মগের মুল্লুক! by হাসান ফেরদৌস

বাংলাদেশে একসময় মগদের ভীষণ উপদ্রব ছিল৷ সে প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা৷ আরাকান, অর্থাৎ আজকের মিয়ানমার থেকে আসা মগ জলদস্যুরা সে সময় বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ এলাকায় রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব বানিয়ে বসে৷ ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ের সে কথা বর্ণনা করে লুণ্ঠন ও অত্যাচারের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা পড়ে এখনো আমাদের রক্ত হিম হয়ে আসে৷ ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম জয় করার পর মগদের সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান হয়৷ আমাদের আলোচ্য বিষয় অবশ্য সপ্তদশ শতক নয়, আজকের বাংলাদেশ৷ সরকারদলীয় সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি রেগেমেগে অভিযোগ করেছেন, দেশটা একদম মগের মুল্লুক হয়ে উঠেছে৷ নারায়ণগঞ্জের সাত গুম-খুন; থুক্কু, গুম তো বলা যাবে না, বলতে হবে নিখোঁজের ঘটনায় আইন প্রয়োগকারীদের অকর্মণ্যতার দিকে আঙুল তুলে তিনি মন্তব্য করেছেন, মানুষ অভিযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যাচ্ছে, আর তারা বসে বসে হিসাব-নিকাশ করছে কার অভিযোগ নেবে, কারটা নেবে না৷ ‘এটা কি মগের মুল্লুক? এটা আইনের বরখেলাপ৷’

সাবেক এই মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হাফ মন্ত্রীর অদক্ষতার দিকে শর নিক্ষেপ করে বলেছেন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এমন কেউ, যিনি ব্যক্তিত্বশালী, আবার আইন বিষয়েও অভিজ্ঞ, তাঁকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত৷ তেমন ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে এখন আর অবশিষ্ট আছে কি না, সে কথা অবশ্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত খোলাসা করে বলেননি৷ এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের হাতে রেখেছেন৷ তিরটা সেদিকেই গেল কি না, তা-ও বোঝা গেল না৷ তবে আক্কেলমন্দরা বলছেন, প্রাজ্ঞ আইনজীবী সুরঞ্জিত হয়তো প্রকারান্তরে নিজের জন্য চাকরির আবেদনখানা করে রাখলেন৷ তিনি অভিজ্ঞ ও আইনশাস্ত্রে পারদর্শী, এ কথা তো সুবিদিত!
কিন্তু ঠাট্টার কথা নয়; খোদ সরকারের ভেতরের লোকই যখন দেশের অবস্থা মগের মুল্লুকের সঙ্গে তুলনা করেন, তখন ধরে নিই, অবস্থা সত্যিই সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ তবে সবাই যে এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত হবেন, তা-ও নয়৷ সম্প্রতি নিউইয়র্ক ঘুরে গেলেন দুই মন্ত্রী৷ তাঁদের একজন প্রবাসীদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ নাকি ইতিমধ্যে দুবাই হয়ে গেছে৷ তাঁর এ কথার অর্থ কি এই যে দেশের সব মানুষ ইতিমধ্যে ‘কেমন আছেন’ না বলে ‘ক্যায়ফা হালাক’ বলা শুরু করেছে? তা অবশ্য তিনি ভেঙে বলেননি৷ আরেক মন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক সুখে রয়েছে৷ খুব ভালো হয়, মন্ত্রী মহোদয় যদি নারায়ণগঞ্জে যে সাতজন মানুষ গুম-খুন হলেন, তাঁদের পরিবার-পরিজনকে তথ্যটা জানিয়ে আসেন; তাতে হয়তো তাদের শোকের উপশম হবে৷
না, অবস্থা সত্যি খুব খারাপ৷ এতটা খারাপ যে কলাম লেখকদের কেউ কেউ চেঁচিয়ে বলা শুরু করেছেন, রক্তমাখা এই দেশ তাঁদের নয়৷ ‘আমার নয়’ বললেই কিন্তু দেশটা আমার না হয়ে অন্যের হয়ে যায় না৷ দেশ আমাদের একটাই৷ ভালো হোক, মন্দ হোক, তাকে নিয়েই থাকতে হবে৷ আজকের এই অবস্থার দায়ভার তিনি নেবেন না বলে লেখক যদি ‘আমার নয়’ বলে আওয়াজ তোলেন, তাতেও কিন্তু দায়ভার ঘোচে না৷ আজকের যে বাংলাদেশ, তার জন্য কমবেশি আমরা সবাই দায়ী৷ এই অবস্থা যদি গ্রহণযোগ্য না-ই হবে, তাহলে তা মেনে কেমন দিব্যি সংসার করছি, কলাম লিখছি, টক শোতে যাচ্ছি, সপ্তাহান্তে বউ-বাচ্চা নিয়ে চায়নিজ খেতেও ভুলছি না৷
আমি বলতে চাইছি, এ অবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদটা কোথায়? ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আউটরেজ’; কই, আমি তো তার ছিটেফোঁটাও দেখি না৷
এই সরকারের সবচেয়ে বড় যে সাফল্য, তা হলো রাজনৈতিক প্রতিবাদকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া৷ শুধু তাদের সফল রণকৌশল যে এর পেছনে রয়েছে তা নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের অপরিপক্ব ও দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বও তাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে৷ বিরোধী রাজনীতি এখন বড়জোর হাঁটুভাঙা ‘দ’৷ পেশাগত রাজনীতি ব্যর্থ হলে শূন্যতা পূরণ করে সুশীল সমাজ৷ সরকারের লেজুড়বৃত্তি না করে বাংলাদেশে সুশীল সমাজের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব৷ ফলে, তাদের কাছ থেকে আশু দিকনির্দেশনা বা নেতৃত্ব আসবে, সে আশায় গুড়েবালি৷ ছাত্র আন্দোলন বা শ্রমিক আন্দোলন, যারা বরাবর মিছিলের সম্মুখ সারিতে স্থান নিয়েছে, তারা অধিকাংশ এখন টেন্ডার ও পারমিট ভাগাভাগিতে ব্যস্ত৷ বাকি থাকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি৷ বঙ্গবন্ধু একসময় যাদের ‘চাটার দল’ বলতেন, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এখন সানন্দে সেই চাটার দলে নাম লিখিয়েছে৷ ফলে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের ভিখুর পিঠে ওঠা পাচীর মতো আমাদেরও জিজ্ঞেস করতে হয়, ‘আমরা যামু কনে?’
রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন ও তা নির্বাহের ভিত্তিতে থাকে আইনের অনুমোদন ও নাগরিক সমর্থন৷ আইনের ভাষায় প্রথমটিকে বলতে পারি ‘লিগ্যালিটি’, পরেরটিকে ‘লেজিটেমিসি’৷ চলতি সরকারের ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত পূরণ হয়েছে, এ কথা মেনে নিলেও প্রশ্ন জাগে, তার পেছনে নাগরিক সমর্থন রয়েছে তো? দেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপ কার্যত স্থবির৷ ফলে, এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সংগ্রহ করতে হবে দেশের পত্রপত্রিকা থেকে৷ তাদের রায় আমাদের জানা৷ নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষা সরকারের প্রধান দায়িত্ব৷ সুরঞ্জিতের কঠোর বাক্যবাণ থেকে জানা গেল, ক্ষমতাসীন মহলেরও কেউ কেউ এখন মেনে নিচ্ছেন, নিজের দায়িত্ব পালনে এই সরকারের ব্যর্থতার পাল্লাই অধিক ভারী৷
নাগরিক সমর্থন হারিয়ে দেশ চালানো যায় পুলিশি কায়দায়৷ আমরা জানি, সেই চেষ্টা করে এক জেনারেল ‘বিশ্ব বেহায়া’ খেতাব পেয়েছিলেন৷ আমি বিশ্বাস করতে চাই, গণতন্ত্রের জন্য আজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছে যে দল, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা সে পথ অনুসরণ করবে না৷ দেশটা সত্যি সত্যি মগের মুল্লুক হয়ে ওঠার আগে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ বোধ হয় এখনো আছে৷

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.