‘স্বর্ণভীতি’

সমস্যাটিকে ‘স্বর্ণভীতি’ হিসেবেই উল্লেখ করতে হচ্ছে। কারণ, ভীতিটি স্বর্ণ-সংক্রান্ত, এবং ভয়টি সংক্রমণের। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তা না আবার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে ছড়িয়ে পড়ে! অতএব স্বর্ণ থেকে দূরে থাকো শত হাত! জাতীয় পরিবেশ পদক থেকে এবার নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে সোনাকে। এই সিদ্ধান্ত পরিবেশ পদকবিষয়ক জাতীয় কমিটির, এবং তা ‘সর্বসম্মত’। এবার যাঁরা পরিবেশ পদক পাবেন, তাঁরা কিছুটা দুর্ভাগাই। ‘স্বর্ণপদক’ পাওয়ার তৃপ্তিটি তাঁদের আর হবে না। এবারের পদক মানে টাকা! ক্রেস্ট একটি থাকবে বটে, তবে সেখানে আর যা-ই হোক, সোনা বলে কিছু থাকবে না। ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কমিটির সব সদস্য সোনার মেডেল না দেওয়ার পক্ষে মত দেন। ফলে দুই ভরি সোনার দাম নগদে ও একটি ক্রেস্ট দেওয়া হবে’—পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন এভাবেই। পরিবেশমন্ত্রীর ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির’ বিষয়টি নিশ্চয় অনেক পাঠকই বুঝে গেছেন। যাঁদের ধরতে অসুবিধা হচ্ছে, তাঁদের জন্য পুরোনো খবরটি ধরিয়ে দিচ্ছি; বাংলাদেশ সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের কয়েক পর্যায়ে সম্মাননা জানিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠান করে তাঁদের ক্রেস্ট দেওয়া হয়েছে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে শুরুতে আমরা জানলাম, এই ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে। পরে বের হলো, ১৬ আনাই মিছে। মানে, এখানে সোনা বলে কিছু নেই। এসব নিয়ে তদন্ত হয়েছে এবং জানা গেছে, এর মাধ্যমে সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। তদন্ত কমিটি এ জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী,
সাবেক সচিব ও বর্তমান সচিবকে দায়ী করেছে। এটাই হচ্ছে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির’ সংক্ষিপ্ত বয়ান। ফলে ‘স্বর্ণ’ বা এ ধরনের কিছুর ধারেকাছেও যেতে চায়নি পরিবেশ মন্ত্রণালয়। তবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এই ‘স্বর্ণভীতি’ যে ‘বঞ্চিত’ করবে অনেককেই! যাঁরা পদক পাবেন, তাঁরা বড় মুখ করে বলতে পারবেন না যে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে ‘স্বর্ণপদক’ পেয়েছেন। বঞ্চিত হবেন স্বর্ণপদক সরবরাহ করে, এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা পরিবেশমন্ত্রীর যদি কোনো ঠিকাদার ভাগিনা থেকে থাকেন, তিনি (কারণ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ক্রেস্ট সরবরাহের ঠিকাদারির কাজটি যে দুজন পেয়েছিলেন, তঁাদের একজন প্রতিমন্ত্রীর ভাগিনা)। টাকা সরবরাহ করার জন্য তো আর কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া যাবে না। সোনা ছাড়া যে ক্রেস্ট বানানো হবে, তার ১৬ আনা মিছে করার সুযোগও তো থাকছে না! বড় বেশি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ পদকবিষয়ক জাতীয় কমিটি। পরিবেশ মন্ত্রণালয় যদি আগের রীতি অনুযায়ী স্বর্ণপদক দেওয়াতেই স্থির থাকত, তবে কী এমন ক্ষতি হতো! পরিবেশ পদক দেশের লোকজন পায়৷ যাঁরা পদক পাবেন, তাঁরা বাংলাদেশের বাস্তবতা জানেন। ১৬ আনা মিছে হলেও তাঁরা খুব অবাক হতেন না৷ তাঁদের কেউ পদকপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানে কষ্টিপাথর নিয়ে আসবেন বলেও মনে হয় না! অনুষ্ঠান পার হয়ে গেলেই তো হলো। এখানে বিদেশি বন্ধুদের কাছে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ারও কোনো ব্যাপার নেই। ফলে পরিবেশ পদক যদি ১২ বা ১৬ আনা মিছেও হতো, তাতেও তদন্ত কমিটি করার জন্য খুব চাপ হতো বলে মনে হয় না। আর তদন্ত কমিটি গঠন বা কেউ কেউ দোষী সাব্যস্ত হলেই বা কী!
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঘটনায় তদন্ত হয়েছে, দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মন্ত্রী, সচিবেরা। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মুখে শুনলাম, জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ‘প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং অ্যাকশনে যেতে বলেছেন।’ সেই ‘অ্যাকশন’ কবে বা কখন শুরু হবে, তা নিয়ে অবশ্য কোনো মন্তব্য নেই মন্ত্রীর। হয়তো বিপদে পড়বেন কয়েকজন আমলা, কিন্তু অভিযুক্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কী অ্যাকশনে যাবেন বর্তমান মন্ত্রী! সোনার পদক নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভয়টি তো অহেতুকই! আগেই বলেছি, সংক্রমণের ভয় পেয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রোগ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে সংক্রমণের ভয়। পরিষ্কার থাকতে চেয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, এবং তা মাথা কেটে। কারণ, মাথা থাকলেই তো মাথাব্যথা। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ পথ। প্রতিষেধক নেওয়ার মতো জটিল পথ খোঁজার সময়, ধৈর্য বা আন্তরিকতা পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা আমাদের কারোই তো এখন আর নেই!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.