছে। এটা সবার দেখার জন্য। সবাই প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেবে, তোমার থেকেও ভালো রেজাল্ট করবে, তখন কষ্ট হবে। তাছাড়া ভর্তির ক্ষেত্রে তো তুমি পিছিয়ে যাবে। মেয়ে রাজি হল না। আমিও ওর মনের ওপর চাপ দিলাম না। ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার আশপাশে সবার পরীক্ষা ওর থেকে ভালো হল ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে। এরপর ১৭ দিন গ্যাপ, তারপর কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের রাতে নেটে গেলাম, রাত একটায় দেখলাম প্রশ্ন চলে এসেছে। ল্যাপটপ নিয়ে মেয়ের পাশে যেয়ে বললাম, একটা লুক দাও। মেয়ে কড়া সুরে ২ বার বলল, না। চলে এলাম। আর কিছু ওকে বলিনি। ম্যাথ ফার্স্ট পেপার পরীক্ষায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রশ্ন ফাঁস। সবার পরীক্ষা এক্সিলেন্ট, ওর পরীক্ষাও ভালো তবে যেহেতু হলে বসে চিন্তা করে করেছে, সময়ে কুলাতে পারেনি। ৪ নম্বর ছেড়ে আসতে হয়েছে। চেহারায় কষ্টের ছাপ। সঙ্গে ২/১ জন বান্ধবী ছিল যারা প্রশ্ন দেখত না। তারাও সেদিন দেখেছে। ভয় পেলাম, কী জানি নার্ভাস ব্রেক ডাউন না হয়ে যায়...। আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমার মেয়ে কি সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা দেয়া ছেলেমেয়েদের দলে পড়ে গেল না? ও কি সেই বদনাম থেকে, কলঙ্ক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে, যাদের দিকে মানুষ আঙুল তুলে দেখাবে- ওরা ২০১৪ সালের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে এইচএসসি পাস করেছে।”
এই চিঠিটা থেকে বোঝা যায়, কীভাবে অভিভাবকরা না চাইলেও শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের কাছে অসহায়ভাবে মাথানত করতে বাধ্য হয়ে যান। তবে যে বিষয়টি এখনও আমাকে আশা নিয়ে বাঁচতে শেখায়, সেটি হচ্ছে শত প্রলোভনেও কম বয়সী একটা মেয়ে মাথা উঁচু করে সৎ থেকে যায়!
আমার কাছে এরকম অসংখ্য চিঠি আছে। আমি পড়ি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
৪.
প্রশ্ন ফাঁসের এ ব্যাপারটি এত জটিল এবং এত পরিপূর্ণ একটি বিপর্যয় যে, এখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যাবে, আমি সেটা ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পাই না। তবে আমি মনে করি, অবশ্য অবশ্যই এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে উচ্চপর্যায় থেকে তিনটি কাজ করা উচিত। সেই কাজ তিনটি হচ্ছে:...
. এ দেশের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে খুব মন খারাপ করে বসে আছে, তাদের মনটি ভালো করে দেয়ার জন্য কিছু বলতে হবে। তাদের কী বলা হবে, সেটি ভাবনাচিন্তা করে ঠিক করা যেতে পারে, কিন্তু কিছু একটা বলতেই হবে। বিশেষ করে যারা প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর সুযোগ পেয়েও সেই প্রশ্ন দেখেনি, তাদের একটা সেল্যুট দিয়ে বলতে হবে, তোমরাই এ দেশের ভবিষ্যৎ।
. সামনেই বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা। যারা এবার এইচএসসি দিয়েছে, তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে, ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসির ফলাফল যেন কোনো বড় ভূমিকা রাখতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্মিলিতভাবে এ কাজটি করতে হবে।
গ. তৃতীয় বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি, এ দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে, অতীতে যা হওয়ার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এই বাংলাদেশে আর কোনো দিন কোনো প্রশ্ন ফাঁস হবে না। প্রশ্ন যেন ফাঁস না হতে পারে সে জন্য তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে দেশের সব উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে সবাই মিলে ব্যবহার করবে। প্রশ্ন আর কখনও ফাঁস হবে না।
আমাদের প্রিয় দেশটির ভবিষ্যৎ যে কত সুন্দর, সেটি সবাই অনুমান করতে পারে কি-না আমি জানি না। অল্প কিছু দায়িত্বহীন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে থাকা মানুষের জন্য আমরা আমাদের সেই সুন্দর ভবিষ্যৎটি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। যদি কেউ চেষ্টা করে, কাজ হোক আর না হোক, ভাঙা রেকর্ডের মতো আমি চিৎকার করতেই থাকব!
০৪.০৬.১৪
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : লেখক; অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.