মোদি-ডকট্রিন ও প্রধানমন্ত্রীর ভুল সংকেত by মিজানুর রহমান খান

ভারতে পালাবদল মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি দোষারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যকে সময়োপযোগী বা সমীচীন বলা যাবে না৷ এতে কোনো কূলই রক্ষা পাবে না৷ একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে ‘ভয়ানক ভুল’ বলেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী প্রকারান্তরে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন৷ অনেেকর মতে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার ব্যাপারে মমতাকে দায়ী করা আসলে দিল্লির অপারগতা কিংবা অজুহাত৷ মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর থেকেই মমতা আলোচনায়৷ শেখ হাসিনা নীরবতা ভাঙলেন এমন একটি সময়ে, যখন অবৈধ বাংলাদেশি ইস্যুতে মোদির অন্যায্য মন্তব্যের (‘১৬ মের পরে অবৈধ বাংলাদেিশদের বহিষ্কার করা হবে’) বিরুদ্ধে মমতাই সবচেয়ে বেশি জোরালো অবস্থান নিয়েছেন৷ যদিও ২০০৫ সালে আমরা এই মমতাকেই একই মনোভাব নিয়ে লোকসভায় স্পিকারের মুখের ওপর ফাইল ছুড়তে দেখেছি৷

অনেকেই মনে করেন, দিল্লির ঢাকানীতি বদলাবে না৷ দরকষাকষি আরও জটিল হতে পারে৷ জি নিউজ গতকাল খবর দিল, লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজ যিনি মোদির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থিতার বিরোধী, তিনি বিদেশমন্ত্রী হতে পারেন৷ মনমোহনের ঢাকা সফরে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন৷ সিঙ্গাপুরে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর খুব ভালো, মমতাকে সঙ্গে রাখতে পারলে বেশ হতো৷ পিটিআইয়ের খবর (১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১) পড়ে মনে হেলা, সুষমা তিস্তা চুক্তিবিরোধী নন৷ কংগ্রেস নেতারা মমতাকে বোঝাতে পারেননি৷ তাঁর কথায়, ‘ওঁর সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি ছিল৷ অগত্যা প্রধানমন্ত্রী তিস্তা চুক্তি পাশে সরিয়ে রেখেছেন৷ তবে এটাই শেষ নয়৷’ আমরাও অনুমান করি, মমতার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগের হয়তো ঘাটতি ছিল৷ পিশ্চমবঙ্গের বাজেটসহ নানা বিষয়ে মমতার সঙ্গে দিল্লির টানাপোড়েন গোপনীয় কিছু নয়৷ মমতা এবারের নির্বাচনী বক্তৃতায় ইঙ্গিত দেন, রাজ্যের স্বার্থ বাঁচিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে তাঁর আপত্তি নেই৷ কিন্তু কংগ্রেস যা পারেনি, তা বিজেপি বা নতুন সরকারকে দিয়ে করাতে বাংলাদেশকে উপযুক্ত কর্মপন্থা উদ্ভাবন করতে হবে৷ এ জন্য সরকার, প্রধান দলগুলোর গবেষণামূলক প্রস্তুতি চাই৷
গুজরাল-ডকট্রিন ছিল, ভারত প্রতিবেশীকে ন্যায্যতার সঙ্গে দেবে৷ বিনিময় আশা করবে না৷ বাংলাদেশের মানুষ গুজরাল-ডকট্রিন গ্রহণ করেছিল৷ এটা কৌতূহেলাদ্দীপক, বিজেপির ইশতেহারে কংগ্রেসকে সমালোচনা করা হয়েছে নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য৷ কিন্তু সীমান্ত চুক্তি নিয়ে বিজেপি অহেতুক বিরোধিতা করেছিল৷ সুষমা স্বরাজ দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় না নিয়ে কংগ্রেস সীমান্ত চুক্তি করেছে৷ তাই ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ ছাড়াই বলছি, আমরা বিল মানব না৷ বিল না আনতেও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি৷ তিনিই তথ্য দেন যে, কংগ্রেস তাকে বলেছে, বিল আনা হবে, আলোচনা হবে না৷ তাই হয়েছে৷ সুষমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী হবে৷ তখনো যদি বিরোিধতা করেন, তাহলে আন্তজ৴াতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? তাঁর উত্তর ছিল: ক্ষমতায় এলেও আমাদের অবস্থান বদলাবে না৷ কেন? ওঁর উত্তর: বাংলাদেশকে ১০ হাজার একর জমি ছাড়তে হবে৷ এর সঙ্গে অাবেগ জড়িত৷ অথচ সরকার যেনতেনভাবে চুক্তি করেছে৷’ (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৪ আগস্ট, ২০১৩)৷ এই মনোভাব যে তাঁর একার নয়, সেটাই বড় বিপদ৷ কারণ তিনি তথ্য দেন যে, এসব বিষয় মনমোহনকে অবহিত করার সময় তাঁর সঙ্গে রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা অরুণ জেটলি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এল কে আদভানি, বিজেপি সভাপতি রজনাথ সিং উপস্থিত ছিলেন৷ এটা তাঁদেরও মত৷ এঁরা প্রত্যেকে বিজেপি সরকারে মস্ত প্রভাব রাখবেন৷ জেটলি বিদেশমন্ত্রী হতে পারেন৷ তিনি কুলদীপ নায়ার পরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ৷ এখন তাই সুষমা স্বরাজদের বোঝাতে হবে৷ ইতিহাসের খেরো খাতা খুলুন৷ দেখবেন, এটা যেনতেন চুক্তি নয়৷ ওই ১০ হাজার একর জমি পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে ছেড়ে গিয়েছিলেন নেহরু৷ আটান্নর নুন-নেহরু চুক্তিতে তাই লেখা আছে৷
বিজেপির ইশতেহারে আছে, ‘বৃহৎ শক্তির স্বার্থ’ থেকে ভারত তফাতে থাকবে৷ নিকট প্রতিবেশী ও তার বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে ভারত তার নিজস্ব শর্তে কুটুম্বিতা করবে৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে দিল্লির যে বৈপরীত্য, তা বজায় থাকবে কি? মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদি একটি সক্রিয় বাণিজ্য কূটনীতি চালিয়েছিলেন৷ চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন বিশেষ সম্পর্ক৷ সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, সাউথ ব্লকই ভারত চালায়৷ আমলারা স্থায়ী, নির্ভরযোগ্য৷ বাদবাকি অনিশ্চিত, পরিবর্তনশীল৷ মোদি বািণজ্য বাতাবরণের বাইরে এসে রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে আমলাদের কতটা কি সামাল দিতে পারেন, সেটা দেখার জন্য অনেকেই ব্যগ্র থাকবেন৷
প্রতিবেশীদের জন্য মোদি-ডকট্রিন এখনো অগ্রন্থিত৷ জাপানি সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাট–এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রবন্ধ ‘মোদি–ডকট্রিন’ কথাটি ব্যবহারে উৎসাহিত করেছে৷ মোদি চান, রাজ্যগুলো বিদেশনীতি বিষয়ে বড় ভূমিকা রাখুক৷ হোক তারা বিদেশনীতির অংশীদার৷ অভিন্ন সীমান্ত ও সংস্কৃতি থাকার কারণে যেসব দেশের সঙ্গে যে রাজ্যগুলোর যেমন বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, তাদেরকে তেমনই ভূমিকা রাখতে দেওয়া হবে৷ ভারতের ৩০ রাজ্য ৩০ অংশীদার-দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে৷ এর মানে বাংলাদেশকে ঘিরে যেসব রাজ্য রয়েছে, তার মুখ্যমন্ত্রীরাই দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক নিরূপণে নিয়ামক হবেন৷ সুতরাং, তাত্ত্বিক বিচারে মমতার বিশেষ ভূমিকাকে অস্বীকার করা চলে না৷
শেখ হাসিনা সরকারের যদি এ কথা জানা থাকত, তাহলে মমতার ভূমিকাকে এখন দূর্ভাগ্যজনক বলতেন না৷ বিশেষ করে একটি ক্রান্তিকালে, যখন মমতা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছেন, মোদির কঠোর সমালোচনা করে মমতা যখন বলেছেন, একদা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভারতে এসেছিল৷ কাউকে পাঠাতে হলে আমাকে আগে পাঠাতে হবে৷ মোদির বাংলাদেশ–সংক্রান্ত মন্তব্যেও শেখ হাসিনা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন৷ যদিও প্রকাশ্যে নয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সভার বরাত দিয়ে ৬ মে ভারতের ইকোনমিক টাইমস খবরটি ছেপেছে৷ শেখ হাসিনা বলেছেন, এ ধরনের মন্তব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ভূমিকা রাখবে না, বরং তা ভারতের ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পর্ক নস্যাৎ করতে পারে৷
চীন কী দেখাল? গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চীনের সরকারি মুখপাত্র বললেন, ২২ ফেব্রুয়ারি অরুণাচল প্রদেশে (চীনের মতে দক্ষিণ তিব্বত) গিয়ে মোদি চীনবিরোধী যা বলেছেন, তা তঁারা গায়ে মাখবেন না৷ চীনকে ‘সাম্রাজ্যবিরোধী মাইন্ডসেট’ বদলাতে বলেছিলেন মোদি৷ চীন তার ওপর চটেনি৷ কারণ হয়তো মোদির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ, বোঝাপড়া৷ বাংলাদেশ নেতাদের যেখানে বিরাট ঘাটতি৷ বেগম খালেদা জিয়া দিল্লিতে গিয়ে সুষমার বাড়িতে গেলেন৷ কিন্তু সেই সূত্রে বিএনপির কোনো আঞ্চলিক নেতা বিজেপির কোনো আঞ্চলিক নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবতেও পারেন না৷ সাংস্কৃতিক দৈন্য এখনো এতটাই প্রকট৷ গুজরাটে বিনিয়োগ টানতে মোদি অন্তত চারবার চীেন গেছেন৷
১৯৯০ সালে মার্কিন বিশেষজ্ঞ জন কিংকেড স্থানীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলো বিদেশ বাণিজ্যনীতিতে কী ভূমিকা রাখতে পারে, তার রূপরেখা দিয়েছিলেন৷ একে বলেছিলেন প্যারা-ডিপ্লোমেসি৷ এর সারকথা হলো, স্থানীয় সরকারগুলো তার বাণিজ্য বিবেচনায় বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবে৷ আমাদের শাসকেরা অবশ্য ঠিক করেছেন, দুনিয়া যেখানে যায় যাক৷ আমরা উটপাখি হয়েই থাকব৷ ভারতীয় বিশেষজ্ঞ তানভি রত্ন এর আগে ক্যাপিটাল হিল ও সাউথ ব্লকে কাজ করেছেন৷ দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ তিনি লিখেছেন, প্যারা-ডিপ্লোমেসি সমগ্র বিশ্বে একটি স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনে পরিণত হয়েছে৷ এটাই মোদি–ডকট্রিন৷
আমরা ইউনিটারি দেশ বলে এসব ভাবব না, তাতে পোষাবে না৷ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম, স্পেন, চীন ও ইউনিটারি দেশ জাপানও প্যারা-ডিপ্লোমেসি অনুসরণ করছে৷ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রত্যেকের সাফল্যই ঈর্ষণীয়৷ কুইবেক ও ব্রিটিশ কলাম্বিয়াকে ‘সার্বভৌম’ অর্থনৈতিক কূটনীতি অনুসরণে কানাডার সংবিধান ক্ষমতা দিয়েছে৷ সাওপাওলো যে ব্রাজিলের নগর, তা বিশ্ব ভুলেছে৷ সাওপাওলোর ২৬টি সরকারি দপ্তরের সঙ্গে বিদেিশ রাষ্ট্রগুলোর স্বতন্ত্র অংশীদারি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তো আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যন্ত গড়েছে৷ আমরা ঠিক করেছি, মুঠো আলগা করব না৷ স্থানীয় সরকার আবার কী৷
মোদি ৩০ রাজ্যের লেন্স দিয়ে ৩০ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা অলীক নয়৷ বাংলাদেশ এসব জানবে না, কিছুই ভাববে না, তা হয় না৷ সীমান্ত হাট চলছে৷ কিন্তু রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রী, নেতাদের সঙ্গে আমাদের আঞ্চলিক নেতাদের ওঠাবসা, মুখ দেখাদেখি নেই৷ অথচ সেদিন বেশি দূরে নয়, আঞ্চলিক দল ও নেতারা সাউথ ব্লককে বাগে আনবেনই৷ মোদি–ডকট্রিন ভিন্ন অাঙ্গিকে প্রিতবেশীদের জীবনে ছাপ ফেলবে৷ মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে মনমোহনের ঢাকা সফরেও সেই বার্তা ছিল স্পষ্ট৷

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.