প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সমন্বয়ের রাজনীতির মহানায়ক by পল স্টবার
‘বিদায়,
জাতির বর্শা’। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন, সেই সব
মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করার সময় দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী এই গানটি গেয়ে থাকে।
নেলসন ম্যান্ডেলাও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যদিও পরবর্তী বছরগুলোয় তাকে
একজন শান্তি প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ
আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনামলে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠী প্রচারণাগুলোয় প্রায় প্রতিটি
বর্ণবাদী আইনেরই বিরোধিতা করা হতো। এসব আইনের আওতায় ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে
বিচ্ছিন্ন করে রাখা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ
পর্যন্ত। তবে মূল দাবিটি ছিল ম্যান্ডেলার মুক্তি- এমনকি যারা ম্যান্ডেলার
দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সমর্থক নন, তারাও এ দাবি তুলতেন।
ম্যান্ডেলা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর ঐক্যের শক্তি।
ম্যান্ডেলা কারারুদ্ধ থাকাকালে তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার জনগণের দাবি বারবার
নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তারা জনগণকে বিভক্ত করে রাখার চেষ্টায়
অনেক সময় সফলও হয়েছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার জন্য
মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি ম্যান্ডেলা একবার আদালতকে বলেছিলেন : ‘আমি লড়াই
করেছি শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এবং আমি লড়াই করেছি কৃষ্ণাঙ্গদের
আধিপত্যের বিরুদ্ধে। আমি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের আদর্শ লালন করি,
যেখানে সব মানুষ সম্প্রীতি ও সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাস করবে। এটি এমন
এক আদর্শ যা আমি অর্জন করা এবং সেখানে বসবাস করার প্রত্যাশা করি। এ আদর্শ
বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আমি মৃত্যুর জন্যও প্রস্তুত আছি।’
এ কথাগুলোই পরবর্তী ৩০ বছর তরুণ দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে ছিল করণীয় নির্দেশনা।
ম্যান্ডেলার ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ থাকায় তরুণ ম্যান্ডেলার ছায়ামূর্তিটি তাদের বর্ণবাদের বিরোধিতায় সাহস যুগিয়েছে এবং এএনসি ও এর সশস্ত্র শাখা উমখন্তোর প্রতি জনসমর্থন সংগঠিত করেছে। ‘ম্যান্ডেলা চান সৈনিক। তিনি আমাদের নেতা, আমরাই তার সৈনিক’- এই স্লোগান তুলে তরুণরা দেশব্যাপী পুলিশকে প্রতিরোধ করেছে। প্রায়ই এসব প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শেষ হয়েছে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, গুলিবর্ষণ, এমনকি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তবে এসব দমনপীড়ন জনগণকে পরবর্তী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন থেকে খুব কমই বিরত রাখতে পেরেছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছে রবেন দ্বীপে বন্দি তাদের নেতার গল্প শুনিয়েছেন। ম্যান্ডেলা তার ২৭ বছরের কারাজীবনের ১৮টি বছর কাটিয়েছেন ওই দ্বীপেই।
গোটা আশির দশকে যখন একজন নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলার ভাবমূর্তি গড়ে উঠছিল, তখন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৯৯০ সালে সরকারের পতন ঘটে।
বন্দি হওয়ার আগে ম্যান্ডেলা বিচক্ষণতার সঙ্গে বছরের পর বছর উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এএনসিকে চালিত করেছেন। হত্যা, গুপ্তহত্যা, ক্ষোভ আর গৃহযুদ্ধের ভয় ছিল। ছিল শুভেচ্ছা, বিচারবুদ্ধি, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও আপসের মনোবৃত্তিও। প্রায়ই ম্যান্ডেলাকে সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়তে হতো তা হল, কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের মনে আলোচনার মাধ্যমে বর্ণবাদ অবসানের প্রতি বিশ্বাস ধরে রাখা। তার মুক্তি ভবিষ্যতের ব্যাপারে জনগণের মনে বড় আশাবাদ জাগিয়ে তোলে। তবে গণতন্ত্রে উত্তরণে অন্তর্বর্তীকালীন সময়টি রাজনৈতিক সহিংসতা ও জনগণের ক্ষোভের কারণে নাজুক হয়ে ওঠায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হুমকির সম্মুখীন হয়।
তরুণ দক্ষিণ আফ্রিকানরা, যারা বর্ণবাদী সরকারের পতনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল, তারা চেয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা নেলসন ম্যান্ডেলাকে। কিন্তু ম্যান্ডেলা পরিণত হন একজন জাতীয় নেতা ও রাষ্ট্রনায়কে। তিনি তার প্রবল রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা সব পক্ষকে একটি বেদনাদায়ক অথচ অপরিহার্য সমঝোতায় রাজি করাতে সক্ষম হন।
‘মাদিবা জাদু’ প্রায় প্রত্যেকের মন জয় করে নেয়। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মন জয় করে নেন। কিছু মতানৈক্য সত্ত্বেও এ কাজে সঙ্গে পান কৃষ্ণাঙ্গদের।
বহু দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর কাছে ম্যান্ডেলার মুক্তি ছিল তাদের স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ। যে দিনটির জন্য তারা দীর্ঘকাল অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু এক সময় তাদের সেই আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছিল। অবশেষে তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়ায় তরুণ-বৃদ্ধ সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। ম্যান্ডেলা মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকের কাছেই জীবন হয়ে উঠেছিল কষ্টদায়ক। কঠিন হয়ে পড়েছিল ক্রমবর্ধমান তিক্ততাপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম এড়িয়ে চলা। কিন্তু তার মুক্তির পর বর্ণবাদের অবসান এবং ‘সবার জন্য একটি উন্নততর জীবন’ গড়ে তোলার সুযোগ উপস্থিত হল জনগণের সামনে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে ছিল- কিভাবে শ্বেতাঙ্গদের ভীতির সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রত্যাশার সমন্বয় হবে। কিন্তু ম্যান্ডেলা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে হাত দিলেন। ম্যান্ডেলা ১৯৯৫ সালের রাগবি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকান দল স্প্রিংবকের পেছনে জাতিকে সমবেত করলেন। এই টুর্নামেন্ট এবং স্প্রিংবকের বিজয় দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীকে একত্রিত করল এবং তাদের দেখিয়ে দিল, একটি জাতি হওয়ার জন্য তাদের অনেক কিছুতেই মিল রয়েছে।
এক মেয়াদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ম্যান্ডেলা দলীয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। দক্ষিণ আফ্রিকা কোনোক্রমেই আদর্শগতভাবে ‘রংধনু রাষ্ট্র’ নয়- যে নামে তাকে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তবে ম্যান্ডেলা জানতেন, দেশটি একজন মাত্র ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারে না- তা তিনি দেশে ও বিশ্বে যত বড় নেতা হিসেবেই বিবেচিত হোন না কেন।
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
পল স্টবার : প্রখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান সাংবাদিক
এ কথাগুলোই পরবর্তী ৩০ বছর তরুণ দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে ছিল করণীয় নির্দেশনা।
ম্যান্ডেলার ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ থাকায় তরুণ ম্যান্ডেলার ছায়ামূর্তিটি তাদের বর্ণবাদের বিরোধিতায় সাহস যুগিয়েছে এবং এএনসি ও এর সশস্ত্র শাখা উমখন্তোর প্রতি জনসমর্থন সংগঠিত করেছে। ‘ম্যান্ডেলা চান সৈনিক। তিনি আমাদের নেতা, আমরাই তার সৈনিক’- এই স্লোগান তুলে তরুণরা দেশব্যাপী পুলিশকে প্রতিরোধ করেছে। প্রায়ই এসব প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শেষ হয়েছে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, গুলিবর্ষণ, এমনকি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তবে এসব দমনপীড়ন জনগণকে পরবর্তী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন থেকে খুব কমই বিরত রাখতে পেরেছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছে রবেন দ্বীপে বন্দি তাদের নেতার গল্প শুনিয়েছেন। ম্যান্ডেলা তার ২৭ বছরের কারাজীবনের ১৮টি বছর কাটিয়েছেন ওই দ্বীপেই।
গোটা আশির দশকে যখন একজন নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলার ভাবমূর্তি গড়ে উঠছিল, তখন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৯৯০ সালে সরকারের পতন ঘটে।
বন্দি হওয়ার আগে ম্যান্ডেলা বিচক্ষণতার সঙ্গে বছরের পর বছর উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এএনসিকে চালিত করেছেন। হত্যা, গুপ্তহত্যা, ক্ষোভ আর গৃহযুদ্ধের ভয় ছিল। ছিল শুভেচ্ছা, বিচারবুদ্ধি, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও আপসের মনোবৃত্তিও। প্রায়ই ম্যান্ডেলাকে সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়তে হতো তা হল, কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের মনে আলোচনার মাধ্যমে বর্ণবাদ অবসানের প্রতি বিশ্বাস ধরে রাখা। তার মুক্তি ভবিষ্যতের ব্যাপারে জনগণের মনে বড় আশাবাদ জাগিয়ে তোলে। তবে গণতন্ত্রে উত্তরণে অন্তর্বর্তীকালীন সময়টি রাজনৈতিক সহিংসতা ও জনগণের ক্ষোভের কারণে নাজুক হয়ে ওঠায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হুমকির সম্মুখীন হয়।
তরুণ দক্ষিণ আফ্রিকানরা, যারা বর্ণবাদী সরকারের পতনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল, তারা চেয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা নেলসন ম্যান্ডেলাকে। কিন্তু ম্যান্ডেলা পরিণত হন একজন জাতীয় নেতা ও রাষ্ট্রনায়কে। তিনি তার প্রবল রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা সব পক্ষকে একটি বেদনাদায়ক অথচ অপরিহার্য সমঝোতায় রাজি করাতে সক্ষম হন।
‘মাদিবা জাদু’ প্রায় প্রত্যেকের মন জয় করে নেয়। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মন জয় করে নেন। কিছু মতানৈক্য সত্ত্বেও এ কাজে সঙ্গে পান কৃষ্ণাঙ্গদের।
বহু দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর কাছে ম্যান্ডেলার মুক্তি ছিল তাদের স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ। যে দিনটির জন্য তারা দীর্ঘকাল অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু এক সময় তাদের সেই আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছিল। অবশেষে তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়ায় তরুণ-বৃদ্ধ সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। ম্যান্ডেলা মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকের কাছেই জীবন হয়ে উঠেছিল কষ্টদায়ক। কঠিন হয়ে পড়েছিল ক্রমবর্ধমান তিক্ততাপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম এড়িয়ে চলা। কিন্তু তার মুক্তির পর বর্ণবাদের অবসান এবং ‘সবার জন্য একটি উন্নততর জীবন’ গড়ে তোলার সুযোগ উপস্থিত হল জনগণের সামনে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে ছিল- কিভাবে শ্বেতাঙ্গদের ভীতির সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রত্যাশার সমন্বয় হবে। কিন্তু ম্যান্ডেলা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে হাত দিলেন। ম্যান্ডেলা ১৯৯৫ সালের রাগবি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকান দল স্প্রিংবকের পেছনে জাতিকে সমবেত করলেন। এই টুর্নামেন্ট এবং স্প্রিংবকের বিজয় দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীকে একত্রিত করল এবং তাদের দেখিয়ে দিল, একটি জাতি হওয়ার জন্য তাদের অনেক কিছুতেই মিল রয়েছে।
এক মেয়াদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ম্যান্ডেলা দলীয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। দক্ষিণ আফ্রিকা কোনোক্রমেই আদর্শগতভাবে ‘রংধনু রাষ্ট্র’ নয়- যে নামে তাকে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তবে ম্যান্ডেলা জানতেন, দেশটি একজন মাত্র ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারে না- তা তিনি দেশে ও বিশ্বে যত বড় নেতা হিসেবেই বিবেচিত হোন না কেন।
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
পল স্টবার : প্রখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান সাংবাদিক
No comments