গুম, খুন রোধ: কিছু করণীয় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

দেশজুড়ে এখন একটাই আলোচনা, নারায়ণগঞ্জের গুম ও খুন। বিশেষ করে, র্যাবের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় এই আলোচনা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে, প্রকৃত অপরাধী ও তাদের সহযোগী কারা। অনেকে বলেন, ‘সরকারই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সরকারের প্রশ্রয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সরকার চাইলে আজই সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারে ইত্যাদি।’ এ ধারণাগুলো সত্য না অসত্য, তা বলা কঠিন। কিন্তু এটা ঠিক যে সমাজের বহু লোক বিশ্বাস করেন, সরকারের প্রশ্রয়ে এ ধরনের ঘটনা (গুম, খুন) ঘটে চলেছে। সরকার যদি কোনো রাজনৈতিক কারণে বা সরকারপ্রধানের কারণে প্রকৃত আসামি ধরতে না চায়, তাহলে আমরা অসহায়। কারণ, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধরা, আইনের আশ্রয়ে আনা ও আইনের পথে মামলাকে এগিয়ে নেওয়া—এ সবই সরকারের কাজ। কোনো সংক্ষুব্ধ পরিবার, ব্যক্তি বা সংগঠন চাইলেও এই কাজগুলো করতে পারবে না। এখানেই নাগরিক সমাজ অসহায়।

অনেকে এ রকম গুম, খুন বা অপহরণের ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন। তঁারা বিএনপির শাসনামলের কথা ভুলে যেতে চান। বিএনপি আমলের অপরাধ পরিসংখ্যানগুলো সামনে আনলে দেখা যাবে, কেউ কারও চেয়ে কম নয়। আমাদের বড় দুই দল বা জোটের শাসন প্রত্যাশিত মানের উন্নত ছিল না। অথচ আমরা এতই অসহায় যে এই দুই দল বা জোটের হাতেই আমাদের শাসনভার সমর্পিত। তৃতীয় কোনো দক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ভোটে নির্বাচিত হচ্ছে না।
প্রশ্ন হলো, এই বাস্তবতার মধ্যে গুম, খুন, অপহরণের মাত্রা কমানো বা বন্ধ করা যায় কীভাবে? এ ব্যাপারে মেধাবী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তঁাদের পরামর্শ সরকারকে অবশ্যই দেবেন। একজন উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে আমার কয়েকটি প্রস্তাব। এই সমস্যাকে দুভাবে দেখতে হবে—ক. প্রশাসনিক ও খ. রাজনৈতিক।
ক. প্রশাসনিক : (১) দেশের কোনো নাগরিককে যেকোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার করার আইনি পদ্ধতি কী, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রেপ্তার করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের খবর তার পরিবার বা প্রতিবেশীকে জানানো হবে, গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে সোপর্দ করা হবে, তা-ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকতে হবে। গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ বা র্যাব প্রতিনিধি অভিযুক্তকে পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবেন। সাদাপোশাকের কোনো ব্যক্তি কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন না। পরিচয়পত্র থাকলেও সাদাপোশাকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন না। আইনানুগ গ্রেপ্তারের নিয়মকানুন সব নাগরিকের জানা দরকার। গ্রেপ্তারের ব্যাপারে এর অন্যথা হলে একে ‘অপহরণ’ বা ‘গুম’ বলে বিবেচনা করতে হবে। এবং যারাই তাদের অন্য পদ্ধতিতে ‘গ্রেপ্তার’ করবে, তাদের দোষী সাব্যস্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। আইনি পদ্ধতিতে গ্রেপ্তার না করে ভিন্ন পদ্ধতিতে গ্রেপ্তার করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশপ্রধান ও র্যাবপ্রধান অভিযুক্ত হবেন। তঁাদের শাস্তি পেতে হবে। পুলিশ ও র্যাব নানা অভিযোগে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তবে তা আইনি পদ্ধতিতে হতে হবে। অপহরণের ভঙ্গিতে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সে জন্য গ্রেপ্তারের আইনি পদ্ধতিটি গণমাধ্যমে প্রচার করা প্রয়োজন, যাতে পুলিশ বা র্যাব এর অস্পষ্টতার সুযোগ নিতে না পারে।
(২) কোনো অপরাধের সঙ্গে যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের যুক্ত থাকা প্রমাণিত হয়, তাহলে অপরাধীর শাস্তি প্রচলিত আইনের শাস্তির দ্বিগুণ দেওয়ার জন্য একটি নতুন আইন পাস করা হোক। কারণ, তঁারা সাধারণ অপরাধীর চেয়ে দ্বিগুণ অপরাধ করছেন। তঁাদের দ্বিগুণ শাস্তির কথাও ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়া দরকার।
(৩) পুলিশ, গোয়েন্দা ও র্যাবের একটি চৌকস গ্রুপকে বিদেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে তারা যেকোনো অপরাধী শনাক্ত করার জন্য দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য তাদের নানাভাবে আর্থিক ইনসেনটিভ দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। আমাদের মেনে নিতে হবে, সবাই একই মানের দক্ষ হবে না। কাজেই একটি দক্ষ ও চৌকস গ্রুপ তৈরি করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে এখনই একটি প্রকল্প তৈরি করা দরকার। আমাদের বিদেশি বন্ধুরা নিশ্চয় এ ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা করবে।
(৪) পুলিশ, গোয়েন্দা ও র্যাবের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে তারা অবদান রাখতে পারবে। সামরিক বাহিনীর আগ্রহী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে গোয়েন্দা বিভাগ ও র্যাবে যুক্ত করা যেতে পারে। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরি প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা সরকারের অগ্রাধিকার দাবি করতে পারে না নানা বাস্তবসম্মত কারণে।
(৫) অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘দ্রুত বিচার আইনে’ মামলা হওয়া উচিত। বিলম্বিত বিচারে অনেক দোষী ব্যক্তির শাস্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অনেক অপরাধী এই সুযোগ নিচ্ছে। বিচার বিভাগকে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হতে হবে। ‘কোনো অপরাধীই শাস্তি এড়াতে পারবে না’—সমাজে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
খ. রাজনৈতিক: (১) দেশে যে এত গুম, খুন ও অপহরণ বেড়েছে, তার পেছনে প্রধান কারণ দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, দুর্নীতি ও কালোটাকা। অবিলম্বে এগুলো বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় দুই দলের নীতিনির্ধারকদের একমত হতে হবে যে তঁারা দলে সন্ত্রাসী, খুনি, দাগি আসামি, মাস্তান, গডফাদার, দুর্নীতিবাজ, কালোটাকার মালিক—এদের স্থান দেবেন না। কাজটা খুব কঠিন। তাহলে কী উপায়? এটাই বড় প্রশ্ন। দেশে গুম, খুন, অপহরণ বন্ধ করতে সরকারি দলকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। নিজের দল পরিচ্ছন্ন করতে পারলে অন্য বড় দলটিও তাদের দলের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হবে। দুই বড় দল দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি পরিহার না করলে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে না। কারণ, প্রায় সব গুম, খুন ও অপহরণের নেপথ্যে দূষিত রাজনীতিই দায়ী। এবং বড় দুই দল এই দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকে শুধু প্রশ্রয় দিচ্ছে না, রীতিমতো লালন-পালন করছে। ক্ষমতাসীন দল শুধু ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, দোষী ছাত্রলীগ নেতাদের শাস্তি দিতে পারলে, অন্য দলের ছাত্র-সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। বড় দুই দল যেন দলের ভেতরে গডফাদার, সন্ত্রাসী ও কালোটাকার মালিকদের স্থান না দেয়, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়াকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।
(২) বড় দুই দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। যাতে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দলের ভেতরে একনায়কত্ব ও স্তাবকতার চর্চা থাকলে দলের গণতন্ত্রমনা নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তঁারা মতামত দিতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী বা দলপ্রধান তঁার একক ক্ষমতায় অনেক সিদ্ধান্ত নেন। একক সিদ্ধান্তে ভুল থাকার আশঙ্কা বেশি। দলীয় একনায়কত্ব দল বা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করে। দলপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী কোনো অপরাধীকে বঁাচাতে চাইলে দলের অন্য নেতারা প্রতিবাদ করতে পারেন না। একক ব্যক্তির পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। গণতন্ত্রের শর্তই হলো আলোচনা ও বিতর্ক।
(৩) দল বা সরকারে একনায়কত্ব জন্ম নেয় পরিবারতন্ত্র থেকে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করতে হলে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দল বা সরকার যেন একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবার দ্বারা পরিচালিত না হয়। এ রকম ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বার্থ বা রাগ-অনুরাগ সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে। সরকার বা দল যেন দেশের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কালেক্টিভ সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দল ও সরকারে সে রকম পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের সিনড্রোম যেন বারবার দেশে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। শুধু প্রতিবাদ বা কয়েকজন অপরাধীর শাস্তি হওয়াই যথেষ্ট নয়। অপরাধীই যেন সৃষ্টি না হয়, সেই লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করতে হবে। আমাদের ধারণা, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে অপরাধী সৃষ্টি হওয়ার পথ অনেকটা বন্ধ হতে পারে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী৷

No comments

Powered by Blogger.