মিঠাপুকুরে সবজি বিপ্লব by মাহবুব রহমান

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার কাফ্রিখাল, রানীপুকুর, লতিফপুর, গোপালপুর, মির্জাপুর, বড়হজরতপুর, বালারহাট, বালুয়া মাসিমপুর, বড়বালা, পায়রাবন্দসহ ১৭টি ইউনিয়নের ৩১০ গ্রামে সবজি চাষে বিপ্লব ঘটেছে। এসব গ্রামের কৃষকের আয়ের মূল উৎস এখন সবজি চাষ। গ্রামগুলো যেন সবুজের চাদরে ঢাকা। সবজি উৎপাদন মৌসুমে কৃষক পরিবারগুলোর কাটে দারুণ ব্যস্ত সময়। বিশেষ করে পরিবারের নারী সদস্যদের বেশ ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় ক্ষেত পরিচর্যার কাজে। মিঠাপুকুর থেকে প্রতিদিন অন্তত ২০-২৫ ট্রাক সবজি রাজধানীতে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণের অভাবে চাষীরা প্রায়ই পানির দরে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রংপুর জেলায় চলতি বছর ৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল মিঠাপুকুর উপজেলায় চাষ হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। মঙ্গলবার সরেজমিনে মিঠাপুকুরের গ্রামগুলো ঘুরে এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শুধু ঢাকা নয়, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনা, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেও পাইকাররা আসেন নানা জাতের সবজি নিতে। কথা হয় ঢাকা থেকে সবজি কিনতে আসা পাইকার মোল্লা আনিসের সঙ্গে। প্রতিদিনই মিঠাপুকুর থেকে সবজির চালান তিনি ঢাকায় পাঠান। এ কাজের জন্য তিনি এখানে থাকার জন্য বাসাও ভাড়া নিয়েছেন। তিনি জানান, তুলনামূলকভাবে অনেক কম দামে এখানে সবজি পাওয়া যায়। সবজি চাষ এ অঞ্চলের কৃষকদের স্বাবলম্বী করে তুলেছে। মিঠাপুকুরের সবজির বাজার এখন দেশজুড়ে। সপ্তাহের প্রতিদিনই সবজির হাট বসে বৈরাগীগঞ্জ, বলদিপুকুর, জায়গীর, রানীপুকুর, শঠিবাড়ী, বৈরাতী, শুকরের হাট, শাল্টিরহাট, পাগলারহাট, মলঙ্গেরহাট, এরশাদ মোড় ও নানকর হাটে। এ সব হাটে পাওয়া যায় শশা, আলু, বেগুন, মরিচ, লাউ, পেঁয়াজ, বরবটি, পালং শাক, লাউ শাক, টমেটো, ঢেঁড়স, ঝিঙ্গা, করলাসহ নানা জাতের সবজি। বারোমাসই এ অঞ্চলে নানা জাতের সবজির চাষ হচ্ছে। মিঠাপুকুরের সবজি চাষীদের একটি বিশেষত্ব হল তারা কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে কেবল জৈব সার ব্যবহার করেন। এতে সবজির মান যেমন ভালো হচ্ছে তেমনি ফলনও ভালো পাচ্ছেন তারা।
বাতাসন দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক মোফাজ্জল হোসেন জানান, এবার আড়াই বিঘা জমিতে তিনি পটল ও করলা চাষ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। তিনি এক থেকে দেড় লাখ টাকার সবজি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। সোমবার পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩৫ হাজার টাকার পটল ও করলা বিক্রি করেছেন। একই গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন ২৮ শতক জমিতে বেগুন ও ঢেঁড়স চাষ করেছেন। প্রতি হাটে এক থেকে দুই মণ বেগুন ও ঢেঁড়স বিক্রি করেন। এবারের মৌসুমে সব খরচ বাদ দিয়ে তিনি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভের আশা করছেন। এরই মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সবজির উৎপাদনও অনেক বেশি হয়েছে বলে ওই দুই কৃষকের কাছ থেকে জানা গেল।
বলদীপুকুর গ্রামের সোলায়মান মিয়া ২৫ শতক জমিতে পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত সাড়ে ৫ হাজার টাকার শাক বিক্রি করেছেন, বাকি শাক থেকে আরও ৯ হাজার টাকা পাওয়ার আশা করছেন। বৈরাগীগঞ্জ গ্রামের হাসানুল হক ২৭ শতক জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়েছে, দামও ভালো পাচ্ছেন। একই গ্রামের রফিক মিয়া মাত্র ১৮ শতক জমিতে কাঁচামরিচের আবাদ করেছেন। জমি চাষ, চারা রোপণ ও দুইবার নিড়ানি দিতে খরচ হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এ মরিচ তিনি ৬ মাস পর্যন্ত বিক্রি করে প্রায় ১৪ হাজার টাকা লাভের আশা করছেন।
বলদীপুকুর হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সবজি ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার সবজি উন্নতমানের ও রোগবালাইমুক্ত। পায়রাবন্দের কৃষক কাশেম মিয়া জানালেন, সবজি থেকে এ অঞ্চলের কৃষকদের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে পাইকাররা। হিমাগারে মজুদ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জমি থেকে তোলা প্রতিদিনের সবজি সেদিনই বিক্রি করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ফলে ফসলের জোগান বেশি হলে দাম কমে যায় অস্বাভাবিক হারে। ঘরে মজুদ রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। তাই পাইকারদের কাছে পানির দরে বিক্রি করে দিতে হয়। তাই এ অঞ্চলে সরকারিভাবে একটি সবজি হিমাগার স্থাপনের দাবি চাষীদের।
মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ সরওয়ারুল হক জানান, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সবজির ফলন ভালো হয়েছে। সবজির দামও বিগত বছরগুলোর তুলনায় ভালো হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে সবজি চাষে উৎসাহ অনেক বেড়ে গেছে। যদি সবজি হিমাগার থাকত তাহলে কৃষকরা পানির দরে বিক্রি না করে সবজি মজুদ করে চাহিদা মতো ভালো দামে বিক্রি করতে পারত।

No comments

Powered by Blogger.