কফিনে করে ফিরছে বাংলার বীরেরা by ফারুক ওয়াসিফ

‘তাজা হাওয়া বয়/ খুঁজিয়া দেশের ভুঁই,/ ও মোর বিদেশি যাদু/ কোথায় রহিলি তুই৷’
পোড়োজমি, টি এস এলিয়ট

নাটকের বাঁ আড্ডার সংলাপে ওদের ‘ফকিরের পুত’ বলবেন না৷ সৌদি আরব থেকে কফিনে করে যারা ফিরছে, তারা আমাদের বীর৷ তাদের অভিবাঁদন জানানো জাতীয় কর্তব্য৷ এ রকম ছয় বছরে ফিরেছে ১৪ হাজার জন৷ দলে দলে তারা জীবনযুদ্ধে প্রবাঁস যায়৷ দলে দলে লাশ হয়ে ফেরে৷ এ দফায় এক দলে ফিরছে নয়জন৷ সবাঁই ‘মেড ইন বাঁলাদেশ’—তাজরীন আর রানা প্লাজার শ্রমিকদের মতো৷ বাঁলাদেশ বিদেশে কফিন রপ্তানি শুরু করেছে৷ ওই ১৪ হাজার শ্রমিকের জন্য ১৪ হাজার কফিন রপ্তানি করতে পারলে বেশ ব্যবসা হতো৷ আরব দেশে কফিন বেচার বুদ্ধিটা সরকাঁর ভেবে দেখতে পারে৷

আরব ভূমি ইসলামের পবিত্রতম স্থান৷ সেখানে মৃত্যুবরণ করাকে অনেকে সৌভাগ্য মনে করেন৷ সেই পবিত্র দেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের লাশ আসে; প্রায় ৩০ শতাংশ৷ আরব ভূমিতে প্রবাঁসী শ্রমিকদের অপমৃত্যুতে নির্বিকাঁর থেকে বাঁলাদেশের সরকাঁর যে সোয়াবের কাঁজ করছে, তাতে সন্দেহ নেই৷ প্রবাঁসীকল্যাণমন্ত্রীকে একই সঙ্গে ডলার ও সোয়াব হাসিলের ব্যবস্থা করার জন্য পুরস্কৃত করা যেতে পারে৷ যে কাঁফালা প্রথার কাঁরণে স্বাবাঁধীন দেশের নাগরিকেরা আরব দেশগুলোতে একধরনের দাসত্বের শিকলে মালিকের কাঁছে বাঁধা পড়ে, তার জন্যও আমরা গর্বিত৷ মহান সৌদি শেখদের খেদমত করার ভাগ্য কি আর সবাঁর হয়? প্রধানমন্ত্রী একদা গর্ব করে বলেছিলেন, জনসংখ্যা সম্পদ, বোঝা নয়৷ প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেননি যে, গরিবেরা যদি সম্পদ হয়, তাহলে কি ধনীরা দেশের বোঝা?
ঠিকই তো, জনগণকে সংখ্যায় বেশি এবং সম্পদে দরিদ্র করে রাখার সুবাঁদেই তো বাঁলাদেশ এখন বিশ্বের বৃহত্তম সস্তা শ্রমের আড়ত৷ দেশের পোশাকশিল্পে বাঁ বিদেশের শ্রমশিবিরে তাদের সস্তায় বেচে দিতে হলে তো দাসের জোগান বাঁড়াতেই হবে৷ দাসশ্রমের জোরেই ইউরোপ-আমেরিকাঁ বিশ্বজয়ী সভ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছে৷ প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রের মতো দাসসভ্যতা বাঁনিয়ে ফেলতে বাঁলাদেশেরও আর দেরি নেই৷
সরকাঁরি হিসাবে ছয় বছরে ১৪ হাজার, মানে প্রতিদিন দুজনেরও বেশি বাঁলাদেশি শ্রমিক প্রবাঁসে কর্মস্থলে মারা পড়ছে৷ প্রথম আলোতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি এই খবর বেরোলে প্রবাঁসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকাঁর মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, তুলনায় এর থেকে বেশি মানুষ নাকি দেশেই মারা যায়৷ সেকাঁলে দুর্বল, বিমারি, শারীরিক খুঁতওয়ালা দাসদের দাম ছিল না৷ একাঁলেও বিদেশে পাঠানোর আগে আমাদের যুবকদের সব রকম স্বাবাঁস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়৷ তার মানে দেশের সেরা স্বাবাঁস্থ্যবাঁনেরাই উন্নত ‘মানবযন্ত্র’ হিসেবে রপ্তানি হয়৷ দেশে এত রোগ-বিমারি থাকাঁর পরও গড় আয়ু ৭০ দশমিক ৩৬ বছর৷ অন্যদিকে, প্রবাঁসী-মৃতদের গড় বয়স ছিল ৩৮ বছর৷ হাড়ভাঙা খাটুনি, মরুভূমির উত্তাপ আর অমানবিক জীবনে দ্রুতই তাদের আয়ু ফুরায়৷ কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে৷ অবশ্য বেশির ভাগই অকাঁলে বুড়িয়ে যায়৷ মুজিব পরদেশীর ‘আমি বন্দী কাঁরাগারে...’ গানটি একসময় প্রবাঁসীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল এ জন্যই৷ ওরা যতই মারা যায়, বুড়িয়ে যায়, যৌবন হারায়, স্ত্রী-সন্তানের থেকে দূরে বিদেশবিভুঁইয়ে পরাধীন জীবন কাঁটায়, ততই দেশে ডলারের পাহাড় উঁচু হয়৷ এই ডলার দিয়ে তখন সরকাঁর বিলাস দ্রব্য, অস্ত্র, গাড়ি ইত্যাদি আমদানি করে৷ এই ডলারই আবাঁর দুর্নীতির সুড়ঙ্গ দিয়ে বিদেশে পাচার হয়৷ ধনীরা এই ডলার দিয়েই অস্ট্রেলিয়া-কাঁনাডার নাগরিকত্ব কেনে, সেখানকাঁর বেগমপাড়ায় সাহেবি আরাম কেনে৷ উচ্চশিক্ষিতরা যেখানে দেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসা, শিক্ষা, বেড়ানো, ফুর্তি ও জীবন কেনার জন্য সম্পদ সরায়, সেখানে শ্রমিকেরা জীবন পানি করে দেশের সম্পদ বাঁড়ায়৷ তারা আছে বলেই তো আমরা আছি, তাই না?
একটি গবেষণা সংস্থার অনুসন্ধানে দেখেছি, প্রবাঁসী শ্রমিকেরা কীভাবে দেশটাকে টেনে তুলছে৷ তাদের টাকাঁয় ভর করে গ্রামে কর্মসংস্থান হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ছে৷ এমন শ্রমিকের সংখ্যা কম নয়, যারা ১০ বছরে এলাকাঁর আরও শত শত শ্রমিককে বিদেশে কাঁজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ গ্রাম-মফস্বলে মাছের খামার, ক্ষুদ্রশিল্প বিকাঁশের প্রধান নায়ক তারাই৷ গ্রাম থেকে উদ্বৃত্ত পুঁজি কিছুটা ঢাকাঁয়, কিছুটা বিদেশে চলে যায়৷ প্রবাঁসী শ্রমিকের পাঠানো টাকাঁই একমাত্র, যা গ্রামে ফেরে৷ শিক্ষা ও স্বাবাঁস্থ্যে যে উন্নতির জন্য সরকাঁর ও এনজিওগুলো গর্ব করে, তাতেও এই শ্রমিকদের অবদান৷ স্ত্রীদের কাঁছে টাকাঁ পাঠিয়ে তারা গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটায়৷ অনেককেই দেখেছি এলাকাঁয় ক্লিনিক, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা গড়তে৷ এত বিপর্যয়ের পরও দেশটা টিকে আছে তাদের অবদানেই৷ এই সত্য অস্বীকাঁর করা হবে জাতীয় বেইমানি৷
ইরাক যুদ্ধের সাত বছরে নিহত হয়েছে চার হাজার ২৭৪ জন মার্কিন সেনা৷ তাতেই কী কাঁপন মার্কিন সমাজে! আর কী অনড়-অকম্পিত আমাদের কর্তা মহাশয়েরা৷ মাছের মায়ের নাকি পুত্রশোক থাকতে নেই৷ মাছপ্রিয় বঙ্গের ভ্রাতারা তাই কাঁদেনওনি, নড়েনওনি৷ ওই লাশগুলো তাই অনাদরে নেমেছে বিমান থেকে, অনাদরেই রওনা হয়েছে নিজ নিজ গ্রামের মেঠো পথে৷ সদ্যমৃত, তাজরীন ফ্যাশনসের শ্রমিকদের মতো পুড়ে অঙ্গার হওয়া সৌদি-ফেরতেরাও অলক্ষ্যেই ফিরে যাবে জন্মের ঠিকাঁনায়৷ এ দেশে সব মৃত্যু সমান নয়৷ তাই বলে কাঁরও কাঁন্না লোনা আর কাঁরও কাঁন্না কষা, তা তো নয়!
পোশাকশিল্পে কাঁজ করে আমাদের সময়ের নারী-বীরেরা আর প্রবাঁসে আছে আমাদের পুরুষ-বীরের দল৷ কিন্তু কে তা মানে? এক বিলেতপ্রবাঁসী উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকের বক্তৃতা শুনছিলাম৷ তিনি প্রবাঁসী শ্রমিকদের চালচলন নিয়ে খুবই শরমিন্দা৷ কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললেন, তারা যেভাবে বড় বড় গাট্টি-বেঁাচকাঁ, শুঁটকি-আচার নিয়ে বিমানে ওঠে, তাতে দেশের সম্মানহানি হয়৷ তাদের ‘ডিগনিটি’ তথা আত্মমর্যাদাবোধের অভাব দেখে তিনি হতাশ৷ তাদের আঞ্চলিক ভাষা তঁাকে পীড়িত করে৷ যাত্রাবিরতিতে তাদের বিদেশি বিমানবন্দরের মেঝেতে ঘুমাতে হয়, আর তঁার মতো ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী বিমান কোম্পানির টাকাঁয় থাকেন পঁাচতারা হোটেলে৷ সত্যিই লজ্জা হওয়া উচিত৷ তবে শ্রমিকদের নয়, লজ্জাটা হওয়া উচিত এই সব ডিগনিটিওয়ালার৷ তঁাদের অনেকের চেয়ে ওই সব শ্রমিকের অবদান অনেক অনেক গুণ বেশি৷
সবাঁই না হলেও তঁাদের অনেকেই বিদেশের নাগরিক হতে পেরে গর্বিত হন৷ অথচ কৃষকের সন্তান এই সব শ্রমিক তাদের আঞ্চলিক বুলি, তাদের আচার-শুঁটকি, বুকের মধ্যে দেশের টান, টিভিতে দেশের চ্যানেল দেখার আকুলতা নিয়ে বাঁলাদেশটাকেই আসলে সাংস্কৃতিকভাবে বাঁচিয়ে রাখে৷ তারা একসঙ্গে ভাত রান্না করে যখন খেতে খেতে গল্প করে, তখন বিদেশবিভুঁইয়ে একচিলতে বাঁলাদেশের জন্ম হয়৷ তাদের এই দেশাত্মবোধ বাঁলা নামের এই দেশটার জন্য বিরাট সাংস্কৃতিক অবদান৷
দেশবাঁসীকে ভাবতে হবে, যাদের নুন খাই, তাদের গান গাইব কি না৷ বিদেশে থাকলেও তারা এই বাঁলাদেশের সম্মানিত নাগরিক৷ তাদের অধিকাঁর রক্ষা হচ্ছে কি না, অমানবিক পরিবেশে কাঁজ করতে বাঁধ্য হচ্ছে কি না, পাসপোর্ট আটকে মালিক তাদের জিম্মি করছে কি না, রিক্রুটিং এজেন্ট তাদের ঠকাঁচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব তাদের রাষ্ট্রের৷ ভারত-নেপাল-পাকিস্তান-ফিলিপাইন-ভিয়েতনামের মতো শ্রম রপ্তানি করা দেশের সঙ্গে জোট বেঁধে আরব বিশ্বে প্রচলিত কাঁফালাপ্রথা বাঁতিলে সরকাঁরকে কোমরকষে নামতে হবে৷ দায়িত্বরত অবস্থায় বাঁ বিদেশে মৃত্যু হলে তাদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে হবে৷ ইউরোপের ভবিষ্যতে তিন কোটি অভিবাঁসীর প্রয়োজন হবে৷ সৌদি আরব-ওমান-বাঁহরাইনের মোট শ্রমশক্তির ৫০-৭০ শতাংশই হলো বিদেশি শ্রমিক৷ সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাঁতার ও কুয়েতে এই হার প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ৷ আমাদের ছাড়া এদের চলবে না৷ শ্রম রপ্তানিকাঁরক দেশগুলো একজোট হলে এরা বাঁধ্য হবে শ্রমিকদের অধিকাঁর দিতে৷
প্রায় কোটি খানেক বাঁলাদেশি বিদেশে থাকে৷ তাদের অধিকাঁশ সবচেয়ে সফল ও দক্ষ শ্রমজীবী৷ শ্রমজীবী বলেই তারা শ্রমের কষ্ট বোঝে, প্রবাঁসী বলেই তারা দেশের মায়ায় কাঁদে৷ তারা দুর্নীতি করে না, অচেনা দেশে অচেনা ভাষা ও পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ে তারা যে যোগ্যতা অর্জন করেছে, সঠিক পরিকল্পনা নিলে তা আমাদের বন্ধ্যা সমাজে বিরাট প্রাণসঞ্চার করতে পারে৷

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাঁদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.