‘হাতি খাদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে’- খেয়েদেয়ে কাজটি হচ্ছে পদত্যাগ by এ কে এম জাকারিয়া

হাতির খাদে পড়ার সঙ্গে চামচিকার লাথি মারার সম্পর্কটি আমাদের সমাজে অনেক পুরোনো৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী তাঁর বর্তমান দশা সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে এই আক্ষেপই জানিয়েছেন৷ ‘হাতি খাদে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে’৷ ফলে, এমন একটি পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের উচিত ‘হাতিকে’ সহযোগিতা করা৷ এখানে হাতির চরিত্রটি যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী নিজে, তা স্পষ্ট৷ কিন্তু চামচিকার চরিত্রগুলো যে কারা, তা ধোঁয়াশাই রয়ে গেল৷ এরা কি তাঁর দল বা সরকারের কেউ কেউ, নাকি ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো শক্তি’? আরও একটি বিষয় বোঝা যাচ্ছে না, সাংবাদিকেরা কীভাবে ‘হাতির’ প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন!

হাতির মতো বড়সড় একটি প্রাণীর খাদে পড়ে যাওয়াটা চরম বিপদেরই বটে! এর সঙ্গে যদি চামচিকাদের উৎপাত যোগ হয়, তবে মাথা ঠিক রাখা সত্যিই কঠিন৷ আনুষ্ঠানিক কারণ জ্বর হলেও সম্ভবত সেসব এড়াতেই তিনি গত সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে যাননি৷ কারণ, ‘জ্বর’ নিয়েই তো তিনি মন্ত্রণালয়ে গেলেন, বিকেলে দলের অফিসে৷ কিন্তু উৎপাত থেকে মুক্ত থাকতে পারলেন কি! মন্ত্রিসভার ‘বৈঠক শেষে গুঞ্জন ওঠে যে ত্রাণমন্ত্রী আর মন্ত্রিসভায় থাকছেন না’৷ চামচিকারা তো অনেক কিছু বলবে, কিন্তু হাতি তাকে পাত্তা দেবেন কেন? হাতির িক ‘খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই’! মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করবেন িক না, এমন প্রশ্নকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন এভাবেই৷ তবে সাংবাদিকেরাই বা এমন প্রশ্ন করতে গেলেন কেন? আমাদের দেশে কে কবে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দিয়েছে!
হাতি কীভাবে ও কেন খাদে পড়লেন, সেটা সবারই জানা হয়ে গেছে৷ নারায়ণগঞ্জে সাতটি খুন হয়েছে এবং তা বড়ই নৃশংস কায়দায়৷ গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা টাকা নিয়ে এই কাজ করেছেন৷ এই অভিযোগ এখনো প্রমাণিত না হলেও এর যে ভিত্তি রয়েছে, তা বোঝা গেছে সরকারের কিছু উদ্যোগে৷ প্রথমে র৵াবের অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে তাঁদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ এরপর তাঁদের অবসরে পাঠানো হয়েছে৷ এই ঘটনার মূল যে অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তা, কর্নেল (ঘটনার পর তাঁকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিয়ে অবসর দেওয়া হয়েছে) তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, তিনি ঘটনাচক্রে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীর জামাতা৷ জামাতা যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, এর দায় শ্বশুর নেবেন কেন? ফলে, হাতির খাদে পড়ার কোনো কারণ ছিল না৷ কিন্তু হাতি যে নিজেই খাদে গিয়ে পড়েছেন!
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে যখন তারেক সাঈদের নাম পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছিল, তখন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী একটি বিবৃতি দিয়ে বসলেন, তা-ও আবার মন্ত্রণালয়ের প্যাডে৷ তিনি দাবি করলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের কোনো যুক্ততা নেই৷ ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে এটুকুও জানিয়ে রাখতে চাই, এ হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত মামলায় অভিযুক্তদের সঙ্গে আমার পরিবারের কোনো সদস্যের কখনোই কোনো রকম যোগাযোগ বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল না৷’ এমন একটি বিবৃতি দিয়ে তিনি যে কাজটি আসলে করলেন, তা হচ্ছে অভিযুক্ত তারেক সাঈদকে নির্দোষ প্রমাণ বা তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন৷ মন্ত্রী পদে থেকে কেউ যদি কোনো অভিযুক্তের পক্ষ নিয়ে বিবৃতি দেন, তখন এটা পরিষ্কার হয় যে তিনি তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব খাটাতে চাইছেন৷ আইনকে তিনি নিজের মতো চলতে দিতে চাইছেন না৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী হাতির যে খাদের কথা বলেছেন, তা আসলে ওই বিবৃতি৷ এই খাদ তিনি নিজেই খুঁড়েছেন এবং সেখানে গিয়ে পড়েছেন৷ এখন ‘চামচিকাদের’ দোষ দিয়ে কি তিনি খাদ থেকে উঠতে পারবেন! বা সাংবাদিকেরা কি চাইলেই এ ধরনের কোনো হাতিকে খাদ থেকে টেনে তোলার কাজে ‘সহযোগিতা’ করতে পারবেন? তাঁর পরিবারের লোকজনকে জড়িয়ে নানা ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘এলোমেলো’ গালগল্প তো নাকি সাংবাদিকদেরই তৈরি!
আমাদের দেশের যাঁরা ক্ষমতাবান, বিশেষ করে সরকারে থাকেন, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, তাঁরা অনেক কিছুকেই উল্টেপাল্টে দিতে পারেন৷ আইন বেশির ভাগ সময়েই তাঁদের জন্য সমানভাবে কাজ করে না৷ এ ধরনের ক্ষমতাবান ‘হাতিদের’ সন্তানসন্ততি আর পরিবারের লোকজন যে বেশি মদমত্ত হয়ে ওঠে, তার উদাহরণ অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমরা পেয়েছি৷ তাঁরা নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে গেছেন, সেসবও আমরা দেখেছি৷ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা মানেই তিনি অপরাধী নন, আর র৵াবের অভিযুক্ত একজন সদস্যের শ্বশুর হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীকে নিয়ে এত কথা বলারও কিছু ছিল না৷ কিন্তু তিনি যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দোষ বলে বিবৃতি দিয়েছেন, সরকারের মন্ত্রী হয়ে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন!
সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের কয়েকজন চিহ্নিত সদস্যের জড়িত থাকার বিষয়টি সরকার অস্বীকার করছে না বা করতে পারেনি৷ ঘটনার পরপরই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের র‌্যাব থেকে প্রত্যাহার করে নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া এবং পরে সেনা ও নৌবাহিনী থেকে তাঁদের বিদায় দেওয়ার মাধ্যমে সরকার জনমনে যে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তার উল্টো পথেই হাঁটলেন সরকারের এই সদস্য৷
একজন মন্ত্রী তাঁর অভিযুক্ত জামাতার পক্ষ নিয়েছেন এবং এরপর ঠিকঠাক তদন্ত হবে বা ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, এমন বিশ্বাস ধরে রাখা খুবই কঠিন৷ আমরা তো দেখছি, উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও র‌্যাবের অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না৷ অভিযুক্ত জামাতার পক্ষ নিয়ে সরকারের স্বঘোষিত এই ‘হাতি’ শুধু নিজেই খাদে পড়েননি, সরকারকেও খাদে টেনে নামানোর পথ তৈরি করছেন৷
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর নিজের জামাতার পক্ষ নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী নিজের ও সরকারের জন্য যে ‘দুর্যোগ’ ডেকে এনেছেন, তার সবচেয়ে ভালো ‘ব্যবস্থাপনা’ হতে পারে মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো৷ এতে ‘চামচিকাদের লাথি’ থেকে তিনি যেমন আপাত রেহাই পাবেন, তেমনি সরকার ও তাঁর দলও রেহাই পাবে৷ তবে তিনি সে পথ ধরবেন বলে মনে হচ্ছে না৷ কারণ, পদত্যাগ ছাড়া ‘খেয়েদেয়ে’ করার মতো আরও অনেক কাজ ওনার রয়েছে৷ ফলে, নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ ও খুনের ঘটনার স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের স্বার্থে এই কাজটি করার দায়িত্ব সরকারের ওপর এসেই পড়ছে৷

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.