টানাপোড়েন বাড়বে না কমবে? by আলী রীয়াজ

ভারতের নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের ফলে এটা নিশ্চিত যে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। ১০ বছর পরে ভারতের ক্ষমতাঁয় পরিবর্তনের ফলে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন ঘটবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন অনেকেরই মনে। এই প্রশ্নের প্রধান কারণ এটা নয় যে দেশের ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থী দল ভারতীয় জনতাঁ পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতাঁসীন হচ্ছে।

প্রশ্ন ওঠার কারণ বিজেপির নেতাঁ হিসেবে যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, তাঁর বিষয়ে অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপরে হামলা ও হত্যাযজ্ঞের সময় মোদি ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও কোনো রকম দায়িত্ব স্বীকার করেননি। যদিও আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণাদি মেলেনি, কিন্তু তাঁর কট্টরপন্থী অবস্থান বিষয়ে কোনো রকম ভিন্নমত নেই।
গুজরাট দাঙ্গায় সংশ্লিষ্টতাঁর অভিযোগ থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ২০০৫ সালে নরেন্দ্র মোদির ভিসা বাতিল করে দেওয়ার কারণে অনেকেই ভাবেন যে এখন মোদি সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কী দঁাড়াবে। কোনো অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে কি না। যদিও এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসন নিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে, কেননা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির ভিসার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকতাঁমাত্র। মোদি তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া এই ব্যবস্থা কতটা মনে রাখবেন, সেটা অবশ্যই ভিন্ন প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠছে তাঁর আরেকটি কারণ হলো, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এই দুই দেশের মধ্যে একধরনের প্রকাশ্য টানাপোড়েন চলছে। নিউইয়র্কে একজন ভারতীয় কূটনীতিককে গ্রেপ্তাতাঁরের মধ্য দিয়ে বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা থেকে বোঝা যায় যে আসন্ন নির্বাচনের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দিয়ে সরকার প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু তাঁতে এটাও স্পষ্ট হয় যে এটার পেছনে অনেক দিন ধরে অপ্রকাশ্য টানাপোড়েন চলছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে মতপার্থক্য গত বছর গ্রীষ্মকাল থেকেই জানা যায়। তদুপরি মার্কিন ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে ভারত পেটেন্ট আইন এবং আন্তর্জাতিক ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস বা মেধাসম্পত্তি অধিকার ভঙ্গ করে চলেছে। ভারতের ওষুধশিল্পের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বড় অভিযোগ মার্কিন ব্যবসায়ীদের। একসময় ভারতকে প্রায়োরিটি ফরেন কান্ট্রি হিসেবে তাঁলিকাভুক্ত করার জন্যও মার্কিন শিল্প উৎপাদকেরা দাবি তুলেছিলেন; এই তাঁলিকাভুক্ত হলে ভারতের কোনো কোনো শিল্পের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সম্ভব হবে। এগুলো ছাড়াও ভারতের সঙ্গে ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক সহযোগিতাঁ চুক্তির বাস্তবায়নে ওবামা প্রশাসন খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। কয়েক বছর ধরেই দুই দেশের সম্পর্কে যে শীতলতাঁ লক্ষ করা গেছে, তাঁই অনেকের মনে প্রশ্ন, এখন তাঁর কোনো ধরনের বদল ঘটবে কি না। অনেকের আশঙ্কা যে মোদি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতীত আপত্তির কারণে অবস্থার আরও অবনতি হবে কি না।

এই রকম প্রশ্নের কারণেই নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওবামা প্রশাসন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে নির্বাচনে যিনিই বিজয়ী হন না কেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সঙ্গেই কাজ করবে। এটি একার্থে মোদির ব্যাপারে তাঁদের অনাপত্তির ইঙ্গিত। কিন্তু এই ইঙ্গিত থেকে এটা মনে করার কোনো অবকাশ নেই যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অচিরেই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে। কেননা, দুই পক্ষই দেখতে চাইবে যে অন্য পক্ষ কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে মধ্য মেয়াদে দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনাই বেশি। তাঁর অন্যতম কারণ হলো, এই মোদি দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিজয়ী হয়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারত পদক্ষেপ নিলে তাঁতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থেই এই বিষয়ে আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয়।
পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে বিজেপি ‘লুক ইস্ট’ বা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ামুখী নীতির কথা আগেও বলেছে এবং তাঁদের অতীত সরকারগুলো সেভাবেই খানিকটা হলেও অগ্রসর হয়েছে। তাঁতে করে জাপান, সিঙ্গাপুরসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতাঁ বাড়বে বলেও ধরে নেওয়া যায়। যেহেতু এই দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, তাঁর একটা পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। তাঁ ছাড়া, বিজেপি ক্ষমতাঁয় এলে প্রতিরক্ষা বাহিনী বা কনভেনশনাল মিলিটারির আধুনিকায়নের দিকে মনোযোগ দেবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেখানে একটা সহযোগিতাঁর সম্পর্কের সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সব মধ্যমেয়ািদ সম্পর্কের উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকলেও স্বল্প মেয়াদেই কতগুলো বিষয় রয়েছে, যা এই সম্পর্কের গতিপথের ইঙ্গিত দিতে পারে। তাঁর অন্যতম হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া এবং সেখানে দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য আছে। আফগানিস্তাতাঁন থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর ভারতের ভূমিকা কী হবে এবং পাকিস্তাতাঁনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবস্থা কী দঁাড়াবে, তাঁর প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ওপরে।
মোদি সরকারের জন্য পাকিস্তাতাঁনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর দল এবং তাঁর দলের মূল ভিত্তি যঁারা, তাঁরা নরেন্দ্র মোদিকে এই বিষয়ে কতটা ছাড় দিতে রাজি হবেন, সেটা দেখার বিষয়। পাকিস্তাতাঁনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্ন যেমন মোদি সরকার অবজ্ঞা করতে পারবে না, তেমনি এই বিষয়ে বেশি উৎসাহ দেখানোর চেষ্টা করলে দলের এবং তাঁর মূল সমর্থকদের কাছে চাপে পড়তে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে উষ্ণতাঁ আসবে না। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও এটা একই রকম সত্য যে ভারতকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো রকম পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এশিয়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঝেঁাক তৈরি হয়েছে, সেখানে ভারতের সঙ্গে যেমন আছে প্রতিদ্বিন্দ্বতাঁ, তেমনি দরকার সহযোগিতাঁর। দ্বিপক্ষীয় এই প্রয়োজনের তাঁগিদের প্রেক্ষাপটে কে প্রথম পদক্ষেপ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.